মাস পেরোনোর আগেই বাজবে রাশিয়া বিশ্বকাপের বাঁশি। ২০টি বিশ্বকাপ পেরিয়ে এসেছে ফুটবল মহাযজ্ঞের যাত্রাপথ। প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল উরুগুয়ে। আগের আসরগুলোর পরতে পরতে ঠাসা রোমাঞ্চকর নানা গল্প। চ্যানেল আই অনলাইনের পাঠকদের ধারাবাহিকভাবে ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে ইতিহাসের ধূলিজমা সেসব পাতায়। আজ থাকছে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ ১৯৬৬’র কথা-
বিশ্বকাপ শুরু হতে বাকি তখন চার মাস। ২০ মার্চ, ১৯৬৬। সেদিন হঠাতই টুর্নামেন্ট কমিটির মাথায় হাত। কড়া নিরাপত্তা থাকা সত্ত্বেও প্রদর্শনীর সময় বিশ্বকাপ ফুটবলের ৩০ লাখ পাউন্ড মূল্যের ‘জুলে রিমে ট্রফি’টা যে গায়েব করে দিয়েছে চোর বাবাজি!
ফিরে দেখা: বিশ্বকাপ-১৯৩০, বিশ্বকাপ-১৯৩৪, বিশ্বকাপ-১৯৩৮, বিশ্বকাপ-১৯৫০, বিশ্বকাপ-১৯৫৪,
অনেক খোঁজাখুঁজির পরও যখন ফল অন্তঃসারশূন্য, তখনই নায়ক বনে গেল পিকলস নামের এক কুকুর। চুরির ঠিক সাতদিনের মাথায় সাউথ লন্ডনের এক বাগান থেকে কাগজে মোড়ানো অবস্থায় জুলে রিমে ট্রফিকে খুঁজে বের করে পিকলস। তাতে হাফ ছেড়ে বাঁচে বিশ্বকাপ কর্তৃপক্ষ। সেসবার বিশ্বকাপ জিতেছিল পিকলসের দেশ ইংল্যান্ডই। তবে ফুটবল না খেলেও ১৯৬৬ বিশ্বকাপের অন্যতম নায়ক বনে যায় চারপেয়ে কুকুরটিও।
পিকলসের কাছে কৃতজ্ঞতার নমুনা স্বরূপ ম্যাচ সরিয়ে দেয়ার ঘটনা আছে! সূচিতে ছিল স্বাগতিক ইংল্যান্ডের গ্রুপের সবগুলো দলের খেলা হবে ওয়েম্বলিতে। কিন্তু ফ্রান্স ও উরুগুয়ের ম্যাচে বাধে বিপত্তি। প্রাচীন ঐতিহ্য অনুযায়ী গ্রে হাউন্ড কুকুরের দৌড় অনুষ্ঠিত হতো ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে।
প্রতিযোগিতার মূল উদ্যোক্তা বেকে বসেন কুকুরের দৌড় বাদ দিয়ে কিছুতেই হবে না বিশ্বকাপ ম্যাচ। জুলে রিমে কাণ্ডে পিকলসের কীর্তির কারণ টেনে শেষে ম্যাচ সরিয়ে নিতে বাধ্য হয় ফিফা। পরে সেই ম্যাচটি হয় হোয়াইট সিটি স্টেডিয়ামে।
সেবার পারলেও জুলেরিমে ট্রফিকে অবশ্য শেষপর্যন্ত রক্ষা করা যায়নি! ১৯৭০ সালে ব্রাজিল তৃতীয়বারের মতো বিশ্বসেরা হলে তাদেরকে ট্রফিটি একেবারে দিয়ে দেয়া হয়। এরপর থেকে রিও ডি জেনিরোতে অবস্থিত ব্রাজিল ফুটবল কনফেডারেশনের সদর দপ্তরেই কাপটি সুরক্ষিত ছিল। কিন্তু ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বরে আবারও চুরি যায় ট্রফিটি। এবার আর কোনো পিকলস উদ্ধারকর্তা হয়ে আসেনি জুলেরিমে ট্রফিকে উদ্ধার করতে। তাই চিরতরেই হারিয়ে গেছে প্রথম বিশ্বকাপ ট্রফি।
ফিরে আসা যাক ১৯৬৬ বিশ্বকাপে। সেবার পিকলসের বীরত্বের সঙ্গে সৌভাগ্য যেন ভর করেছিল বিশ্বকাপের স্বাগতিক ইংল্যান্ড দলের কপালেও। আধুনিক ফুটবলের জনক হয়েও চর্ম গোলকের খেলাটিকে নিয়ে গর্ব করতে ইংলিশদের যে ৫২ বছর পূর্বে পিছিয়ে যেতে হয়, তার কারণ ’৬৬এর বিশ্বকাপ। প্রায় দুইশোবছর ভারতবর্ষ শাসন করা আর শতকের পর শতক বিশ্বকে নাচিয়ে বেড়ানো ইংলিশরা কেবল একবারই হাতে পেয়েছিল ফুটবলকে শাসন করার স্বীকৃতচাবি। সেটা এই ১৯৬৬ বিশ্বকাপ জিতেই।
সেমিফাইনাল-ফাইনালে ইংল্যান্ড থাকা মানেই যেন বিতর্ক। যার শুরুটাও ’৬৬ বিশ্বকাপ দিয়েই। ফাইনালে মুখোমুখি স্বাগতিক ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট জার্মানি। নির্ধারিত সময়ে খেলা শেষ ২-২ গোলে। তাতে জিওফ হার্স্টের থেকে এসেছে ১ গোল। খেলা পরে গড়িয়েছে অতিরিক্ত সময়ে।
ম্যাচের ১০০ মিনিটে ইংলিশদের তৃতীয় গোলটি করেন হার্স্ট। মূল্যবান সেই গোলটি নিয়েই যত বিতর্ক। হার্স্টের শট বারে লেগে টুপ করে দাগে বাতাস দিয়ে ফিরে আসলে গোলের বাঁশি বাজান রেফারি। বল গোললাইন পেরিয়েছিল কিনা তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক আছে এখনও। পরে আরেকটি গোল করেন হার্স্ট। তার হ্যাটট্রিকে ৪-২ শিরোপা ঘরে তোলে ইংলিশরা।
বিতর্কের সেখানেই শেষ নয়। ’৬২ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলকে আগেভাগেই গ্রুপপর্ব থেকে তাড়ানোর জন্য উঠেপড়ে লাগে বাকি দলগুলো। বিশেষত পেলেকে আটকানোর বিশেষ পরিকল্পনা ছিল পর্তুগাল, হাঙ্গেরি ও বুলগেরিয়ার। পরিকল্পনা যে সফল রেকর্ডে আছে তার প্রমাণ, গ্রুপপর্ব থেকেই বাদ টানা দুইবার চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। পেলেকে গুরুতরভাবে আহত করা হয়েছে প্রায় প্রতি ম্যাচেই।
আবার এই বিশ্বকাপই সারাজীবন আক্ষেপ হয়ে ছিল এক ফুটবল কিংবদন্তির জন্যও। ইউসেবিও। টুর্নামেন্ট সর্বোচ্চ ৯ গোল করে পর্তুগালকে সেমিফাইনালে তুলেছিলেন। কোয়ার্টার ফাইনালে নর্থ কোরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটি বিশ্বকাপের ইতিহাসে অন্যতম সেরা একটি ম্যাচের তকমা গায়ে লাগিয়ে বসে আছে। প্রথম ২২ মিনিটে ৩ গোলে পিছিয়ে থেকেও ৫-৩ গোলে সেই ম্যাচ জিতে নিয়েছিল পর্তুগিজরা। ইউসেবিও একাই চার গোল করেছিলেন সেই ম্যাচে।
কিন্তু সেমিতে ‘পাখাহীন বিস্ময়’ দুই ববি- মুর ও চার্লটনের গোলে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের কাছে ২-১ ব্যবধানে হেরে স্বপ্নভঙ্গ হয় পর্তুগালের। টুর্নামেন্টে তৃতীয় হয়েছিল পর্তুগিজরা।
লেভ ইয়াসিনের সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে একই ব্যবধানে জিতে ফাইনালের টিকিট কাটে ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের ওয়েস্ট জার্মানি। এরপর তো ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে সেই বিখ্যাত ফাইনালে হেরেই বসে ‘কাইজার’ বেকেনবাওয়ারের দল। অবশ্য সেই বিশ্বকাপে সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়ের পুরষ্কারটা জিতেছিলেন তিনিই।
খেলা হয়েছে মোট আটটি স্টেডিয়ামে। অংশ নেয় ১৬টি দল। বেশিরভাগ দলই ইউরোপ ও সাউথ আমেরিকার। ক্যানকাফ অঞ্চল থেকে খেলেছে কেবল মেক্সিকো। আর এশিয়ার একমাত্র প্রতিনিধি ছিল নর্থ কোরিয়া।
আসরে অংশ নেয়নি আফ্রিকার একটি দলও। এশিয়ার সেরা দলের সঙ্গে কেন প্লে-অফ খেলতে হবে আফ্রিকার সেরা দলকে এমন বিতর্কে ’৬৬ বিশ্বকাপ বয়কট করে একযোগে ৩১টি আফ্রিকান দেশ।
এক নজরে ’৬৬ বিশ্বকাপ
এই বিশ্বকাপেই প্রথম অংশ নেয় পর্তুগাল এবং নর্থ কোরিয়া। আগের আসরগুলোর মতই এ বিশ্বকাপেও অংশগ্রহণকারী দল ছিল ১৬টি। মোট ৪৭ জন ফুটবলার মিলে গোল করেছেন ৮৯টি। যারমধ্যে দুজন আবার নিজেদের জালে বল জড়িয়েছেন, মানে আত্মঘাতী। সর্বোচ্চ গোলদাতা ইউসেবিও, ৯টি! খেলা হয়েছে ৮টি স্টেডিয়ামে।