মাস পেরোনোর আগেই বাজবে রাশিয়া বিশ্বকাপের বাঁশি। ২০টি বিশ্বকাপ পেরিয়ে এসেছে ফুটবল মহাযজ্ঞের যাত্রাপথ। প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল উরুগুয়ে। আগের আসরগুলোর পরতে পরতে ঠাসা রোমাঞ্চকর নানা গল্প। চ্যানেল আই অনলাইনের পাঠকদের ধারাবাহিকভাবে ফিরিয়ে নেয়া হবে ইতিহাসের ধূলিজমা সেসব পাতায়। আজ থাকছে সুইজারল্যান্ড বিশ্বকাপ ১৯৫৪’র কথা-
সব লাল পাথর যেমন চুনি হতে পারে না; তেমনি আরাধ্য সোনার ট্রফিটা উঁচিয়ে অনেক কিংবদন্তিরও বলা হয়নি, ‘আজ আমরা বিশ্বসেরা।’ তাদেরই একজন হাঙ্গেরির ফেরেঙ্ক পুসকাস। ফাইনালে ‘মিরাকল অব বার্ন’ দেখে এমন একটা দলের কাছে তাদের হারতে হয়, যাদের বিশ্বকাপই খেলার কথা ছিল না!
ফিরে দেখা: বিশ্বকাপ-১৯৩০, বিশ্বকাপ-১৯৩৪, বিশ্বকাপ-১৯৩৮, বিশ্বকাপ-১৯৫০।
বিশ্বযুদ্ধের আঘাতে ওয়েস্ট জার্মানি তখন দিশেহারা। শহরের রাস্তায়, পাড়া-মহল্লায় বোমার আঘাতের দাগ। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স আর রাশিয়া চার ভাগে ভাগ করে নিয়েছে তাদের। মৌলিক অধিকার যখন তাদের কাছে দূর আকাশের তারা, তখন বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার সাহস জার্মানদের জন্য পৃথিবী জয়ের মতোই ব্যাপার ছিল। ১৯৫০ সালে সুযোগ না পেয়ে জার্মানরা আরও হতাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু পরের বছর তাদের সামনে বিশ্বকাপ দুয়ার খুলে যায়। তখনও জার্মানিতে ফুটবল মানে শখের ব্যাপার। পেশাদার কোনো ক্লাব নেই, নেই শক্তিশালী অবকাঠামো। পারিশ্রমিক ছাড়াই কেউ কেউ তবু খেলাটা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাদের নিয়েই কোনোমতে বাছাইপর্ব উতরে বিশ্বকাপে যায় দলটি। ফাইনালে হারিয়ে দেয় সর্বকালের অন্যতম সেরা দল ৫৪’র হাঙ্গেরিকে!
টানা তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখে আর্জেন্টিনা। ব্রাজিল অন্যতম ফেভারিট হলেও পুসকাসের হাঙ্গেরি তখন অপ্রতিরোধ্য। টানা চার বছর ৩২টি ম্যাচে তারা অপরাজিত। বিশ্বকাপের আগে পত্রপত্রিকায় তাদের বীরত্বের কথা প্রকাশিত হতে থাকে। বিশ্বকাপের আগের বছর দ্য গার্ডিয়ান এক বিশেষ প্রতিবেদনে লিখেছিল, ‘চন্দ্র, সূর্য, গ্রহতারা যেমন সত্য, তেমনি সত্য পুসকাসের এই হাঙ্গেরির নিখুঁত ফুটবল। তাদের স্পিড, বল কন্ট্রোল এবং পজিশনাল ফুটবল দেখতে পারাটা স্বপ্নের মতো ব্যাপার।’
গ্রুপ পর্যায়ে সেই হাঙ্গেরি কোরিয়াকে ৯-০তে হারানোর পাশাপাশি জার্মানিকে ৮-৩ গোলে উড়িয়ে দেয়। জার্মানদের বাদ পড়ার মতো অবস্থা হয়ে যায়। ‘জার্মানরা মরার আগে মরে না’ -এই তেজ আর প্রজ্ঞা তারা ফুটবলে টেনে আনে। তুরস্কের সঙ্গে প্লে-অফ খেলে ৭-২ গোলের জয় নিয়ে পরের রাউন্ড নিশ্চিত হয় তাদের। শেষ আটে ব্রাজিল, হাঙ্গেরি, উরুগুয়ে, ইংল্যান্ডের সঙ্গে যোগ দেয় জার্মানি।
প্রাক্তন চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে এবং ব্রাজিলকে উড়িয়ে হাঙ্গেরি ফাইনালে চলে আসে। তাতে কোনো বিস্ময় নেই। পুসকাসরা ফাইনালে না আসলে বরং বিস্ময়ের প্রসঙ্গ উঠত। ফুটবল দুনিয়া বিস্মিত হয় ফাইনালের অন্য দল জার্মানিকে দেখে।
ফাইনাল: ‘মিরাকল অব বার্ন’
১৯৫৪ সালের ৪ জুলাই। সুইজারল্যান্ডের আকাশে বৃষ্টির ঘনঘটা। সেই বৃষ্টিতে জার্মানির ফুটবলারদের কিছুটা সুবিধা হয়। কিন্তু ম্যাচের শুরুটা ছিল হাঙ্গেরির পক্ষে। ফিটনেসের কারণে মাঝখানে দুই ম্যাচ না খেলা পুসকাস ফাইনালে ফিরেছিলেন। তার ফিটনেস নিয়ে হাঙ্গেরির তাই চিন্তা ছিল। কিন্তু মাঠে নামার ছয় মিনিটের মাথায় গোল করে সব চিন্তা উড়িয়ে দেন পুসকাস। আট মিনিটের সময় ব্যবধান ২-০ করেন জোলটান। দশম মিনিটে জার্মানির ম্যাক্স মরলক ব্যবধান ২-১ করেন। ১৮তম মিনিটে সমতায় ফেরান হেলমুট র্যান। ব্যবধান ২-২ হওয়ার পর হাঙ্গেরি মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু তাদের সব আক্রমণ ফিরিয়ে দিতে থাকে জার্মানি। ম্যাচ শেষ হওয়ার ৬ মিনিট আগে নিজের দ্বিতীয় এবং দলের তৃতীয় গোলটি করেন ওই র্যান। শেষ বাঁশি পর্যন্ত জার্মান-প্রাচীরের কাছে মাথানত করতে হয় এক কিংবদন্তির দলকে। সেদিন বার্নের ওয়াঙ্কড্রফ স্টেডিয়ামে যে মিরাকল লেখা হয়, তা আজও বিস্ময়ের ঝড় তোলে ফুটবলপ্রেমীর হৃদয়ে।
ফাইনালে জার্মানি থেকে ধারাভাষ্যকক্ষে ছিলেন কিংবদন্তি হারবার্ট জিমেরম্যান। দেশের বিজয়ের মুহূর্তে তার বলা কথা আজও জার্মানিতে লোকগাথা হয়ে আছে। তৃতীয় গোলের পর তিনি সহকর্মীর কাছ থেকে মাইক্রোফোন কেড়ে নিয়ে বলে ওঠেন, ‘দৃষ্টি আজ সীমানা ছাড়িয়ে! সীমানা ছাড়িয়ে! সীমানা ছাড়িয়ে! সবটাই জার্মানির জন্য।’ শেষ বাঁশির পর পেশাদারিত্বের শেকল ছিন্ন করে ফের বলেন, ‘৩-২ ব্যবধানে জিতেছে জার্মানি। আমি আজ পাগলপারা! আমাকে তোমরা পাগল বলে দাও!’
গোলবন্যার বিশ্বকাপ
৫৪’র বিশ্বকাপে যে হারে গোল হয়েছিল তা বিশ্বকাপের ইতিহাসে বিরল। ম্যাচপ্রতি গড় গোল ৫.৩৮। এক দলের সবচেয়ে বেশি গোলও দেখেছিল ওই বিশ্বকাপ, হাঙ্গেরি মোট ২৭টি গোল দিয়েছিল। দলগতভাবে ম্যাচপ্রতি সবচেয়ে বেশি গোলের গড় হাঙ্গেরির, ৫.৪। চ্যাম্পিয়নদের এক টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বেশি গোল, জার্মানির ২৫টি। সবচেয়ে বেশি গোল খেয়েও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার নজির জার্মানির। তারা ১৪টি গোল হজম করেছিল। এক ম্যাচে দুই দল মিলে সবচেয়ে বেশি গোল হয় ওই বিশ্বকাপে, অস্ট্রিয়া ৭-সুইজারল্যান্ড ৫। সবচেয়ে বেশি গোলের ব্যবধানে জয় আসে হাঙ্গেরি (৯) দক্ষিণ কোরিয়া (০) ম্যাচে।
এক নজরে ১৯৫৪ বিশ্বকাপ
আয়োজক: সুইজারল্যান্ড, ১৬ জুন- ৪ জুলাই। চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট জার্মানি। রানার্সআপ হাঙ্গেরি। তৃতীয় অস্ট্রিয়া। চতুর্থ উরুগুয়ে। মোট দল ১৬টি। মোট ম্যাচ ২৬টি। মোট গোল ১৪০টি। সর্বোচ্চ গোল করেন সান্দোর কোকসিস (হাঙ্গেরি), ১১টি। গোল্ডেন বল পান পুসকাস (হাঙ্গেরি)। গোল্ডেন গ্লাভস জেতেন গুয়েলা গ্রসিকস (হাঙ্গেরি)। গোল্ডেন বুট সান্দোর কোকসিস’র (হাঙ্গেরি)।