মাস পেরোনোর আগেই বাজবে রাশিয়া বিশ্বকাপের বাঁশি। ২০টি বিশ্বকাপ পেরিয়ে এসেছে ফুটবল মহাযজ্ঞের যাত্রাপথ। প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল উরুগুয়ে। আগের আসরগুলোর পরতে পরতে ঠাসা রোমাঞ্চকর নানা গল্প। চ্যানেল আই অনলাইনের পাঠকদের ধারাবাহিকভাবে ফিরিয়ে নেয়া হবে ইতিহাসের ধূলিজমা সেসব পাতায়। আজ থাকছে ফ্রান্স বিশ্বকাপ ১৯৩৮’র কথা-
বিশ্বকাপ ফুটবলের তৃতীয় আসর ছিল ১৯৩৮ সালের ফ্রান্স বিশ্বকাপ। সবচেয়ে কম সময়ের ব্যাপ্তি নিয়ে এই আসরটি ফ্রান্সের ১০টি শহরের ১০টি ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হয়। ফাইনালে হাঙ্গেরিকে ৪-২ গোলে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হয় ইতালি। একই কোচের অধীনে পরপর বিশ্বসেরা হয়ে নজির গড়ে আজ্জুরিরা। তখনও ইতালিয়ানদের কোচ ছিলেন আগের আসরে ঘরের মাঠে দলকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করা ভিত্তরিও পোজ্জো।
ফিরে দেখা: বিশ্বকাপ-১৯৩০, বিশ্বকাপ-১৯৩৪
বিশ্বকাপ শুরুর দুই বছর আগে (১৩ আগস্ট ১৯৩৬) ফ্রান্স যখন স্বাগতিকের মর্যাদা পায়, তখন থেকেই শোনা যায় বিদ্রোহের সুর। আর্জেন্টিনা ও জার্মানিকে টপকে প্রথম রাউন্ডের ভোটেই এগিয়ে যায় ফ্রান্স। ১৯৩৪ সালে ইতালিতে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠানের পর সাউথ আমেরিকাকে বাদ দিয়ে টানা দ্বিতীয়বার ইউরোপে বিশ্বযজ্ঞ আয়োজন। যা নিয়ে শুরু হওয়া বিতর্ক শেষ হয় অনেক দেশের টুর্নামেন্ট বর্জনের মধ্যদিয়ে। এরমধ্যে আবার বিশ্বকাপ কাঁপুনির মুহূর্তে দরজায় কড়া নাড়ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
টানা দ্বিতীয়বার ইউরোপে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হওয়ায় ‘বঞ্চিতে’র অভিযোগ তুলে আসর বয়কট করে আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ে। ওই আসরে অংশ নিতে পারেনি আরেক ফুটবল পরাশক্তি স্পেনও। তাদের অংশ না নেয়ার কারণ আবার ছিল ভিন্ন। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধে জন্যই বিশ্বসেরার মঞ্চে নামতে পারেনি দলটি।
ফ্রান্সের জন্য এই বিশ্বকাপ আয়োজন ছিল প্রথম। আর শিরোপাধারী ইতালি এবং ফ্রান্স যথাক্রমে চ্যাম্পিয়ন ও আয়োজক হিসাবে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। ২০০৬ সালের আগ পর্যন্ত শিরোপাধারীরা অবশ্য সরাসরিই বিশ্বকাপে খেলত।
ইতালি ও ফ্রান্স বাদে বাকি ১৪ দলের মধ্য ১১টি ছিল ইউরোপের। দুইটি দল ছিল আমেরিকার। আর এশিয়া থেকে মাত্র একটি। সবমিলিয়ে অ-ইউরোপীয় দেশগুলো ছিল ব্রাজিল, কিউবা এবং ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া (তৎকালীন ডাচ কলোনি ও বর্তমান ইন্দোনেশিয়া)। আয়োজক মহাদেশের বাইরে থেকে এই বিশ্বকাপেই সবচেয়ে কম দেশ অংশগ্রহণ করে।
ফ্রান্স বিশ্বকাপে মজার ব্যাপার আছে আরও। বাছাইপর্ব উতরেও মূলপর্বে খেলা হয়নি অস্ট্রিয়ার। কারণ বাছাইপর্ব শেষে জার্মানির সঙ্গে একত্র হয়ে যায় দেশটি। অস্ট্রিয়া পরে টুর্নামেন্ট থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয় এবং তাদের অধিকাংশ তারকা খেলোয়াড়ই জার্মান স্কোয়াডে যোগ দেন। তবে তাদের মধ্য ব্যতিক্রম ছিলেন ম্যাথিয়াস সিনডেলার, তিনি জার্মান দলে যোগ দিতে অস্বীকার করেন।
অস্ট্রিয়ার গ্রুপে রানার্সআপ ছিল লাটভিয়া। কিন্তু অস্ট্রিয়া নাম প্রত্যাহার করে নিলেও লাটভিয়াকে বিশ্বকাপে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। ফলে অস্ট্রিয়ার জায়গাটি ফাঁকাই থেকে যায়। সেই সুযোগে অস্ট্রিয়ার প্রতিপক্ষ (ড্র অনুযায়ী) সুইডেন সরাসরি দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠে যায়।
বিশ্বকাপের শুরু থেকে ২০১৮ পর্যন্ত একবারই খেলার সুযোগ পেয়েছে কিউবা এবং ইন্দোনেশিয়া। ওই বিশ্বকাপেই অভিষেক হয় পোল্যান্ড এবং নরওয়ের।
১৯৩৮ বিশ্বকাপে লড়াইটা শুরু থেকেই ছিল হাড্ডাহাড্ডি। প্রথম রাউন্ডের সাতটি ম্যাচের পাঁচটিই শেষ হয় অতিরিক্ত সময়ে। দুটি ম্যাচ আবার নিষ্পত্তি হয় রি-প্লেইডে (প্রথমদিনে নির্ধারিত ও অতিরিক্ত ৩০মিনিটে খেলা নিষ্পত্তি না হলে দ্বিতীয়দিনে নতুন করে ম্যাচ হয়)।
সেমিফাইনালে সুইডেনকে ৫-১ গোলে দুমড়ে-মুচড়ে দেয় হাঙ্গেরি। শেষ চার থেকে বিদায় নেয় দুর্দান্ত খেলতে থাকা ব্রাজিলও। সেমিফাইনালে হেভিওয়েট ম্যাচে ধরাশায়ী হয় বিখ্যাত হলুদ জার্সি। সেই ম্যাচে অবশ্য একটা বাজিতে হেরে যায় ব্রাজিল। দলের সেরা স্ট্রাইকার এবং আসরের সর্বোচ্চ গোলদাতা লিওনিদাসকে বিশ্রাম দেয় তারা। দল ফাইনালে যাচ্ছে এটা ধরেই তাকে বিশ্রাম দেয় ব্রাজিল। কিন্তু ইতালিয়ানদের কাছে ২-১ গোলে হেরে মাসুল গুনতে হয় তাদের। পরে সুইডিশদের ৪-১ গোলে হারিয়ে তৃতীয় হয় সেলেসাওরা।
গুজব আছে, সুইডেনের বিপক্ষে সেমিফাইনালের আগে ইতালির তৎকালীন সর্বাধিনায়ক ডিক্টেটর বেনিতো মুসোলিনি দলকে একটি টেলিগ্রাম পাঠান। তাতে লেখা ছিল ‘ভিনসিরির ও মরিরি!’ যার অর্থ করলে দাঁড়ায়, ‘জেতো নয়তো মরো!’।
এটাকে আক্ষরিক অর্থে হুমকি হিসাবে বোঝানো হলেও, দাবি করা হয় নৈতিক বিচারে দলকে উত্সাহ দেয়ার কথাই বলা হয়েছে। তবে এ রকম টেলিগ্রামের কোনো রেকর্ড আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। পরে ইতালির বিশ্বকাপজয়ী সদস্য পিয়েত্রো রাভা এক সাক্ষাতকারে বলেন, ‘‘না, না, না, এটা সত্য না। তিনি আমাদের শুভেচ্ছা জানিয়ে একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু কখনো ‘জয় বা মরো’ টাইপের কিছু না।’’
১৯৩৮ সালের পরে ১২ বছর (দুটি) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়নি। তারপর ১৯৫০ সালে আবারও মাঠে ফেরে বিশ্বসেরার আসর। এই ফাঁকে টানা ১৬ বছর বিশ্বচ্যাম্পিয়ন থাকার রেকর্ড গড়ে ইতালি।
বিশ্বযুদ্ধের সময় ফিফার ইতালিয়ান ভাইস-প্রেসিডেন্ট ড. অটোরিনো বারাসি তার খাটের তলায় জুতার বাক্সে ট্রফিটি লুকিয়ে রেখেছিলেন। এভাবেই দখলদার সেনাদের হাত থেকে বিশ্বকাপ রক্ষা পেয়েছিল।
১৯৩৮ বিশ্বকাপের টুকিটাকি: বিশ্বকাপের তৃতীয় আসর ছিল এটি। স্বাগতিক ফ্রান্স। ৪-১৯ জুন (১৬দিন) সবচেয়ে কম সময় ব্যাপ্তি হওয়া বিশ্বকাপ। চার মহাদেশ থেকে ১৫টি দল অংশ নেয়। ১০টি শহরের ১০টি ভেন্যুতে খেলা হয়। চ্যাম্পিয়ন ইতালি, রানার্সআপ হাঙ্গেরি। তৃতীয় ব্রাজিল, চার নম্বর সুইডেন। মোট গোল ৮৪ (ম্যাচ প্রতি ৪.৬৭ গোল)। সর্বোচ্চ গোলদাতা লিওনিদাস (ব্রাজিল)। ম্যাচপ্রতি দর্শক উপস্থিতি ২০,৮৭২ জন।