মাস পেরোনোর আগেই বাজবে রাশিয়া বিশ্বকাপের বাঁশি। ২০টি বিশ্বকাপ পেরিয়ে এসেছে ফুটবল মহাযজ্ঞের যাত্রাপথ। প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল উরুগুয়ে। আগের আসরগুলোর পরতে পরতে ঠাসা রোমাঞ্চকর নানা গল্প। চ্যানেল আই অনলাইনের পাঠকদের ধারাবাহিকভাবে ফিরিয়ে নেয়া হবে ইতিহাসের ধূলিজমা সেসব পাতায়। আজ থাকছে ব্রাজিল বিশ্বকাপ ১৯৫০’র কথা-
ইতিহাসের চতুর্থ বিশ্বকাপ ছিল ১৯৫০’র ব্রাজিল বিশ্বকাপ। ওই বছরের ২৪ জুন থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত চলা বিশ্বকাপ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথম। যুদ্ধের কারণে ১৯৩৮’র পর ১৯৪২ ও ১৯৪৬’র বিশ্বকাপ আয়োজনই করা যায়নি। বিভক্ত বিশ্বের বিশ্বকাপে সেইবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল উরুগুয়ে। ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপ জেতা দলটি শিরোপা জিতেছিল আবার স্বাগতিক ব্রাজিলকে ২-১ গোলে হারিয়ে।
ফিরে দেখা: বিশ্বকাপ-১৯৩০, বিশ্বকাপ-১৯৩৪, বিশ্বকাপ-১৯৩৮
বিশ্বযুদ্ধ শেষে ফিফা চেয়েছিল যতদ্রুত সম্ভব বিশ্বকাপ আয়োজন করতে এবং সেটা করার জন্য সর্বোচ্চটা দিতে। যুদ্ধের কারণে সেই সময় ইউরোপের অনেক দেশই ছিল ধ্বংসাবশেষে। ফলে বিশ্বকাপ আয়োজন করতে চায় এমন দেশ খুঁজে পাওয়াই ফিফার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল শুরুতে। প্রায় সবদেশের সরকারই চাচ্ছিল ক্রীড়াযজ্ঞ আয়োজনের পরিবর্তে সেই অর্থ দিয়ে দেশের ক্ষত মেরামত করতে।
১৯৪২ ও ১৯৪৬ সালের বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য লিডিং পজিশনে ছিল ব্রাজিল এবং জার্মানি। যারমধ্যে ১৯৪২ বিশ্বকাপের জন্য বেশি এগিয়ে ছিল ব্রাজিল। আগের দুটি বিশ্বকাপ ১৯৩০ ও ১৯৩৮ হয়েছিল ইউরোপে। তাই ফিফা চাচ্ছিল যেকোনোভাবেই হোক পরের বিশ্বকাপটা লাতিন আমেরিকার কোনো দেশে করতে। তাই ১৯৪২ বিশ্বকাপের জন্য ব্রাজিলের বিড সহজেই সবার মন কেড়েছিল। কিন্তু যুদ্ধের কারণে ’৪২ এরং পরে ’৪৬ বিশ্বকাপও না হওয়ায় ভোল পাল্টে, পরেরবার আয়োজক হতে চেয়ে কেবল ৫০ ভাগ ভোট পায় ব্রাজিল। তাতেও স্বাগতিক হতে সমস্যা হয়নি।
স্বাগতিক হিসেবে ব্রাজিল আর ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ইতালি সরাসরি বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায়। ১৬ জাতির লড়াইয়ের বাকি ১৪টি দলের মধ্য ইউরোপ থেকে ৭টি, আমেরিকা থেকে ৬টি ও এশিয়া থেকে ছিল একটি। পরে যেটি কমে আসে নাম প্রত্যাহারের পর প্রত্যাহারের ধাক্কায়।
পূর্ব-পশ্চিম জার্মানি ও জাপান মিত্রবাহিনী দখলে থাকায় বাছাইপর্বই খেলতে পারেনি। ফান্সের দখলে থাকা সারল্যান্ড (জার্মানির বর্তমান সারল্যান্ড প্রদেশ) বিশ্বকাপের মাত্র দুসপ্তাহ আগে অনুমতি পায়।
বিশ্বযুদ্ধে ইতালি, অস্ট্রিয়া এবং জাপান সবাই জার্মানির মিত্র হলেও তাদের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা চাপানো হয়নি।
আয়োজন চূড়ান্ত হলে পরে অনেক দেশই বিশ্বকাপে অংশ নিতে অস্বীকার করে। যারমধ্যে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, ১৯৩৪’র ফাইনালিস্ট চেকোস্লাভিয়া এবং ১৯৩৮’র ফাইনালিস্ট হাঙ্গেরিও।
কোয়ালিফাইংয়ের ড্রয়ের পর নাম প্রত্যাহার করে নেয় আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর এবং পেরু। ব্রাজিল ফুটবল কনফেডারেশনের সঙ্গে তিক্ত সম্পর্কের কারণে নিজেদের সরিয়ে নেয় আর্জেন্টিনা। ফলে প্রতিদ্বন্দ্বীতা ছাড়াই চিলি, বলিভিয়া, প্যারাগুয়ে ও উরুগুয়ে মূলপর্বে জায়গা করে নেয়।
আর তাতে দারুণ প্রতিভাবান কিছু আর্জেন্টাইন খেলোয়াড় যেমন- জেনারেল রসি, ডি স্টেফানো, বিংশ শতাব্দীর সেরা গোলরক্ষক হিসেবে বিবেচিত হওয়া ক্যারিজোরা বিশ্বমঞ্চে আলো ছড়ানো থেকে বঞ্চিত হন। যাদের কল্যাণে টানা তিনটি কোপা আমেরিকা জিতেছিল দেশটি।
এশিয়া থেকে নাম প্রত্যাহার করে নেয় ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়া ও মিয়ানমার (তৎকালীন বার্মা)। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় কোয়ালিফাই করে ভারত। অতি অনভিজ্ঞতার কথা বলে ইউরোপ থেকে নাম প্রত্যাহার করে অস্ট্রিয়া। তাদের পথে হাঁটে বেলজিয়ামও। ফলে বাছাই রাউন্ড না খেলেই বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত হয়ে যায় সুইজারল্যান্ড ও তুরস্কের।
পরে অবশ্য নাম প্রত্যাহার করে নেয় তুরস্কও। সাউথ আমেরিকায় ভ্রমণের ক্ষেত্রে আর্থিক সংকটের কথা বলে সরে দাঁড়ায় দেশটি। আর ইংল্যান্ডের সঙ্গে ঝামেলার কারণে তুর্কিদের পথ অনুসরণ করে স্কটল্যান্ড। পরে স্কটিশ ও তুর্কির জায়গা পূরণে কোয়ালিফাই পর্বে বাদ যাওয়া পর্তুগাল, আয়ারল্যান্ড এবং ফ্রান্সকে আমন্ত্রণ জানায় ফিফা। যদিও পর্তুগাল ও আয়ারল্যান্ড প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। আর ফ্রান্স বিশ্বকাপে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
ড্রয়ের পরে আবার বেকে বসে এশিয়ার প্রতিনিধি ভারত। ভ্রমণের জন্য তহবিল সংকট (যদিও ভ্রমণের বেশিরভাগ অর্থ ফিফাই দিতে চেয়েছিল), দলের অনুশীলনের ঘাটতি ও দল গঠনের জটিলতার কারণ দেখিয়ে সরে যায় দেশটি।
সেই বিশ্বকাপের আগে ১৯৪৮’র অলিম্পিকে খালি পায়ে ফুটবল খেলা নিষিদ্ধ করে ফিফা। ওই অলিম্পিকে অবশ্য খালি পায়েই খেলেছিল ভারত। তাদের বিশ্বকাপ থেকে নাম প্রত্যাহারের এটাই বড় কারণ বলে অনেকে দাবি করেন। কিন্তু পরে ওই সময়ের ভারতীয় অধিনায়ক শৈলেন মান্না দাবি করেন, তাদের সরে যাওয়ার সঙ্গে ফিফার সিদ্ধান্তের কোনো সংযোগ নেই।
প্রত্যাহার নাটক তখনও থামেনি। ভ্রমণের জন্য অর্থের পরিমাণের সমালোচনা করে বিশ্বকাপ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে ফ্রান্সও। এমন সময় ফরাসিরা তাদের সরিয়ে নেয় যে, অল্প সময়ের মধ্য অন্যকোনো দলকে আমন্ত্রণই জানাতে পারেনি ফিফা।
গ্রুপপর্বে সুইডেনকে ৭-১ ও স্পেনকে ৬-১ গোলে হারিয়ে দাপুটে শুরু করেছিল স্বাগতিক ব্রাজিল। ফলে ১৬ জুলাইয়ের ফাইনালে হট ফেভারিট ছিল তারাই। নিজেদের প্রথম শিরোপ জয় দেখতে সেদিন মারাকানায় উপস্থিত হয়েছিলেন ১ লাখ ৯৯ হাজার ৯শ ৫৪জন দর্শক। প্রথমার্ধ গোলশূন্য থাকলেও দর্শকদের আশা মতো দ্বিতীয়ার্ধের দ্বিতীয় মিনিটে অ্যাবিনো ফ্রেইকা কার্ডোসোর গোলে এগিয়ে যায় ব্রাজিল। মিনিট দশেকের মধ্যেই সমতায় ফেরে উরুগুয়ে, হুয়ান আলবের্তো ভিল্লানোর গোলে।
তবে ব্রাজিল সমর্থকদের মাথায় আসল বাজটা পড়ে ম্যাচ শেষ হওয়ার ১১ মিনিট আগে। তখনই অ্যালসিডেস এডগার্ডো ঘিগিয়া পেরেয়রার গোলে এগিয়ে যায় প্রথম বিশ্বকাপজয়ী উরুগুইয়ানরা। সেটাতেই হার। সেই হৃদয়বিদারক হারে আশ্চর্য-স্তব্ধ হয়েছিল ব্রাজিল; যাকে মারাকানজো (মারাকানা বিপর্যয়) হিসেবে অভিহিত করা হয়।
টুর্নামেন্টেই বিজয়ীদের হাতে তুলে দেয়া হয় জুলে রিমে ট্রফি। বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৩৮ সালের পর বিশ্বকাপ ট্রফিটি আর প্রকাশ্য কোনো স্টেজে দেখা যায়নি। দেখা না পাওয়া ট্রফিই দেখা দেয় উরুগুয়েকে।
১৯৫০ বিশ্বকাপের টুকিটাকি: বিশ্বকাপের চতুর্থ আসর ছিল। স্বাগতিক ব্রাজিল। ২৪-১৬ জুলাই, ২৩ দিনের লড়াইয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মেলে। তিন মহাদেশ থেকে ১৪টি দল অংশ নেয়। ৬টি শহরের ৬টি ভেন্যুতে খেলা হয়। চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে, আর রানার্সআপ ব্রাজিল। তৃতীয় হয় সুইডেন, চার নম্বর স্পেন। মোট গোল ৮৮ (ম্যাচ প্রতি ৪ গোল)। সর্বোচ্চ গোলদাতা অ্যাডেমির (ব্রাজিল, ৮ গোল)। ম্যাচে সর্বোচ্চ দর্শক উপস্থিতি ১ লাখ ৯৯ হাজার ৯শ ৫৪জন জন। আর ম্যাচ প্রতি গড় উপস্থিতি ৪৭,৫১১জন।