মাস পেরোনোর আগেই বাজবে রাশিয়া বিশ্বকাপের বাঁশি। ২০টি বিশ্বকাপ পেরিয়ে এসেছে ফুটবল মহাযজ্ঞের যাত্রাপথ। প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল উরুগুয়ে। আগের আসরগুলোর পরতে পরতে ঠাসা রোমাঞ্চকর নানা গল্প। চ্যানেল আই অনলাইনের পাঠকদের ধারাবাহিকভাবে ফিরিয়ে নেয়া হবে ইতিহাসের ধূলিজমা সেসব পাতায়। আজ থাকছে চিলি বিশ্বকাপ ১৯৬২’র কথা-
১৯৬০ সাল। দুই বছর বাদে বসবে বিশ্বকাপের মহাযজ্ঞ। সকল প্রস্তুতি প্রায় আগেভাগেই সেরে রেখেছিল চিলি। কিন্তু তাতে বাধ সাধল প্রকৃতি। ৯.৫ মাত্রার এক ভূমিকম্প তছনছ করে দিল সাউথ আমেরিকার দেশটিকে। ঘাম ঝরানো কষ্টে তিলে তিলে গড়া বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বপ্নে তখন অস্তাচলের ধাক্কা!
ফিরে দেখা: বিশ্বকাপ-১৯৩০, বিশ্বকাপ-১৯৩৪, বিশ্বকাপ-১৯৩৮, বিশ্বকাপ-১৯৫০, বিশ্বকাপ-১৯৫৪,
শেষঅবধি তেমনটা হয়নি। ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে দেশবাসীর প্রতি এক অমর ভাষণ রাখলেন বিশ্বকাপ আয়োজক কমিটির প্রধান কার্লোস দিত্তবোর্ন, ‘আমাদের কিচ্ছু নেই। আর আমাদের যখন কিছুই নেই তখন হারানোরও কিছুই নেই। আমরা দেখিয়ে দেবো আমরা কী পারি!’
চিলির জনগণ শেষপর্যন্ত ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠে বিশ্বকাপ আয়োজন করে দেখিয়ে দিয়েছিল তারা পারে। চার ভেন্যুতে ১৬ দলের ১৯৬২ সালের বিশ্বকাপ সফলভাবে আয়োজন করে লাতিন আমেরিকার দেশটি।
যার কথায় উজ্জীবিত হয়ে এমন সফল আয়োজন করে চিলি, সেই দিত্তবোর্ন অবশ্য সাফল্য দেখে যেতে পারেননি। বিশ্বযজ্ঞ আয়োজনের মাত্র এক মাস আগে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন চিলি বিশ্বকাপের সফল এ আয়োজক। পরে তার স্মরণে নামকরণ করা হয় আরিকার স্টেডিয়াম স্টাডিও কার্লোস দিত্তবোর্ন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চিলি প্রেসিডেন্ট হোর্হে আলেন্দ্রি বললেন, চিলি এখন পুরোপুরি ফুটবলময়। মাঠের বাইরে চিলি সত্যিকার অর্থেই তখন ফুটবলময়। আয়োজন নিয়ে তৃপ্তি থাকার সঙ্গে মাঠের ফুটবলও হয়ে উঠল রণাঙ্গনমঞ্চ।
অথচ অনেকটা চাপে পড়েই চিলির হাতে বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিল ফিফা। ১৯৫৪ ও ১৯৫৮ বিশ্বকাপ ইউরোপে আয়োজনের পর সাউথ আমেরিকার দেশগুলোর পক্ষ থেকে চাপ ছিল ৬২’র বিশ্বকাপ যেন তাদের মহাদেশেই গড়ায়। ৩২ ভোটে জয়ী চিলির হাতে বিশ্বকাপ আয়োজনের ভার পড়ায় অবশ্য খুশি হতে পারেনি ইউরোপের অনেক দেশই।
গ্রুপপর্বে ইতালির মুখোমুখি হবে চিলি। সেই ম্যাচের আগে ধুম করে বিশ্বকাপ আয়োজনের সমালোচনায় এক প্রতিবেদন লেখেন ইতালির দুই সাংবাদিক অ্যান্তনিও ঘিহরেল্লি ও কোররাদো পিজ্জিনেল্লি। সেই প্রতিবেদন ছিল শ্লেষে ভরা!
‘ফোন কাজ করে না, বিশ্বস্ত স্বামীর মত একটি ট্যাক্সিক্যাব পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। ইউরোপে একটা বার্তা পাঠাতে হাত-পা বিক্রি করা লাগে। আর চিঠি পাঠালে তা পাঁচ দিনের আগে পৌঁছায় না।’
দুই ইতালিয়ান সাংবাদিক ভুলে গিয়েছিলেন প্রবল এক ধাক্কা সামলিয়ে বিশ্বকাপ আয়োজন করছে চিলি। এমন সংবাদ প্রকাশের পর ইতালির বিপক্ষে মুখোমুখি হওয়ার আগে থেকেই তেতে ছিলেন স্বাগতিক খেলোয়াড়রা। ম্যাচ শুরু হওয়া মাত্রই শুরু হাত-পায়ের ব্যাপারও। রেফারিকে বাধ্য হয়েই দুজন খেলোয়াড়কে পাঠাতে হয়েছে মাঠের বাইরে।
এমন মারামারির শাস্তির কথা বিবেচনা করেই লাল-হলুদ কার্ডের নিয়ম চালু করার দাবি জানান ইংলিশ রেফারি কেন অ্যাস্টন। যা পরে শুরু হয় ১৯৭০ বিশ্বকাপ থেকে। সেই ম্যাচে ইতালিকে ২-০ গোলে হারিয়ে প্রতিশোধও নিয়েছিল চিলি। কুখ্যাত হয়ে থাকা সেই ম্যাচ পরে ফুটবল বিশ্বে জায়গা করে নেয় ‘ব্যাটল অব সান্তিয়াগো’ নামে! সেবার গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছিল ইতালি।
৫২ দলের অংশগ্রহণে বাছাইপর্ব শেষে বিশ্বকাপে অংশ নেয়া ১৬ দলকে ভাগ করে দেয়া হয় চার গ্রুপে। চারপটের প্রথম পটে ছিল সাউথ আমেরিকার চার দল। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পটে ছিল ইউরোপের আট দল। আর চতুর্থ পটে বিশ্বের অন্য মহাদেশগুলোর খেলার কথা থাকলেও আদতে খেলেছে ইউরোপ ও সাউথ আমেরিকার দলগুলো। কেবল কনক্যাকাফ অঞ্চল থেকে অংশ নিয়েছে এক মেক্সিকোই। বিধ্বস্ত এক দেশে সেসময় খেলা দেখেছেন প্রায় ৯ লাখ দর্শক।
এই বিশ্বকাপেই পয়েন্ট ও গোল ব্যবধানের বাইরে চালু হয়েছিল গোলগড় নামক এক আজব পদ্ধতি। পয়েন্ট ও গোলের সংখ্যা সমান হলে গোলগড় দিয়ে আলাদা করা হতো দুই দলকে। আর্জেন্টিনাই একমাত্র দল যারা ইংল্যান্ডের সমান পয়েন্ট ও গোল ব্যবধান নিয়েও বাদ পড়েছিল গ্রুপপর্ব থেকেই। ১৯৬৬ বিশ্বকাপে অবশ্য সেই গোলগড় নিয়ম বাতিল হয়ে যায়।
ঘরের মাঠে সেমিফাইনাল পর্যন্ত গিয়েছিল চিলি। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের কাছে ৪-২ গোলে হেরে ভঙ্গ হয় স্বাগতিকদের শিরোপা স্বপ্ন। আরেক সেমিতে যুগোস্লাভিয়াকে ৩-১ গোলে হারিয়ে ফাইনালের টিকিট পায় চেকোস্লোভাকিয়া। তৎকালীন বিশ্বসেরা গোলরক্ষক লেভ ইয়াসিনের বাজে ফর্মের কারণে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বাদ পড়ে পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন।
১৯৬২ সালের ১৭ জুন, সান্তিয়াগোর ফাইনালে পিছিয়ে পড়েও চেকোস্লোভাকিয়াকে ৩-১ গোলে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মত বিশ্বসেরার ট্রফি জুলেরিমে কাপ জিতে নেয় ব্রাজিল। ১৯৫৮ সালে সেলেসাওদের শিরোপার স্বাদ দেয়া পেলে এই বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলতে পারেননি চোটের কারণে। সেই একই বিশ্বকাপের আরেক নায়ক গারিঞ্চা ৬ গোল করে এনে দিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বকাপের স্বাদ। আর যুগোস্লাভিয়াকে ১-০ গোলে হারিয়ে চিলির সান্ত্বনা ছিল তৃতীয় হওয়া।
পেলে না থাকলেও ব্রাজিল দলে ছিলেন এক গারিঞ্চা। ৪ গোল করে ব্রাজিলের আরেক সতীর্থ ভাভা, চিলির লিওনেল সানচেজ ও হাঙ্গেরির ফ্লোরিয়ান আলবার্টের সঙ্গে যৌথভাবে সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন। সেই আসরের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কারও ওঠে গারিঞ্চার হাতে।
এক নজরে ’৬২ বিশ্বকাপ: মোট দল ১৬টি। মোট ম্যাচ ৩২টি। গোল হয়েছিল ৮৯টি। ম্যাচ প্রতি গোল ২.৭৮। এই বিশ্বকাপেই নিয়ম হয় এক দেশের হয়ে খেলে পরের বিশ্বকাপে অন্যদেশে খেলা যাবে না। ২২ সদস্যের দল ঘোষণা প্রবর্তন হয় চিলি বিশ্বকাপেই। শুধুমাত্র উরুগুয়ের দল ছিল ২৩ জনের।
সেরা খেলোয়াড়: গারিঞ্চা(ব্রাজিল) ৪ গোল।