চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ব্রাজিলের ‘ড্রিম টিম’ ও প্রথম রঙিন বিশ্বকাপ

মাস পেরোনোর আগেই বাজবে রাশিয়া বিশ্বকাপের বাঁশি। ২০টি বিশ্বকাপ পেরিয়ে এসেছে ফুটবল মহাযজ্ঞের যাত্রাপথ। প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল উরুগুয়ে। আগের আসরগুলোর পরতে পরতে ঠাসা রোমাঞ্চকর নানা গল্প। চ্যানেল আই অনলাইনের পাঠকদের ধারাবাহিকভাবে ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে ইতিহাসের ধূলিজমা সেসব পাতায়। আজ থাকছে মেক্সিকো বিশ্বকাপ ১৯৭০’র কথা-

কিংবদন্তি পেলের শেষ বিশ্বকাপ। পেলের সঙ্গে টোস্টাও, জারজিনহো, রিভেলিনো, ক্লডোয়াল্ডো, গারসন, রবের্তো, পাউলো সিজার, জোয়েল, পিয়াজ্জা, মার্কো অ্যান্টনিও, ফন্টানা, ডারিও, অধিনায়ক কার্লোস আলবার্তো; নামগুলোই বলে দিচ্ছে ধারে-ভারে তারা কতটা কাটতে জানেন প্রতিপক্ষকে। টুর্নামেন্টের শুরু থেকে শেষঅবধি তারা প্রতিপক্ষকে কাটা-ছেড়ার কাজটা করেছিলেন সূচারুভাবেই। পেয়েছিলেন ব্রাজিলের ‘ড্রিম টিমে’র তকমা। তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জিতে জুলে রিমে ট্রফিটা চিরতরেই নিয়ে ফিরেছিলেন সাম্বার দেশে।

ফিট থাকতে সবার আগে চিনি বাদ দিন, প্রাকৃতিক ও নিরাপদ জিরোক্যাল-এর মিষ্টি স্বাদ নিন।

ফিরে দেখা: বিশ্বকাপ-১৯৩০বিশ্বকাপ-১৯৩৪বিশ্বকাপ-১৯৩৮বিশ্বকাপ-১৯৫০, বিশ্বকাপ-১৯৫৪,

বিশ্বকাপ-১৯৫৮, বিশ্বকাপ-১৯৬২বিশ্বকাপ-১৯৬৬

সেলেসাওদের ফুটবল-শৈলীর ওই বিশ্বকাপ আরও একটি কারণে আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিল। ফুটবলপ্রেমী টেলিভিশনদর্শকদের সামনে বিশ্বব্যাপী প্রথমবারের মতো রঙিন-দৃশ্যে সম্প্রচারিত হয়ে মেক্সিকোর মহাযজ্ঞ আক্ষরিক অর্থেই পেয়েছিল প্রথম রঙিন বিশ্বকাপের তকমা। রেকর্ড গড়েছিল দর্শকসংখ্যাতেও। আর দর্শক ও খেলোয়াড়রা দেখেছিলেন হলুদ-লাল কার্ডের জামানা শুরুর ক্ষণ। এই বিশ্বকাপের ফাইনালে প্রথমবার ব্যবহারের অনুমতি মেলে লাল-হলুদ কার্ডের।

প্রতিপক্ষের গোলের সামনে হামলে পড়া ব্রাজিল

তবে কেবল রঙিন-দৃশ্যে সম্প্রচারিত হওয়ার কারণেই নয়, ১৯৭০ বিশ্বকাপ রঙিন হয়ে উঠেছিল মনকাড়া ফুটবলশৈলীর প্রদর্শনী দিয়েই। কয়েকটি ম্যাচ নিয়ে তো রূপকথার মতো গল্পচর্চা হয় আজঅবধি।

ইউরোপ ও সাউথ আমেরিকার বাইরে হওয়া প্রথম বিশ্বকাপ ছিল সেটি। নর্থ আমেরিকায় প্রথমবার। ৩১মে থেকে ২১জুন, ফিফার নবম বিশ্বযজ্ঞ। মাঠে খেলা গড়ানোর আগে থেকেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল পরিবেশ। স্বাগতিক মেক্সিকোর আবহাওয়া তখন অস্বাভাবিক উষ্ণতায় ডোবা। মাঠে বল গড়ানোর পর অবশ্য পারিপার্শ্বিক সব আলোচনাই উধাও।

মেক্সিকো বিশ্বকাপের উত্তাপটা টের পাওয়া যেতে থাকে ১৯৬৮ থেকেই। দুবছরের বাছাইপর্ব, ঘটন-অঘটনে ঠাসা। যুদ্ধপর্যন্ত লেগে গিয়েছিল বাছাইপর্বের ম্যাচ ঘিরে। ছয় মহাদেশের ৭৫ দল শুরুতে আগ্রহ দেখায়। অংশগ্রহণ-প্রত্যাখ্যানের ধাঁধা চলে সেবারও, শেষপর্যন্ত বাছাইয়ে আসে ৬৮ দল। সেখান থেকে চূড়ান্ত পর্বে যায় ১৪ দল। স্বাগতিক মেক্সিকো ও ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে নিয়ে পূর্ণ হয় মূলপর্বের ১৬ দল।

এল সালভাদর, মরক্কো ও ইসরায়েল প্রথমবার বিশ্বমঞ্চে আসে। হন্ডুরাসকে প্লে-অফে হারিয়ে আসে এল সালভাদর। সেই ম্যাচের প্রভাবে দুদেশের মধ্যে যুদ্ধই লেগে যায়। চারদিন স্থায়ী হয় ১৯৬৯ সালের জুলাইয়ে ১০০ ঘণ্টার সেই ফুটবল যুদ্ধ। ইতিহাস যাকে ফুটবলযুদ্ধ বা সকারযুদ্ধ নামেই চিহ্নিত করে রেখেছে। আর আগের আসরের কোয়ার্টার ছোঁয়া নর্থ কোরিয়া ডিসকোয়ালিফাই হয় রাজনৈতিক কারণে ইসরায়েলের সঙ্গে বাছাই না খেলায়।

আর্জেন্টিনা সেবার কোয়ালিফাই-ই করতে পারেনি। ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, ১৯৬৬ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালিস্ট পর্তুগাল এবং স্পেনও একই পথে। ইউরোপ থেকে ৮টি, কনমেবল থেকে ৩ এবং আফ্রিকা, এশিয়া/ওশেনিয়া, কনক্যাকাফ থেকে বাছাই পেরিয়ে আসে একটি করে দল।

ফুটবল ইতিহাসের নানা বাঁক ছোঁয়া মেক্সিকো বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচ ইতিহাসে নাম লেখায় অন্য এক রেকর্ডের মাধ্যমেও। প্রথমবারের মতো বদলি খেলোয়াড়ের দেখা পায় ফুটবল ইতিহাস। মেক্সিকো ও সোভিয়েত ইউনিয়নের উদ্বোধনী গোলশূন্য ড্রয়ের ম্যাচে দ্বিতীয়ার্ধে বদলি হিসেবে মাঠে নামেন সোভিয়েতের অ্যানাতোলি পুজাচ।

ফাইনালের আগে দুদল

গ্রুপ-১ থেকে দুটি করে জয়, একটি করে ড্র নিয়ে শেষ আটের টিকিট কাটে মেক্সিকো ও সোভিয়েত। গ্রুপ-২ থেকে উঠে আসে ইতালি ও উরুগুয়ে। মজার ব্যাপার, গ্রুপ সেরা ইতালি কেবল একটি গোল করে সেরা আটের টিকিট কাটে, কোনো গোল অবশ্য খায়নি তখনকার দুবারের চ্যাম্পিয়ন দলটি। চার নম্বর গ্রুপ থেকে সেরা আটে আসে জার্ড মুলারের ওয়েস্ট জার্মানি ও পেরু।

তৃতীয় গ্রুপে নজর ছিল সবার। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড ও পেলের ব্রাজিল এ গ্রুপের হিসাব মেলাতে ব্যস্ত। ব্রাজিলের সর্বকালের সেরা বিশ্বকাপ দল হিসেবে স্বীকৃত দলটিই অবশ্য গ্রুপসেরা হয়। ব্রাজিল চেকোস্লোভাকিয়াকে হারায় ৪-১ গোলে, রোমানিয়ার বিপক্ষে জেতে ৩-২এ, আর আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকা ইংলিশদের হারায় ১-০তে। মহামূল্যবান গোলটি আসে জারজিনহোর থেকে। ব্রাজিলের পাশাপাশি সেবার মনোরঞ্জন আর শিহরণ জাগানো ফুটবল খেলছিল অধিকাংশ দলই।

লড়াই কোয়ার্টারে গড়ানোর সঙ্গে উত্তাপের পারদ চড়ে যায়। বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম সেরা নকআউট রাউন্ড হিসেবে খ্যাত হয়ে আছে যেটি। নকআউটের প্রথম ম্যাচে নামে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও উরুগুয়ে, নির্ধারিত সময় পেরিয়ে অতিরিক্ত সময়ে গড়িয়েছে খেলা, সেটিও প্রায় শেষের পথে। ১১৭ মিনিটে ভিক্টর রোডল্ফো এসপারাজো ত্রাতা হয়ে আসেন, উরুগুইয়ানদের সেমির আনন্দে ভাসান।

প্রথম রাউন্ডে গোলের জন্য হাঁসফাঁস করা ইতালি অবশ্য স্বাগতিক মেক্সিকোর যাত্রাভঙ্গ করেছিল ৪-১ গোলে উড়িয়েই। গঞ্জালেসের আত্মঘাতী গোলে ওই বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম গোলটি হজম করতে হয়েছিল ইতালিকে।

১৯৬৬ বিশ্বকাপের ফাইনালে ওয়েস্ট জার্মানিকে হারিয়ে আজ পর্যন্ত একমাত্র শিরোপার স্বাদ নেয়া ইংল্যান্ড সেবার জার্মানির মুখোমুখি হয় কোয়ার্টারেই। মাঠের খেলাতে প্রতিশোধস্পৃহা ধরে রেখে লড়ে যায় জার্মানি, ইংল্যান্ড তখন আরও গোছানো, ছেড়ে কথা বলার নয়! রোমাঞ্চ ছড়ানো সেই ম্যাচটি অতিরিক্ত সময়ের গোলে জিতে নেয় জার্মানরা। ৩-২ গোলে জেতা ম্যাচে মহামূল্যবান জয়সূচক গোলটি করেন জার্ড মুলার, ম্যাচের ১০৮ মিনিটে। ২-০তে পিছিয়ে পড়ার পর বেকেনবাওয়ারের ৬৮ মিনিটের গোলে লড়াইয়ে ফিরে, ৮২ মিনিটে সেলারের গোলে সমতা টানার পর শেষ আঁচর দেন মুলার।

উল্লাসের কেন্দ্রে পেলে

নকআউটে উড়তে থাকা ব্রাজিলের ম্যাচের দিকে নজর ছিল সবার, প্রতিপক্ষ নিজ মহাদেশের পেরু। মাঠের লড়াইয়ে ৪-২ গোলে জিতে সেমির টিকিট কাটে সেলেসাওরাই। ছয় গোলের ম্যাচে পেলে জাল খুঁজে পাননি। তবে রিভেলিনো, টোস্টাও ছিলেন। দুবার এগিয়ে যাওয়ার পর দুবারই সমতা ফিরিয়েছিল পেরু। ৭৫ মিনিটে জারজিনহো উল্লাসে মাতালে আর ব্রাজিলকে ধরতে পারেনি গ্যালার্ডো-কুবিলাসদের দল।

প্রথম সেমিতেই উরুগুয়ের বিপক্ষে পরীক্ষায় নামে ব্রাজিল। মাঠের ফুটবলে আগ্রাসী আর শৈল্পিকতা ছড়িয়ে প্রত্যাশার পারদ ততদিনে মহাকাশছোঁয়া মাত্রায় টেনে নিয়েছে হলুদ জার্সিধারীরা। সেমিতেও রুদ্ধশ্বাস ফুটবলে দর্শক মাতিয়েছে ব্রাজিল। ১৯ মিনিটে কুবিল্লার গোলে এগিয়ে যায় উরুগুয়েই। এরপর শুধু পাল্টা আঘাত। জারজিনহো, রিভেলিনো, ক্লডোয়াল্ডোরা ব্যতিব্যস্ত করে রাখেন প্রতিপক্ষ রক্ষণকে, একের পর এক আক্রমণ শানিয়ে। ৪৪ মিনিটে ক্লডোয়াল্ডোর সমতা ফেরানোর মধ্য দিয়ে শুরু, ৭৬ মিনিটে জারজিনহো আর ৮৯ মিনিটে রিভেলিনো; ফাইনালের টিকিট পেয়ে যায় ব্রাজিল।

ইতালি-জার্মানির আরেক সেমির লড়াইকে তো বিশ্বকাপ ইতিহাসেরই অন্যতম স্মরণীয় ম্যাচের তালিকায় ওপরের দিকে রাখা হয়। আট মিনিটেই এগিয়ে যাওয়া ইতালি গোল হজম করে ৯০ মিনিটে এসে, অন্তিম মিনিটে শ্লেলিঞ্জার সমতা ফেরানোর পর বাকিটা জার্মান রূপকথা। রূপকথা লিখতে পারত ইতালিও, কিন্তু অতিরিক্ত সময়ে হওয়া ৫ গোলের মধ্যে তিনটিই জার্মানরা করলে সেটি আর হয়নি।

অতিরিক্ত সময়ের ৯৪ মিনিটে মুলারের গোলে এগিয়ে যায় জার্মানরা। ৯৮ মিনিটে সমতা ফেরায় ইতালি, বার্হনিচের গোলে। মুলার ১১০ মিনিটে আবার ত্রাতা, ১০৪ মিনিটে সেটি ফিরিয়ে দেন রিভা। ম্যাচে তখন টানটান উত্তেজনা। মুলার একবার ঢুকেও পড়েছিলেন ইতালির রক্ষণব্যূহ ভেঙে। কিন্তু ১১১ মিনিটে রিভেরা জার্মান-প্রাচীর ভাঙলে হতাশায় নুয়ে মাঠ ছাড়তে হয় মুলারদের। ৪-৩ গোলের সেই ম্যাচকে পরে শতাব্দীর সেরা ম্যাচই আখ্যা দেয়া হয়।

ফাইনালের আগে সেভাবে দেখা মিলছিল না পেলে-ম্যাজিকের। তবে শিরোপার মঞ্চে নিজের পঞ্চম বিশ্বকাপে খেলতে যাওয়া মহাতারকার গোলেই শুরু, সেটিও মাত্র ১৮ মিনিটেই। ৩৭ মিনিটে সমতা ফেরায় ইতালি। দুদলের কয়েকটি আক্রমণে পর প্রথমার্ধ থাকে সমতায়। দ্বিতীয়ার্ধের ৬৬ মিনিটে আবারও ইতালির জাল খুঁজে পায় ব্রাজিল। এবার নায়ক গারসন। ৪-১ গোলে জেতা ব্রাজিলের ড্রিম টিমের পরের গোল দুটি জারজিনহো ও অধিনায়ক আলবার্তোর। তাতে নিজেদের তৃতীয় বিশ্বকাপ শিরোপার সঙ্গে জুলে রিমে ট্রফিটা চিরদিনের জন্যই পেয়ে যায় সেলেসাওরা।

ইতালি-জার্মানির আগুন ঝরা ম্যাচের ক্ষণ

ফিফার নিয়ম অনুসারে কোনো দেশ তিনবার কাপ জিতলে তাদের আজীবনের জন্য ট্রফি দিয়ে দেয়া হয়। জুলে রিমে ট্রফিকে যদিও শেষপর্যন্ত রক্ষা করতে পারেনি ব্রাজিল। রিও ডি জেনিরোতে ব্রাজিল ফুটবল কনফেডারেশনের সদর দপ্তরে কাপটি সুরক্ষিত ছিল। ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বরে যেটি চুরি হয়ে যায়। পরে ট্রফিকে আর উদ্ধার করা যায়নি। তাই চিরতরেই হারিয়ে গেছে প্রথম বিশ্বকাপ ট্রফি।

ফুটবলপ্রেমীদের ক্রীড়াশৈলীতে মাতানো সেই বিশ্বকাপের প্রতি ম্যাচে ২.৯৭ গড়ে গোল হয়েছিল। ব্রাজিলের কোচ মারিও জাগালো প্রথম ব্যক্তি যিনি খেলোয়াড় (১৯৫৮, ১৯৬২) ও কোচের ভূমিকায় বিশ্বকাপ জয়ের রেকর্ড গড়েন। টেলস্টার বল ব্যবহার করা প্রথম বিশ্বকাপ ছিল সেটি। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপও হবে টেলস্টার বলে। ৫৫ জন ভিন্ন ভিন্ন খেলোয়াড়ের থেকে মোট ৯৫টি গোল আসে টুর্নামেন্টে। সর্বোচ্চ গোল জার্মানির জার্ড মুলারের। একটি মাত্র গোল এসেছিল আত্মঘাতীতে।