মাস পেরোনোর আগেই বাজবে রাশিয়া বিশ্বকাপের বাঁশি। ২০টি বিশ্বকাপ পেরিয়ে এসেছে ফুটবল মহাযজ্ঞের যাত্রাপথ। প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল উরুগুয়ে। আগের আসরগুলোর পরতে পরতে ঠাসা রোমাঞ্চকর নানা গল্প। চ্যানেল আই অনলাইনের পাঠকদের ধারাবাহিকভাবে ফিরিয়ে নেয়া হবে ইতিহাসের ধূলিজমা সেসব পাতায়। আজ থাকছে সুইডেন বিশ্বকাপ ১৯৫৮’র কথা-
এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তোর নামে কাউকে চেনেন? কেউ কেউ চিনে থাকতে পারেন। আবার নামটা কারো কারো কাছে অপরিচিতও হতে পারে। ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপের পর এই নামের ১৭ বছরের বালকটি বিশ্ববাসীর কাছে ‘পেলে’ নামে পরিচিতি পান। অথচ তিনি নিজে ধারণাও করেননি ওই বয়সে বিশ্বকাপ খেলবেন। একটি জাতিকে প্রথমের উদযাপনে কাঁদাবেন।
ফিরে দেখা: বিশ্বকাপ-১৯৩০, বিশ্বকাপ-১৯৩৪, বিশ্বকাপ-১৯৩৮, বিশ্বকাপ-১৯৫০, বিশ্বকাপ-১৯৫৪
সম্প্রতি একটি তথ্যচিত্রে পেলে নিজেই বলেন সেই দিনটির কথা, যেদিন বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পাওয়ার খবর প্রথম শোনেন। তথ্যচিত্রের বরাত দিয়ে দ্য সান তাদের এক খবরে জানায়, সেদিন পেলের বাবা রেডিওতে দল ঘোষণার খবর শুনছিলেন। হঠাৎ তার কানে ছেলের নাম আসে। তিনি কিছুটা অবাক হন। কিছুক্ষণ বাদে প্রতিবেশীরা উল্লাস করতে করতে বাড়ি চলে আসেন। সবকিছু শুনে বাবার মতো পেলেও মনে করেন, হয়তো ভুল করে তার নামটি ঘোষিত হয়েছে!
সন্ধ্যা হওয়ার আগেই অবশ্য পেলের ভুল ফুল হয়ে ফুটতে শুরু করে। পেলে নিশ্চিত হয়ে যান, পৃথিবী তাকে ডাকছে।
যেভাবে ফাইনালে ব্রাজিল
৫৮ সালের বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিল আগের তিনবার নিজেদের সরিয়ে রাখা আর্জেন্টিনা। তাদের ফেরাটা সুখকর হয়নি। তিন ম্যাচে ১০ গোল হজম করে ফিরতে হয়েছিল দেশে। সোভিয়েত ইউনিয়ন সেবারই প্রথম বিশ্বকাপে মাঠে নামে। এই বিশ্বকাপ প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিকভাবে টেলিভিশনে প্রচারিত হয়।
১৯৫০ সালের পুসকাসের হাঙ্গেরির মতো এই বিশ্বকাপে ফন্টেইন তার ফ্রান্সকে নিয়ে রীতিমতো উড়ছিলেন। প্যারাগুয়ের বিপক্ষে হ্যাটট্রিকসহ গ্রুপ পর্বের তিন ম্যাচেই ৬ গোল করেন ফন্টেইন। গ্রুপে দ্বিতীয় হওয়া যুগোস্লাভিয়া ফ্রান্সকে ৩-২ গোলে হারিয়ে দিলেও ফ্রান্স ফেভারিট ছিল। এর ভেতর প্লে-অফে ওয়েলসের বিপক্ষে হেরে হাঙ্গেরি গ্রুপ পর্বেই বিদায় নেয়।
কোয়ার্টার ফাইনালেও ফ্রান্সের ফন্টেইন অপ্রতিরোধ্য ছিলেন। উত্তর আয়ারল্যান্ডকে চার গোল দিয়ে সেমিফাইনালে চলে আসে ফ্রান্স।
একদিকে ফ্রান্সের আধিপত্য, অন্যদিকে ব্রাজিলও দারুণ খেলছিল। কিন্তু এই পর্যন্ত পেলের দেখা ছিল না। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে বিশ্বকাপ অভিষেক হয় পেলের। অভিষেকে তিনি সেভাবে কিছু করতে পারেননি। তবে ড্রিবলিং আর গতি দেখিয়ে ঠিকই কোচের মন জয় করেন। টিকে যান নকআউট ম্যাচের একাদশে।
নকআউটে ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ ছিল ওয়েলস। প্রথমার্ধ গোলশূন্য থাকার পর দ্বিতীয়ার্ধের অনেকটা সময় ব্রাজিল গোল পাচ্ছিল না। জ্বলে উঠলেন ১৭ বছরের ছেলেটি। ৬৬ মিনিটে ম্যাচের একমাত্র গোল করে দলকে সেমিতে নিয়ে যান। সেমিতে পেলে হ্যাটট্রিক করে বসেন।
প্রথম সেমিফাইনালে পশ্চিম জার্মানিকে ৩-২ গোলে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে স্বাগতিক সুইডেন। দ্বিতীয় সেমিফাইনালে পেলের হ্যাটট্রিকে ফ্রান্সকে ৫-২ গোলে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে ব্রাজিল।
বালকবীর পেলে ফাইনালেও ঝড় তোলেন। স্বাগতিক সুইডেনের বিপক্ষে জোড়া গোল করেন। ব্রাজিল জেতে ৫-২ গোলে। ইউরোপে আয়োজিত বিশ্বকাপে আমেরিকা মহাদেশের কোনো দলের সেটাই প্রথম শিরোপা।
যেমন ছিল ফাইনাল
২৯ জুন অনুষ্ঠিত ফাইনালে ৪ মিনিটের মাথায় পিছিয়ে পড়ে ব্রাজিল। সুইডেনকে এগিয়ে দেন নিলস লিডহম । ব্রাজিলকে সমতায় ফেরান ভাভা, ৯ মিনিটের মাথায়। ৩২তম মিনিটে তিনি ব্যবধান ২-১ করেন। এগিয়ে থেকে বিরতিতে যায় ব্রাজিল। দ্বিতীয়ার্ধে পেলে শো। দারুণ সব আক্রমণে সঙ্গ দিয়ে সুইডেনকে তিনি কাঁপিয়ে দেন। ৫৫তম মিনিটে ব্যবধান ৩-১ করেন। মারিও জাগালো ৬৮ মিনিটের সময় ব্রাজিলের হয়ে চতুর্থ গোল করেন।
৮০ মিনিটের সময় সুইডেনের সিমনসন আরেকটি গোল করলেও ম্যাচে ফেরা হয়নি তাদের। পেলে ৯০ মিনিটের সময় নিজের দ্বিতীয় গোল করে ব্যবধান ৫-২তে নিয়ে যান। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জেতে ব্রাজিল। সতেরো বছরের বিস্ময়-বালক পেলে হয়ে যান বিশ্বকাপজয়ী দলের কনিষ্ঠতম সদস্য, বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল করা কনিষ্ঠতম ফুটবলারও।
অন্যদিকে ম্যাচের প্রথম গোল করে সুইডেন দলের নিলস লিডহম ফাইনালে গোল করা জ্যেষ্ঠতম খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি পান। দুই দল মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি গোল হওয়া ফাইনালের রেকর্ডও ওই ম্যাচটি।
সব রেকর্ড মলিন করে ৫৮’র বিশ্বকাপ হয়ে আছে দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা এক মহাতারকার আবির্ভাবের বিশ্বকাপ।
ফর্মেশনে ব্রাজিলের বৈপ্লবিক কৌশল
এই আসরে ব্রাজিল প্রথম ৪-২-৪ ফর্মেশনের সঙ্গে বিশ্বকে পরিচিত করায়। সেই সময়ে এই ধরনের ফর্মেশন অদ্ভুত তো বটেই, অনেকটা চোখ কপালে তোলার মতো ব্যাপার ছিল।
দুইজন সেন্টার ফরোয়ার্ড। যাদের সঙ্গ দিতেন দুই উইঙ্গার। মাঝে মাঠের উপরে চারজন আক্রমণভাগের খেলোয়াড় থাকায় প্রতিপক্ষ দল শুরু থেকেই রক্ষণাত্মক মুডে চলে যেত।
অন্যদিকে ব্রাজিলের ডিফেন্সে চারজন পজিশন নিলেও এই ফর্মেশনকে কোনোভাবেই ডিফেন্সিভ বলা চলে না। কেননা রক্ষণ সামলে দুইজন ডিফেন্ডার হরহামেশা সামনের দুই উইঙ্গারের সঙ্গে যোগ দেন। এভাবে ফর্মেশনটি ২-৪-৪ হয়ে যেত, যখন বল থাকতো ব্রাজিলের পায়ে। অন্যদিকে প্রতিপক্ষ আক্রমণে আসলেই দুইজন আউটসাইড ডিফেন্ডার নিচে নেমে রক্ষণে মন দিতেন। উইং থেকে দুজন মিডফিল্ডে। ব্রাজিল এভাবে খেলে সাফল্য পাওয়ার পর থেকে অনেক দল ৪-২-৪ ফর্মেশনে খেলা শুরু করে।
এক নজরে ৫৮’র বিশ্বকাপ
মোট দল ১৬টি। সর্বাধিক গোলদাতা জাস্ট ফন্টেইন, ১৩টি। মোট ম্যাচ ৩৫টি। মোট গোল ১২৬টি। ম্যাচপ্রতি গড় গোল ৩.৬০। সর্বাধিক গোলের ম্যাচ ফ্রান্স (৭) উরুগুয়ে (৩)। মোট দর্শক ৮৬৮, ০০০।
ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট
ফন্টেইন ১৩টি গোল করলেও টুর্নামেন্ট সেরা হয়ে যান চমক দেখানো পেলে! পেলে ছয়টি গোল করেন।