চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

‘ফেনোমেনন-শো’ এবং ব্রাজিলের পাঁচপূর্তির বিশ্বকাপ

ফিরে দেখা: বিশ্বকাপ-২০০২

সপ্তাহ দুই পরই বাজবে রাশিয়া বিশ্বকাপের বাঁশি। ২০টি বিশ্বকাপ পেরিয়ে এসেছে ফুটবল মহাযজ্ঞের যাত্রাপথ। প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল উরুগুয়ে। আগের আসরগুলোর পরতে পরতে ঠাসা রোমাঞ্চকর নানা গল্প। চ্যানেল আই অনলাইনের পাঠকদের ধারাবাহিকভাবে ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে ইতিহাসের ধূলিজমা সেসব পাতায়। আজ থাকছে সাউথ কোরিয়া ও জাপান বিশ্বকাপ ২০০২’র কথা-

ব্রাজিলের লুইস নাজারিও ডি লিমা নামের ছেলেটি ততদিনে পরিবার, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ছুঁয়ে ফেলেছেন বিশ্বফুটবলের বিস্তৃত সীমানা। সবাই তাকে চেনে ‘দ্য ফেনোমেনন’ নামে। বহুল পরিচিতি রোনাল্ডো নামেও। যিনি প্রতিপক্ষের ডি-বক্সের কাছাকাছি জায়গায় অলস-ভঙ্গিতে হাঁটাচলা করেন, আর পায়ে বল পেলেই জগতের অন্যতম বিপজ্জনক স্ট্রাইকার। যার নৈপুণ্যে হাতের পাঁচ আঙুলের চক্রপূরণ করে নিজেদের পঞ্চম বিশ্বকাপ শিরোপাটা ঘরে তুলেছিল ব্রাজিল।

ফিরে দেখা: বিশ্বকাপ-১৯৩০বিশ্বকাপ-১৯৩৪বিশ্বকাপ-১৯৩৮বিশ্বকাপ-১৯৫০, বিশ্বকাপ-১৯৫৪,

বিশ্বকাপ-১৯৫৮, বিশ্বকাপ-১৯৬২বিশ্বকাপ-১৯৬৬বিশ্বকাপ ১৯৭০বিশ্বকাপ-১৯৭৪,

বিশ্বকাপ-১৯৭৮বিশ্বকাপ-১৯৮২বিশ্বকাপ-১৯৮৬বিশ্বকাপ-১৯৯০বিশ্বকাপ-১৯৯৪বিশ্বকাপ-১৯৯৮

বিশ্বকাপের আসরে সর্বোচ্চ ১৫ গোলের রেকর্ডটা অনেকদিন নামের পাশে রেখেছিলেন রোনাল্ডো। পরে সেটা হারান জার্মানির মিরোস্লাভ ক্লোসার কাছে। সাউথ কোরিয়া ও জাপানের যৌথ আয়োজনে হওয়া বিশ্বকাপ ২০০২’তে ছিলেন সর্বোচ্চ স্কোরার। মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৯৯৪ সালে জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক। ২০ বছর বয়সে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে ফিফা বর্ষসেরার খেতাব অর্জন। ১৯৯৪তে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে জয়ী ব্রাজিল দলে ছিলেন। যদিও কোনো ম্যাচে নামা হয়নি।

জায়ান্ট কিলার হয়ে উঠেছিল সাউথ কোরিয়া

তরুণ রোনাল্ডো হয়ত তখনই আকাঙ্ক্ষার বীজটা বুনেছিলেন অন্তরে, নিজের ক্যারিশমাতে একটি বিশ্বকাপ এনে দেবেন দেশকে। ১৯৯৮এ ফ্রান্স বিশ্বকাপে ৪ গোল করার সঙ্গে করিয়েছিলেন ৩টি। সেবার ব্রাজিলের ১৪ গোলের ৫০ শতাংশেই ছিল তার অবদান। কিন্তু ফাইনালে জিদানের ফ্রান্সের বিপক্ষে ঘুমিয়ে থাকলেন! ব্রাজিলকে টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জেতানোর সুযোগ হাতছাড়া করার পরের আসরে জ্বলে উঠে যেটা সুদে-আসলেই পুষিয়ে দিয়েছেন।

পরিপূর্ণ এক স্ট্রাইকার তখন রোনাল্ডো, ২০০২ বিশ্বকাপে পুরো আসরে কেবল ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই গোল পাননি। ব্রাজিলের বাকি ম্যাচের প্রতিটিতেই গোল ছিল। সেমিফাইনালে তুরস্কের বিপক্ষে তার একমাত্র গোলেই শিরোপার লড়াই নিশ্চিত করেছিল ব্রাজিল। ফাইনালেও জোড়া গোল। আসরে ৮ গোলের সঙ্গে গোল্ডেন বুট অর্জন।

‘ফেনোমেনন’ সেবার জ্বলেছিলেন আপন মহিমাতেই। সঙ্গে পেয়েছিলেন অধিনায়ক কাফু, লুসিও, রবার্তো কার্লোস, রিকার্ডিনহো, রিভালদো, রোনালদিনহো, দিদা, ডেনিলসন, জুনিনহো, কাকা-দের মত জোগো বনিতার শিল্পীদের।

সাউথ কোরিয়া ও জাপান যৌথ আয়োজক সেবার, ছিল বিশ্বযজ্ঞের ১৭তম আসর। ৩১মে থেকে ৩০জুন, এশিয়ায় হওয়া প্রথম বিশ্বকাপ। যৌথ আয়োজনের প্রথম বিশ্বকাপও ছিল সেটি। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স গ্রুপপর্বেই ছিটকে যায়, সংগ্রহ করতে পেরেছিল মাত্র এক পয়েন্ট। আরেক লাতিন ফেভারিট আর্জেন্টিনাও গ্রুপপর্ব পেরোতে পারেনি।

গোল্ডেন বুট যায় ‘দ্য ফেনোমেনন’ রোনাল্ডোর ঘরে

চমক দেখানো তুরস্ক তৃতীয় হয়েছিল। স্বাগতিক সাউথ কোরিয়া হয়ে উঠেছিল জায়ান্ট কিলার; স্পেন, ইতালি, পর্তুগালকে হারিয়ে সেমির টিকিট কাটে। তার আগে ১৯৯ দলের বাছাইপর্ব পেরিয়ে মূল আসরে আসে ২৯ দেশ। তিন দেশ সরাসরি। স্বাগতিক হিসেবে আসে সাউথ কোরিয়া, বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পায় সেবারের আগে কখনও কোয়ালিফাই করতে না পারা জাপানও। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের সরাসরি খেলার সুযোগও সেবারই শেষবার ছিল। চিন, ইকুয়েডর, সেনেগাল ও স্লোভেনিয়া প্রথমবার খেলার সুযোগ করে নেয়।

তুরস্ক ১৯৫৪ সালের পর প্রথমবার কোয়ালিফাই করে। ১৯৮৬ সালের পর পর্তুগাল ও পোল্যান্ডও প্রথম। আগের আসরের সেমিফাইনালিস্ট নেদারল্যান্ডস; সঙ্গে রোমানিয়া, কলম্বিয়া, বুলগেরিয়া, মরক্কোর মতো দলগুলো জায়গা করে নিতে পারেনি। দুই আয়োজকের ১০টি করে ভেন্যুতে হয় বিশ্বকাপ। গ্রুপ-এ এবং ডি’র দল সব ম্যাচ খেলে সাউথ কোরিয়ায়। গ্রুপ-ই এবং এইচ’র দলগুলো সব ম্যাচ খেলে জাপানে।

গ্রুপ-এ থেকে চোটে পড়া জিদানকে ছাড়া ১-০তে হেরে শুরু করে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স। নকআউটে যায় শীর্ষ পয়েন্ট পাওয়া ডেনমার্ক ও চমক জাগানো সেনেগাল। ফ্রান্সের সঙ্গে বিদায় নেয় উরুগুয়েও। গ্রুপ-বি থেকে স্পেন ও প্যারাগুয়ে নকআউটের টিকিট কাটে।

গ্রুপ-সি থেকে তিন জয়ে পূর্ণ ৯ পয়েন্ট নিয়ে ব্রাজিল ও তুরস্ক আসে নকআউটে। ব্রাজিল ২-১ গোলে তুরস্ককে, চিনকে ৪-০ গোলে এবং কোস্টারিকাকে ৫-২ গোলে উড়িয়ে আসে। গ্রুপ-জি থেকে মেক্সিকো ও ইতালি, আর এইচ থেকে স্বাগতিক জাপান ও বেলজিয়াম পরের রাউন্ডে যায়।

কাফু প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে টানা তিনটি ফাইনালে খেলেন

ডি-গ্রুপ থেকে উঠে আসে সাউথ কোরিয়া ও ইউনাইটেড স্টেটস। ছিটকে যায় পর্তুগাল ও পোল্যান্ড। ই-গ্রুপ থেকে জার্মানি ও রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ড পরের রাউন্ডে জায়গা করে নেয়। এফ-গ্রুপে হয় ওলটপালট। সুইডেন ও ইংল্যান্ড এক জয় ও দুই ড্র নিয়ে ৫ পয়েন্ট করে ঘরে তুলে নকআউটে যায়। ছিটকে যায় আর্জেন্টিনা ও নাইজেরিয়া। একটি করে জয়-ড্র-হার ছিল আর্জেন্টিনার। জয়টি নাইজেরিয়ার বিপক্ষে, টেনেটুনে ১-০ গোলে।

পরে জার্মানি ১-০তে প্যারাগুয়েকে হারিয়ে কোয়ার্টারে আসে। মেক্সিকোকে হারায় যুক্তরাষ্ট্র। ইংল্যান্ড ডেনমার্ককে, সেনেগাল সুইডেনকে, আর তুরস্ক জাপানের স্বপ্ন ভেঙে কোয়ার্টারে আসে। সেনেগালকে বিদায় করে দেয় স্পেন। আর ব্রাজিল হারায় বেলজিয়ামকে।

কোয়ার্টারে যুক্তরাষ্ট্রকে হারাতে ঘাম ছুটে যায় জার্মানির, টেনেটুনে ১-০’র জয়। স্পেন তো পেনাল্টিশ্যুটে সাউথ কোরিয়ার কাছে হেরেই যায়। নির্ধারিত সময়ে গোলশূন্য থাকার পর অতিরিক্ত সময়ের গোল্ডেন গোলে সেনেগালকে বিদায় করে দেয় তুরস্ক। গোল্ডেন গোলের নিয়মও সেবারই বিদায় নেয়। উড়তে থাকা ব্রাজিল ইংল্যান্ডকে হারাতে খানিকটা বেগ পেয়েছিল। শেষপর্যন্ত ২-১ গোলের জয় তুলে নেয় হরুদ জার্সিরা।

সেমিতে অপেক্ষাকৃত সহজ দলই পায় ব্রাজিল। কিন্তু সেবার চমক দেখানো তুরস্ককে হারাতেই ঘাম ছুটে যায় দারুণ ফর্মে থাকা ব্রাজিলের। আসরের সর্বোচ্চ গোলদাতা রোনাল্ডোর একমাত্র গোলে শিরোপার মঞ্চে আসা নিশ্চিত করে সেলেসাওরা। সেখানে প্রতিপক্ষ স্বাগতিক কোরিয়াকে কোনোমতে ১-০ গোলে হারিয়ে আসে জার্মানি।

ফাইনাল
ইন্টার মিলানের হয়ে তিন মৌসুমে খেলতে পেরেছিলেন মাত্র ২৪ ম্যাচ। ২০০০-০১ মৌসুমের একটি ম্যাচেও নামা হয়নি রোনাল্ডোর। ২০০২ বিশ্বকাপের ব্রাজিল দলে থাকবেন কি না সেটা নিয়েই আলোচনা তুঙ্গে ছিল। ফাইনালে আসার পথে সেই বিতর্ক ততদিনে উধাও। জাপানের ইয়োকোহামার নিসান স্টেডিয়ামে নিজেকে অমরত্বের পথে আরেকধাপ টেনে নিতে প্রস্তুত ফেনোমেননও।

রেকর্ড পঞ্চম শিরোপার পর বাধভাঙা উল্লাস

শক্তিশালী জার্মানির বিপক্ষে আক্রমণাত্মক আর ছন্দময় ফুটবল খেলে প্রথমার্ধে গোলের দেখা পায়নি ব্রাজিল। দ্বিতীয়ার্ধে খেলা ৬৭ মিনিটে গড়িয়েছে, গোলের দেখা নেই। তখনই ত্রাতা রোনাল্ডো। ৬৯ মিনিটে আরেকবার জাল খুঁজে নেন ফেনোমেনন। আগাম শিরোপা উৎসব শুরু করে দেয় ব্রাজিল!

১৯৭০ বিশ্বকাপের পর ব্রাজিলই প্রথম দল হয়, যারা সবকটি ম্যাচেই জয় তুলে নেয়। ১৯৮৬’র আর্জেন্টিনার পর প্রথম দল হিসেবে নকআউটে কোনো পেনাল্টি শ্যুটআউটেও পড়তে হয়নি সেলেসাওদের। আর অধিনায়ক কাফু প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে টানা তিনটি ফাইনালে খেলার গৌরবে নাম লেখান।

টুকিটাকি
সাউথ কোরিয়াকে ২-৩ গোলে হারিয়ে তৃতীয় হয় তুরস্ক। আসরে সর্বোচ্চ ৮ গোল করে গোল্ডেন বুট ‘দ্য ফেনোমেনন’ রোনাল্ডোর। টুর্নামেন্টজুড়ে ১৬১ গোল এসেছে ১১২ জন ভিন্ন ভিন্ন খেলোয়াড়ের থেকে। তিনটি আত্মঘাতী গোল ছিল। যার দুটি আবার একই ম্যাচে, দুই প্রতিপক্ষের। বিশ্বকাপে সেটাও বিরল ঘটনা আজ অবধি।