মাস পেরোনোর আগেই বাজবে রাশিয়া বিশ্বকাপের বাঁশি। ২০টি বিশ্বকাপ পেরিয়ে এসেছে ফুটবল মহাযজ্ঞের যাত্রাপথ। প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল উরুগুয়ে। আগের আসরগুলোর পরতে পরতে ঠাসা রোমাঞ্চকর নানা গল্প। চ্যানেল আই অনলাইনের পাঠকদের ধারাবাহিকভাবে ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে ইতিহাসের ধূলিজমা সেসব পাতায়। আজ থাকছে মেক্সিকো বিশ্বকাপ ১৯৮৬’র কথা-
একজন ম্যারাডোনা যেভাবে মহারথী হলেন, আরেকজন বোগডান ডোচেভের জীবন যেভাবে শেষ হল। অজস্র গল্পগাথার ভিড়ে ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ এই দুটি ঘটনার জন্য বেশি আলোচিত। ম্যারাডোনা নামটি ফুটবল প্রেমিকের কাছে শিহরণ। কিন্তু ওই ডোচেভ নামটি অনেকের কাছেই অপরিচিত।
কোয়ার্টার ফাইনালে ম্যারাডোনা দুটি বহুল আলোচিত গোল করেন, ‘হ্যান্ড অব গড’ আর ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’। প্রথম গোলটি ডোচেভকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে যায়। ওই দিন তিনি ছিলেন লাইন্সম্যান। ওই ম্যাচের পর তার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি সামাজিক জীবনটাও নিঃশেষ হয়ে যায়।
সেদিন যা ঘটেছিল
ডোচেভ মারা গেছেন গত বছর। বেঁচে থাকতে স্ত্রীকে বলে গেছেন সব ঘটনা। ডেইলিমেইল কিছুদিন আগে স্ত্রীর বরাতে আলোচিত সেই ম্যাচের বিস্তারিত তুলে ধরে।
কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ছিল ইংল্যান্ড। ইংলিশরা ২-১ গোলে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয়। দুটি গোলই করেন ম্যারাডোনা।
হাত দিয়ে করা গোলটির পর টিভিতে দেখা যায় মাঠের মূল রেফারি বিন নাসের ধীরে ধীরে গোলের দিকে হেঁটে আসছেন। হাঁটতে হাঁটতে তাকিয়ে আছেন সহকারী ডোচেভের দিকে। কিন্তু ডোচেভ হ্যান্ডবলের নির্দেশ দিয়ে পতাকা ওঠাননি। একদম স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাহলে কি তিনি দেখেননি?
ডোচেভের স্ত্রী এমলি বলছেন, ‘তিনি দেখেছিলেন। কিন্তু অপেক্ষা করছিলেন মূল রেফারির জন্য। তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলতেন যে হাত দিয়ে গোল হয়েছে।’
সমস্যাটা মূলত এখানেই হয়। ম্যাচের আগে প্রধান রেফারি নাসের নাকি ডোচেভকে বলেন, তোমার বেশি কিছু করতে হবে না। মাঠ থেকে আমিই করবো।
ডোচেভের ভাষায়, ‘ওই সময় ফিফার নিয়মটাই অমন ছিল। মাঠের রেফারি জানতে চাইলেই কেবল লাইন্সম্যান ব্যবস্থা নিতে পারতেন।’
কিন্তু বিন নাসের ম্যাচের পর বিপরীত কথা বলেন, ‘নির্দেশনায় আছে মূল রেফারির থেকে সহকারী রেফারি ভালো পজিশনে থাকলে তার সিদ্ধান্তকে আমার সম্মান জানাতে হবে। আমি তাই তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কিন্তু সে নির্বাক ছিল।’
ওই ম্যাচের কারণে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ডোচেভ হতাশায় ভোগেন। স্ত্রীকে বলে যান, ‘আমি রেফারি আর ম্যারাডোনাকে কোনোদিন ক্ষমা করবো না। ম্যারাডোনা ভালো খেলোয়াড় হতে পারে, কিন্তু সে সেদিন আমার খবর খুঁড়েছে।’
আসরের আদ্যোপান্ত
এই বিশ্বকাপটি অনুষ্ঠিত হয় মেক্সিকোয়। কিন্তু সেখানে হওয়ার কথা ছিল না। ’৮৬ সালের বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার কথা ছিল লাতিন আমেরিকার কলম্বিয়ার। কিন্তু নিজেদের অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে বিশ্বকাপ আয়োজনের বেশ আগেই ফিফাকে তারা অপরাগতার কথা জানিয়ে দেয়। এরপর তৎকালীন ফিফা সভাপতি জোয়াও হ্যাভালাঞ্জ নিজের একক ক্ষমতায় কলম্বিয়ার বদলি হিসেবে মেক্সিকোকে বেছে নেন।
ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইতালির বিপক্ষে ১-১ গোলের ড্র দিয়ে সেবার বিশ্বকাপ মিশন শুরু করেছিল আর্জেন্টিনা। ম্যারাডোনার পা থেকে এসেছিল সমতাসূচক গোলটি। পরে আর পেছনে তাকাতে হয়নি আলবিসেলেস্তাদের।
এই বিশ্বকাপের বিস্ময় ছিল ডেনমার্ক। মাইকেল লাউড্রপ প্রেবেন এবং এলজায়ের লারসেন নামের দুই তারকা দারুণভাবে জ্বলে ওঠেন। প্রথম রাউন্ডে উরুগুয়েকে ৬-১ গোলে উড়িয়ে দেয় তারা। তবে দ্বিতীয় রাউন্ডের নকআউট পর্বে দলটি হেরে যায় স্পেনের কাছে, ৫-১ গোলে।
’৮২-র মতো ’৮৬-র বিশ্বকাপও ২৪ দেশের আয়োজন হলেও মেক্সিকো বিশ্বকাপে ফরম্যাটে আমূল পরিবর্তন আসে। বিশ্বকাপ লড়াই পরিবর্তিত ফরম্যাটের কারণে হয়ে ওঠে আরও বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। ২৪টি দলকে সেবারও ছয় গ্রুপে ভাগ করা হয়েছিল প্রথমপর্বে। তবে দ্বিতীয়পর্ব গ্রুপ লড়াইয়ের বদলে হয়ে ওঠে দারুণ আকর্ষণীয় এক ‘নক আউট’ রাউন্ড। প্রথম পর্বের ছয় গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ ছাড়াও নক আউট পর্বে সেবার সুযোগ পায় আরও চারটি ‘সেরা তৃতীয়’ দল। মোট ১৬টি দলের দ্বিতীয় পর্ব থেকে আটটি বাদ পড়ার পর বাকি আটটিকে নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় কোয়ার্টার ফাইনাল। কোয়ার্টার ফাইনালের চার বিজয়ী খেলে সেমিতে।
দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে বাদ পড়ে ফেভারিটদের তালিকায় থাকা সোভিয়েত ইউনিয়ন। তারা সবাইকে অবাক করে ৪-৩ গোলে হেরে যায় বেলজিয়ামের কাছে। আর্জেন্টিনা, স্পেন, বেলজিয়াম ছাড়াও দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠা বাকি পাঁচটি দেশ হল ব্রাজিল, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, মেক্সিকো ও পশ্চিম জার্মানি।
ব্রাজিল ৪-০ গোলে পোল্যান্ডকে, ইংল্যান্ড ৩-০ গোলে প্যারাগুয়েকে এবং ফ্রান্স ২-০ গোলে ইতালিকে হারায়। মরক্কোকে ১-০ গোলে হারিয়ে টিকে থাকে পশ্চিম জার্মানি।
কোয়ার্টার ফাইনাল চারটির মধ্যে তিনটিরই নিষ্পত্তি হয় টাইব্রেকারে। এরমধ্যে আছে ব্রাজিল-ফ্রান্সের সেই আলোচিত ম্যাচটি। নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময়ে ১-১ গোলে অমীমাংসিত সেই খেলায় জিকো-সক্রেটিসের টাইব্রেকার মিসের কারণে ব্রাজিল বাদ পড়ে যায়।
হাত দিয়ে গোলা করার ম্যাচে ম্যারাডোনার পা থেকেও আসে অসাধারণ এক গোল। প্রায় মাঝ মাঠ থেকে বল নিয়ে পাঁচজন ইংলিশ খেলোয়াড়কে কাটিয়ে করা ম্যারাডোনার সেই গোলটি স্থান পেয়েছে শতাব্দীর সেরা গোলে হিসেবেই। ইংল্যান্ডকে কাঁদিয়ে ওই ম্যাচ আর্জেন্টিনা জিতে নেয় ২-১ গোলে। স্বাগতিক মেক্সিকোও কোয়ার্টার ফাইনালে টাইব্রেকার-দুর্ভাগ্যে পড়ে। পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে সেই ম্যাচটি নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময়ে ছিল গোলশূন্য। টাইব্রেকারে স্বাগতিকেরা হেরে যায় ৪-১ গোলে। অপর কোয়ার্টারে বেলজিয়ামের কাছে হেরে যায় স্পেন। সেই ম্যাচটির ফলও নির্ধারিত হয় টাইব্রেকারে।
সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনার কাছে ২-০ গোলে হারে বেলজিয়াম। দুটি গোলই করেন ম্যারাডোনা। মিশেল প্লাতিনির ফ্রান্সও ২-০ গোলে হেরে যায় পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে। জার্মানির পক্ষে গোল করেন আন্দ্রেস ব্রেইমে ও রুডি ফোলার।
যেমন ছিল ফাইনাল
২৩ মিনিটেই ব্রাউনের গোলে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। ৫৫ মিনিটে ভালদানোর গোলে যখন মনে হচ্ছিল আর্জেন্টিনার শিরোপা প্রায় নিশ্চিত ঠিক তখনই মাত্র ছয় মিনিটের (৭৪ ও ৮০ মিনিট) ব্যবধানে কার্ল হেইঞ্জ রুমেনিগে ও রুডি ফোলারের দুই গোলে খেলায় দারুণভাবে ফিরে আসে পশ্চিম জার্মানি। তবে ২-২ সমতার পর ম্যাচের ৮৩ মিনিটে বুরুচাগার গোলে দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা।
এক নজরে ১৯৮৬ বিশ্বকাপ
চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা। মোট দল ২৪টি। সুযোগ হয়নি নেদারল্যান্ডসের। সবাইকে অবাক করে সুযোগ পায় কানাডা এবং ইরাক। ৬ গোল করে গোল্ডেন বুট জেতেন গ্যারি লিনেকার। গোল্ডেন বল জেতেন ম্যারাডোনা। ৫২ ম্যাচে গোল হয় ১৩২টি।