চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ভিন গ্রহের দল, টোটাল ফুটবল আর ক্রুইফ-আক্ষেপ

ফিরে দেখা: বিশ্বকাপ-১৯৭৪

মাস পেরোনোর আগেই বাজবে রাশিয়া বিশ্বকাপের বাঁশি। ২০টি বিশ্বকাপ পেরিয়ে এসেছে ফুটবল মহাযজ্ঞের যাত্রাপথ। প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল উরুগুয়ে। আগের আসরগুলোর পরতে পরতে ঠাসা রোমাঞ্চকর নানা গল্প। চ্যানেল আই অনলাইনের পাঠকদের ধারাবাহিকভাবে ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে ইতিহাসের ধূলিজমা সেসব পাতায়। আজ থাকছে ওয়েস্ট জার্মানি বিশ্বকাপ ১৯৭৪’র কথা-

রেডিও ধারাভাষ্যে আসতেই লেগেছে অনেকটা সময়, পরে টিভিতে সম্প্রচার। আধুনিক জমকালোর মতো না হলেও ততদিনে রঙিন-দৃশ্যে সম্প্রচার শুরু হয়ে গেছে বিশ্বকাপের। সম্প্রচারের উত্তরণের মতো মাঠের খেলাতেও লেগেছে রং। দলগুলো প্রতিপক্ষকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে মাঠে নামার পাশাপাশি নিজেদের রণ-ফর্মেশনে আনতে শুরু করেছে নতুনত্ব। কিন্তু নেদারল্যান্ডসের হাত ধরে ৭৪’র বিশ্বকাপে এমন এক ফর্মেশন এলো, যাতে আসলে ছিল না কোনো ফর্মেশনই! বোদ্ধারা যার নাম দিলেন- ‘টোটাল ফুটবল’।

ফিরে দেখা: বিশ্বকাপ-১৯৩০বিশ্বকাপ-১৯৩৪বিশ্বকাপ-১৯৩৮বিশ্বকাপ-১৯৫০, বিশ্বকাপ-১৯৫৪,

বিশ্বকাপ-১৯৫৮, বিশ্বকাপ-১৯৬২বিশ্বকাপ-১৯৬৬বিশ্বকাপ ১৯৭০

নেদারল্যান্ডস সেবার কেমন ফুটবল খেলেছিল? বোদ্ধারা বলেন অদ্ভুতসুন্দর সে খেলোনি। যার মাস্টারমাইন্ড ছিলেন কোচ রাইনাস মিশেলস। আর রেসিপি ছিল, পুরো দল একসঙ্গে আক্রমণে যাবে, আবার একসঙ্গে ফিরে রক্ষণদূর্গ বাঁচাবে। রাইনাসের দল খেলেছিল তেমন কৌশলেই।

ক্রুইফ ঝলকের মুহূর্ত

নিজে আয়াক্স আমস্টারডামের কোচ ছিলেন। সেখান থেকেই এনেছিলেন অনন্য এই ফুটবলশৈলী- টোটাল ফুটবল। জাতীয় দলের দায়িত্ব নিয়ে দলও সাজিয়েছিলেন আয়াক্স নির্ভর। যে দলের একটা বড় অংশ আসে ১৯৭১, ৭১, ৭৩ সালে ইউরোপীয় কাপজয়ী আয়াক্স থেকে। কৌশল প্রয়োগে তাই খুব একটা বেগ পেতে হয়নি রাইনাসকে।

চোখ ধাঁধানো, দৃষ্টিনন্দন সেই ফুটবলের মধ্যমণি ছিলেন ইয়োহান ক্রুইফ। সঙ্গী ছিলেন নিসকেন্স, রেপরা। গৎবাঁধা ফর্মেশনের পরিবর্তে রাইনাস ক্রুইফদের খেলতে দিয়েছিলেন অগাধ স্বাধীনভাবে। এমন স্বাধীনতা ডাচ-শিল্পের আগে দেখেনি বিশ্ব। ডিফেন্ডার, স্ট্রাইকার, মিডফিল্ডার যেনো আলাদা কিছু নয়, ১১ জনই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে খেলেছেন সবুজ গালিচাজুড়ে।

ডিফেন্স থেকে হঠাতই কেউ উঠে যেতেন আক্রমণে, আবার খানিক আগে গোল করা খেলোয়াড়টি দ্রুত নিচে নেমে পরিণত হতেন রক্ষণদেয়ালে। বল নিয়ে এই কারুকার্য চলত নিজ ডিফেন্স থেকে শুরু করে প্রতিপক্ষের গোলবার খুঁজে নেয়ার আগপর্যন্ত। তাতে ফুটবল মাঠ যেন হয়ে উঠেছিল পিকাসোর ক্যানভাস। যেখানে কখনও তুলি হয়ে আঁচড় কাটতেন ক্রুইফ, কখনও রেপ, কখনও ক্রল। আবার কখনও ক্রুইফ, নিসকেন্সরা যে পথে ছুটতেন ছোট ছোট পাসে, সেই পথের খণ্ডখণ্ড চিত্র জোড়া দিয়ে হয়ে উঠত ভ্যানগগের বিশাল কোনো ক্যানভাস।

নকশিকাঁথা আঁকা এমন শৈল্পিক ফুটবলই উপহার দিয়েছিলেন ডাচ-শিল্পীরা। সারা মাঠজুড়ে এমন শৈল্পিকতা ছড়ানোর নামই ছিল আসলে টোটাল ফুটবল।

টোটাল ফুটবলের ডাচ আক্রমণ

ফুটবল ম্যাচের ৯০ মিনিট এমনিতেই স্নায়ুচাপের কারখানা। বিশ্বকাপের মঞ্চে তো আরও বেশি। কতশত অঘটন আর উপাখ্যানের জন্মদাতা প্রতিটি মিনিট। রূপকথার জন্ম দেয়া সেসব ঘটনার বর্ণনায় দরকার পড়ে হরেক বিশেষণ, বিশ্লেষণের। হাসি-কান্নার মিশেলে রঙ্গমঞ্চের কথা তারপরও কতটুকু বলা যায়। নেদারল্যান্ডসের ক্ষেত্রেও হয়েছিল তাই। টোটাল ফুটবলের সৌন্দর্যে সবাইকে বুদ করে তারা চলে গিয়েছিল ফাইনালে। কিন্তু ফাইনালে জার্মানদের কাছে স্বপ্নভঙ্গ। যা আসলে বিশ্বকাপেরই চির আক্ষেপের গল্প হয়ে আছে। সেরা দলটা সবসময় যে শিরোপা উঁচিয়ে ধরতে পারে না, পুসকাসের হাঙ্গেরির পর ক্রুইফের দল সেটিই বুঝিয়েছিল যেন।

বিশ্বকাপের দশম আসর ছিল সেবার। ১৩জুন থেকে ৭জুলাই, আসর বসেছিল ওয়েস্ট জার্মানিতে। তিনবার বিশ্বসেরা হয়ে আগের আসরে ব্রাজিল জুলে রিমে ট্রফিটা একেবারেই নিয়ে যাওয়ায় নতুন ট্রফি বানাতে হয় ফিফাকে। যা এখন অবধি চলছে। ইতালিয়ান ভাস্করশিল্পী সিলভিও গাজ্জানিগার নকশা করেন নতুন ট্রফির।

অস্ট্রেলিয়া, ইস্ট জার্মানি, হাইতি প্রথমবার সুযোগ পায়। ইস্ট জার্মানি সেই প্রথম, সেই শেষবার খেলেছে বিশ্বকাপে, পরে ১৯৯০ সালে তো বার্লিন দেয়াল-দূরত্ব ঘুচেই যায় দুই জার্মানির।

বাছাইপর্ব ছিল ৯৮ দেশের। ১৯৬৬ চ্যাম্পিয়ন জার্মানি, ফ্রান্স, মেক্সিকো, স্পেন, পর্তুগাল, বেলজিয়াম, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরির মত দলগুলো বাছাই উতরে যেতে পারেনি। ১৯৩৮ সালের পর প্রথম কোয়ালিফাই উতরায় নেদারল্যান্ডস ও পোল্যান্ড। ১৬ বছর পর আসে স্কটল্যান্ড। আগের বিশ্বকাপে খেলতে না পারা চিলি ও আর্জেন্টিনাও কোয়ালিফাই করে।

কমলা রঙের নেদারল্যান্ডসের মন্ত্রমুগ্ধ ফুটবলের আগে আলোচনার জন্ম দিয়েছিল দুই জার্মানির ম্যাচ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে বিভক্ত জার্মানির ইস্ট-অংশ বিশ্বকাপে নাম লিখিয়েই ওয়েস্টদের হারিয়ে দেয়। গ্রুপপর্বে ওয়েস্ট জার্মানিকে টপকে সেরাও হয়। ইস্টের কাছে সেই হারের ধাক্কাই হয়ত পরে তাঁতিয়ে দিয়েছিল ওয়েস্টদের, যার শেষ আসে শিরোপায়।

মূলপর্বের ১৬ দলকে চারভাগে ভাগ করা হয়। প্রথম গ্রুপে ইস্ট জার্মানির সঙ্গী রানার্সআপ ওয়েস্টরা। দ্বিতীয় গ্রুপে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। পয়েন্টে যুগোস্লাভিয়া, ব্রাজিল ও স্কটল্যান্ড সমান চার করে অর্জন করে। বাদ যায় স্কটিশরাই। তৃতীয় গ্রুপ থেকে আসে নেদারল্যান্ডস ও সুইডেন। চতুর্থ গ্রুপে পোল্যান্ড সেরা, আর্জেন্টিনা দ্বিতীয়। পোলিশরা একমাত্র দল যারা গ্রুপপর্বের তিনটি ম্যাচই জিতেছিল। আর্জেন্টিনাকে হারিয়েছিল ৩-২ গোলে।

সেবার ফাইনালের আগ পর্যন্ত ছিল নকআউট পর্ব। দ্বিতীয় রাউন্ডের চারটি করে দল নিয়ে দুটি গ্রুপ করে খেলা। দুই গ্রুপের শীর্ষ দুদল ফাইনালে যাবে। রানার্সআপ দুদল লড়বে তৃতীয় হতে।

তাতে গ্রুপ-এ তে নেদারল্যান্ডস, ইস্ট জার্মানি আর ব্রাজিলের সঙ্গী আর্জেন্টিনা। তিন ম্যাচের কোনটিই জিততে পারেনি আর্জেন্টিনা, একটি ড্র নিয়ে বাড়ির পথ ধরে। সঙ্গী ইস্ট জার্মানি। ব্রাজিলকে টপকে নেদারল্যান্ডস শীর্ষে থাকে তিন ম্যাচের সবকটি জিতে। ডাচদের বিপক্ষে ২-০তে হারেই স্বপ্নভঙ্গ সেলেসাওদের। আর আর্জেন্টিনা ডাচদের কাছে ৪-০তে হারের সঙ্গে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের কাছে ম্যাচ হাতছাড়া করে ১-২ ব্যবধানে। পরে পোল্যান্ডের কাছে হেরে চতুর্থ হয় ব্রাজিল।

জার্ড মুলার

বি-গ্রুপে সব ম্যাচ জিতে শীর্ষে থাকে ওয়েস্ট জার্মানি। চিরশত্রু পোল্যান্ডকে ১-০তে হারানোর পুরস্কার মেলে তাদের। তাতে শিরোপার যুদ্ধে প্রতিপক্ষ হয় সাদা-কালো জার্সির বেকেনবাওয়ার আর কমলার ক্রুইফদের দল।

ফাইনালে উড়তে থাকা নেদারল্যান্ডসের সামনে দৃঢ়চেতা জার্মানরা। প্রথম গোলটি আসে দ্বিতীয় মিনিটেই, ক্রুইফকে ফাউল করে ডাচদের উপহার দেয় জার্মানরা। পেনাল্টিতে জাল খুঁজে নেন নিসকেন্স। সেটাই শেষ। ২৫ মিনিটে জার্মানদেরও পেনাল্টি উপহার দেয় ডাচরা। সমতা এনে দেন ব্রিইটনার। ৪৩ মিনিটে মুলারের পায়ে আসে লিড। মেক্সিকো বিশ্বকাপে ১০ গোল করা মুলার আসরে নিজের চতুর্থ গোলটি করে দলকে শিরোপাই এনে দেন। তাতে অসাধারণ ফুটবলশৈলীর মধ্যমণি হয়েও আক্ষেপের আরেক নাম হয়ে থাকেন ক্রুইফ।

যে আক্ষেপ আজও ঘোচাতে পারেনি ডাচরা। পরেরবার ১৯৭৮ আর ২০১০ বিশ্বকাপেও রানার্সআপ তারা। রাশিয়া বিশ্বকাপ-২০১৮তে তো কোয়ালিফাইই করতে পারেনি।

শিরোপাজয়ী জার্মানদের বরণ উৎসব

৯৭ গোলের টুর্নামেন্টে ৫৩ জন খেলোয়াড় জাল খুঁজে নেন সেবার। তিনটি ছিল আত্মঘাতী। টুর্নামেন্ট সর্বোচ্চ ৭ গোল করে গোল্ডেন বুট পেয়েছিলেন পোল্যান্ডের গ্রজিগোর্জ ল্যাটো।