মাস পেরোনোর আগেই বাজবে রাশিয়া বিশ্বকাপের বাঁশি। ২০টি বিশ্বকাপ পেরিয়ে এসেছে ফুটবল মহাযজ্ঞের যাত্রাপথ। প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল উরুগুয়ে। আগের আসরগুলোর পরতে পরতে ঠাসা রোমাঞ্চকর নানা গল্প। চ্যানেল আই অনলাইনের পাঠকদের ধারাবাহিকভাবে ফিরিয়ে নেয়া হবে ইতিহাসের ধূলিজমা সেসব পাতায়। আজ থাকছে ইতালি বিশ্বকাপ ১৯৩৪’র কথা-
প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হিসেবে উরুগুয়েকে পাওয়ার সঙ্গে ফিফার আন্তর্জাতিক নীতির পালেও জোর হাওয়া লেগেছিল। ফুটবল জনপ্রিয়তায় তখন কেবলই জোয়ার। খেলাটির অভিভাবক সংস্থার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় বহুগুণ। চার বছর পর, ১৯৩৪ সালে আরেকটি বিশ্বকাপের সিদ্ধান্ত স্থির করে স্বাগতিক খোঁজায় মন দেয় ফিফা। পরবর্তীতে আয়োজক খোঁজার প্রক্রিয়ার মধ্যেই যে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল; সেটি গড়ায় বিশ্বকাপের ম্যাচ, রেফারিং এমনকি ইতিহাসের পাতায় পাতায়। যার নেপথ্যে আয়োজক ইতালির একনায়ক বেনিতে মুসোলিনি।
ফিরে দেখা: বিশ্বকাপ-১৯৩০
১৯৩৪ বিশ্বকাপের আয়োজক খুঁজতে দফায় দফায় সভায় বসতে হয় ফিফার এক্সিকিউটিভ কমিটিকে। ৮ বারের চেষ্টায় ইতালিকে বাছাই করা হয়। ৯ অক্টোবর ১৯৩২, স্টকহোমে সিদ্ধান্ত হয় আজ্জুরিদের হাতে দায়িত্ব তুলে দেয়ার। একে তো বারবার সভায় বসে সিদ্ধান্ত ওলট-পালটের অভিযোগ, তার উপর সদস্য দেশগুলোর ভোট ছাড়াই স্বাগতিক ঠিক করায় ফিফাকে তোপের মুখে পড়তে হয়। মারাত্মক অর্থনৈতিক মন্দায় থাকা ইতালিকে বাছাই করার পেছনে কলকাঠি নাড়েন দেশটির একনায়ক মুসোলিনি। পরবর্তীতে প্রমাণিত হয় তার ছিল সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য।
শুরুতেই ফেডারেশনকে তৎকালীন ইতালিয়ান মুদ্রায় ৩.৫ মিলিয়ন লিরা খরচের বাজেট ঠিক করে দেন মুসোলিনি। তার লক্ষ্যে ছিল জমকালো এক বিশ্বকাপ আয়োজনে যা করা দরকার সেটাই করার। আর উদ্দেশ্যে ছিল ফুটবলের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে নিজের ইমেজ মেরামত করার, প্রচার কাজে লাগিয়ে সমর্থন বাড়ানোর। সেটা তিনি সুচারুরূপেই করতে পেরেছিলেন, সঙ্গে ইতালিকে বানিয়েছিলেন ইউরোপের প্রথম আর বিশ্বের দ্বিতীয় চ্যাম্পিয়ন।
আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে অনুষঙ্গ হিসেবে নানা কৌশলের আশ্রয় নেয়া একনায়কদের ইতিহাসে নতুন নয়, তবে মুসোলিনি ফুটবলকে ব্যবহার করেছিলেন সেসব কৌশলের চেয়েও কৌশলতর উপায়ে। পুরো টুর্নামেন্টকেই প্রপাগান্ডার মঞ্চ বানিয়ে ফেলেন। যে পথে হেঁটে মুসোলিনির দুবছর পর বার্লিন অলিম্পিককে একই থিওরির পরীক্ষাগার বানান আরেক কুখ্যাত একনায়ক অ্যাডলফ হিটলার।
ইউরোপের প্রথম বিশ্বকাপের সময় ছিল ২৭মে থেকে ১০জুন পর্যন্ত। দলগুলোকে প্রথমবারের মতো বাছাই খেলতে হয়। ৩৬ দল অংশ নিতে আবেদন করে। পরে ৩২ দল নিয়ে হয় বাছাইপর্ব। সেখান থেকে ১৬ দল যায় ফাইনাল রাউন্ডে। প্রথম বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়েকে ছাড়াই ইতালি বিশ্বকাপ মাঠে গড়িয়েছিল। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের না খেলার ইতিহাস ওই প্রথম এবং শেষ।
ইতালিতে না আসার উরুগুয়ের সিদ্ধান্তটি ছিল ‘কূটনৈতিক প্রতিশোধে’র অংশ! তাদের মাটিতে হওয়া প্রথম বিশ্বকাপে ইউরোপীয়রা দল পাঠায়নি, পরে ফিফা কর্তা জুলের রিমের বিশেষ অনুরোধে কয়েকটি দল এলেও ইতালি সাড়া দেয়নি। প্রতিবাদ হিসেবে উরুগুয়ে বর্জন করে ইতালির মাটিতে হওয়া বিশ্বকাপ। অন্য দুই লাতিন জায়ান্ট ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাও একই পথে হাঁটতে যাচ্ছিল। শেষঅবধি তারা দল পাঠায়। তৃতীয় সারির দল পাঠায় ব্রাজিল, আর অ্যামেচার দল পাঠিয়ে ইতালিকে জবাব দেয় আর্জেন্টিনা। যদিও ইতালির চ্যাম্পিয়ন হওয়া গোলে অবদান ছিল আর্জেন্টাইন বংশোদ্ভূত ফুটবলারেরই!
ফুটবলে দাপট দেখিয়ে চলা ল্যাটিন দলগুলো অংশ নেয়নি বা দুর্বল দল পাঠিয়েছে। বিশ্বকাপ জৌলুস হারাতে শুরু করে সেখানেই। সঙ্গে গ্রেট ব্রিটেনের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলে জৌলুস আরও কমে। ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডকে বাছাইপর্ব ছাড়াই খেলার অনুমতি দিয়েছিল ফিফা, তারা গ্রহণ করেনি। সঙ্গে ওয়েলস ও নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডও যায়নি ইতালিতে।
তাতে অন্য ইউরোপীয় দলগুলো সুযোগটা নিয়েছিল ভালোমতোই। চূড়ান্ত পর্যায়ের ১৬ দলের ১২টিই হয়ে যায় ইউরোপের। দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলা ৮টি দলের সবকটি ছিল ওই মহাদেশেরই। তার আগে ৩২ দলের মধ্যে হয় অঞ্চলভিত্তিক বাছাইপর্ব। সেবার স্বাগতিক দল ইতালিকেও বাছাইপর্ব খেলতে হয়। চূড়ান্ত পর্ব শুরুর তিন দিন আগ পর্যন্ত চলে বাছাই। ১৫ দল ঠিক হওয়ার পর ১৬তম দলটি খুঁজে পেতে হাত বাড়াতে হয় প্লে-অফে। যুক্তরাষ্ট্র তাতে মেক্সিকোকে হারিয়ে চূড়ান্ত ১৬ দলের ষোলোকলা পূর্ণ করে।
প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ইতালি বিশ্বকাপের সব ম্যাচ নকআউট ফরম্যাটে খেলা হয়। মুসোলিনিও সুযোগটা নেন। প্রতিটি ম্যাচের রেফারি এই একনায়ক নিজেই ঠিক করে দিতেন বলে অভিযোগ ছিল। ইতালির প্রতিটি ম্যাচেও সেটার প্রভাব পড়ে। বাজে রেফারিংয়ের অভিযোগ জড়িয়ে যায় আজ্জুরিদের প্রতিটি জয়ের সঙ্গেই। যার শুরুটা হয়েছিল প্রথম আসরের সেমিফাইনালিস্ট যুক্তরাষ্ট্রকে ৭-১ গোলে বিধ্বস্ত করে।
নকআউটের প্রথম আটটি ম্যাচ একই সময়ে শুরু হয়েছিল। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা গড়পড়তা দল পাঠানোর মাশুল গোনে। আগের আসরের রানার্সআপ আর্জেন্টিনা ২-৩ গোলে সুইডেনের কাছে হেরে বিদায় নেয় প্রথম ম্যাচের পরেই। ব্রাজিলও একই পথে, স্পেনের কাছে ৩-১ গোলে হেরে।
টুর্নামেন্ট কোয়ার্টারে গড়ানোর পর বিশ্বকাপের ইতিহাসের প্রথম রি-প্লেইড ম্যাচের দেখা মেলে ইতালি-স্পেন রোমাঞ্চে। নির্দিষ্ট দিনে খেলার ফল আসেনি, তাতে দ্বিতীয়দিনে গড়ায় ম্যাচ। তখন নির্ধারিত আর অতিরিক্ত ৩০ মিনিটেও খেলার ফল না এলে পরেরদিন নতুন করে মাঠে গড়াত ম্যাচটি। প্রথমদিনে ১-১ গোলে ঝুলে থাকা ম্যাচ পরেরদিনে ১-০ গোলে ফল দেয়। জয়ী স্বাগতিক ইতালি। তাদের জয়ের সঙ্গে ঝড় উঠেছিল বিতর্কেরও। ম্যাচের দায়িত্বে থাকা সুইডিশ রেফারি ইভানকে কোয়ার্টারের আগের রাতে ডিনারে ডেকে নিয়েছিলেন মুসোলিনি। ম্যাচে তার প্রভাব ছিল স্পষ্ট। ইতালির পক্ষে একাধিকবার বেজেছিল পক্ষপাতদুষ্ট বাঁশি!
ম্যাচে খুব বাজে শরীরী ভাষায় খেলেছে দুদলই। স্পেনের গোলরক্ষক রিকার্ডো প্রথমদিনে চোটে পড়ে রি-প্লেইড ম্যাচে খেলতে পারেননি। অন্যদিকে ইতালি দলের মারিওর পা ভেঙে দেন আক্রমণাত্মক স্পেনিয়ার্ডরা, পরে আর কখনোই জাতীয় দলে খেলতে পারেননি তিনি।
মুসোলিনির প্রভাব আর পক্ষপাতদুষ্ট বাঁশির অভিযোগ থেকে রেহাই পায়নি সেমিফাইনালও। অস্ট্রিয়াকে একমাত্র গোলে হারিয়ে ফাইনালের টিকিট কাটে ইতালি। সেই গোলটি যে অফসাইড ছিল, তা নাকি পরে ওই ম্যাচে খেলা ইতালিয়ান ফুটবলাররাই ঠাট্টার ছলে বলতেন! অন্য সেমিতে জার্মানিকে ৩-১ গোলে হারিয়ে শিরোপার মঞ্চে আসে চেকোস্লোভাকিয়া। সেখানেও মুসোলিনির হাত ছিল বলে অভিযোগ। শক্তিশালী জার্মানদের বিদায় নিশ্চিত করতে ইতালিয়ান রেফারি রিনাল্ডোকে ম্যাচ পরিচালনার জন্য নির্বাচিত করে দিয়েছিলেন তিনি!
ফাইনালের মঞ্চ প্রস্তুত। খেলা হবে মুসোলিনির দল ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টির জাতীয় স্টেডিয়ামে। রোমের এস্তাদিওতে ৫৫,০০০ হাজার দর্শকের সামনে খেলা। ম্যাচের সময় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়েছে, ফারেনহাইটে যা ১০৪ ডিগ্রি! মুসোলিনি ম্যাচের আগের রাতে ডিনারে কি কি করেছেন সেটা নিয়ে যখন ফিসফাস করারও সাহস পাচ্ছে না কেউ, তখনই স্বাগতিক দর্শকদের স্তব্ধ করে দিয়ে ৭১ মিনিটে গোল দিয়ে বসেন স্লোভাকিয়ার ফরোয়ার্ড অ্যান্টোনিন পাক।
ম্যাচের প্রথম ৭০ মিনিট ধরে চলা স্বাগতিক স্বপ্নের দোলাচলে তখন বড়সড় ধাক্কা। সেটি অবশ্য ১০ মিনিটের বেশি স্থায়ী হয়নি। ৮১ মিনিটে সমতা ফেরান ইতালির আর্জেন্টাইন বংশোদ্ভূত ফরোয়ার্ড রেইমুন্ডো বিবিয়ানি মুমে অর্সি। আগের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হয়ে খেলা অর্সি সেবার আজ্জুরিদের দলে। অতিরিক্ত সময়ের পাঁচ মিনিটে ফরোয়ার্ড অ্যাঞ্জেলো শিয়াভিও প্রতিপক্ষের জাল খুঁজে নিলে উল্লাসে মাতে কোচ ভিত্তরিও পোজ্জোর ইতালি।
পাঁচ ম্যাচে সবচেয়ে কম(৩টি) গোল খেয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ডও গড়ে ফেলে ইতালি। চেকোস্লোভাকিয়ার ওল্ডরিখ নেজেডলি টুর্নামেন্ট সর্বোচ্চ ৫টি গোল করেন। টুর্নামেন্টজুড়ে ৭০ গোল হয়, ৪৫ জন ভিন্ন ভিন্ন খেলোয়াড়ের মাধ্যমে। যার কোনটিই আত্মঘাতী তথা ‘ওন গোল’ ছিল না। তবে ‘ওন গোলে’র লক্ষ্য পূরণ করেছিলেন একনায়ক মুসোলিনি। পাত্তা দেননি অব্যাহত বিতর্কের কিছুকেই। ফুটবলের ইতিহাস লেখকরা তাই লিখে গেছেন, বিশ্বকাপ-১৯৩৪: জিতেছিলেন আসলে ডিক্টেটর মুসোলিনিই!