সপ্তাহ দুই পেরোলেই বাজবে রাশিয়া বিশ্বকাপের বাঁশি। ২০টি বিশ্বকাপ পেরিয়ে এসেছে ফুটবল মহাযজ্ঞের যাত্রাপথ। প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল উরুগুয়ে। আগের আসরগুলোর পরতে পরতে ঠাসা রোমাঞ্চকর নানা গল্প। চ্যানেল আই অনলাইনের পাঠকদের ধারাবাহিকভাবে ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে ইতিহাসের ধূলিজমা সেসব পাতায়। আজ থাকছে ইতালি বিশ্বকাপ ১৯৯০’র কথা-
রেফারির সিদ্ধান্তে বলি হওয়ার ঘটনা ফুটবলবিশ্বে অহরহ ঘটে। ফিফার নিয়ম বিবেচনায় সেটি স্বাভাবিক। কেননা এমনকিছু নিয়ম আছে, যেগুলো সম্পূর্ণ রেফারির ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। যেমন হ্যান্ডবলের কথাই ধরা যাক। রেফারি যদি মনে করেন পরিস্থিতি বিবেচনায় নির্দিষ্ট হ্যান্ডবল খেলায় কোনো প্রভাব ফেলেনি, তাহলে সেটি হ্যান্ড নয়। এইসব নিয়মের ফাঁক গলে ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপে এমনকিছু ঘটনা ঘটেছিল যা অতীত-বর্তমানের সব বিতর্ককে হার মানায়। সেই বিতর্কের বলি হয়ে টানা দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ জয় থেকে বঞ্চিত হয় ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা। আর ’৮৬ সালের ফাইনালে এই আর্জেন্টিনার বিপক্ষে শিরোপা হাতছাড়ার জ্বালা জুড়ায় ওয়েস্ট জার্মানি।
ফাইনালে যা ঘটেছিল
নাম তার এদগার্দো কোডেসাল। ১৯৯০ বিশ্বকাপের ফাইনালে রেফারির দায়িত্ব পড়ে তার উপর। তারপর আর কোনোদিন আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনা করতে পারেননি। আর্জেন্টিনা-জার্মানির সেই ফাইনালের পর থেকে আর্জেন্টাইনদের কাছে তিনি চিরশত্রু। ফাইনালে দুই আর্জেন্টাইন ফুটবলারকে লাল কার্ড দেখিয়ে ম্যাচ থেকে পুরোপুরি ছিটকে দিয়েছিলেন আলবিসেলেস্তাদের।
ফিরে দেখা: বিশ্বকাপ-১৯৩০, বিশ্বকাপ-১৯৩৪, বিশ্বকাপ-১৯৩৮, বিশ্বকাপ-১৯৫০, বিশ্বকাপ-১৯৫৪,
বিশ্বকাপ-১৯৫৮, বিশ্বকাপ-১৯৬২, বিশ্বকাপ-১৯৬৬, বিশ্বকাপ ১৯৭০, বিশ্বকাপ-১৯৭৪, বিশ্বকাপ-১৯৭৮, বিশ্বকাপ-১৯৮২, বিশ্বকাপ-১৯৮৬।
কোডেসালের বিপক্ষে আর্জেন্টাইনদের অভিযোগ মূলত জার্মানির জয়সূচক পেনাল্টিটি নিয়ে। পেদ্রো মনজন আর গুস্তাভো দেজোত্তির লাল কার্ড দুটিও চরম বিতর্কিত। একইসঙ্গে জার্মান অধিনায়ক লোথার ম্যাথিউস ফাউল করে নিজেদের ডি-বক্সে আর্জেন্টিনার গ্যাব্রিয়েল ক্যালদেরনকে ফেলে দিলেও কোডেসাল ফাউলের বাঁশি বাজানো থেকে বিরত থাকেন।
জার্মান ফরোয়ার্ড ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যান সেদিন শেষ মুহূর্তে পেনাল্টি আদায় করেন। অভিনয় করে পড়ে যাওয়ার জন্য তিনিও সমালোচিত হন।
রেফারিং বিতর্কের শেষ এখানেই নয়। আর্জেন্টিনা বনাম স্বাগতিক ইতালির সেমিফাইনাল ম্যাচে রেফারি কাউকে কিছু না বলে প্রথমার্ধে আট মিনিট বেশি খেলান। পরে জানা যায়, তিনি ঘড়ি দেখতে ভুলে গিয়েছিলেন!
১৯৯০ বিশ্বকাপের আদ্যোপান্ত
১৯৮৮ সালে ফিফার কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত হয় ১৯৯০ ফিফা বিশ্বকাপের ১৪তম আসর বসবে ইতালিতে। ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পায় ইতালি। ১১৬টি দেশ বাছাইপর্বে অংশ নেয়। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলে কোস্টারিকা, আয়ারল্যান্ড ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
ইতালির মোট ১২ শহরের ১২টি মাঠে অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপ। এশিয়া, আফ্রিকা ও উত্তর আমেরিকা থেকে দুটি, লাতিন আমেরিকা থেকে চারটি ও ইউরোপ থেকে ১৪টি দেশ (স্বাগতিক ইতালিসহ) অংশ নেয় ইতালিতে অনুষ্ঠিত এ বিশ্বকাপে। ছয়টি গ্রুপে চারটি করে দল নিয়ে শুরু হয় প্রথমপর্বের লড়াই। ১৬টি দল থেকে কোয়ার্টার ফাইনালে যায় আট দল।
কোয়ার্টার ফাইনালের লড়াই শেষে সেরা চারে জায়গা পায় আর্জেন্টিনা, পশ্চিম জার্মানি, ইতালি ও ইংল্যান্ড। সেখান থেকে আর্জেন্টিনা স্বাগতিক ইতালিকে ও জার্মানি ইংল্যান্ডকে পরাজিত করে ফাইনাল চলে আসে। ইংল্যান্ডকে হারিয়ে স্বাগতিকরা টুর্নামেন্ট শেষ করে তৃতীয় অবস্থানে থেকে।
এই বিশ্বকাপে এক নতুন জার্মানিকে দেখেছিল ফুটবলবিশ্ব। গ্রুপ পর্বে যুগোস্লাভিয়াকে ৪-১ এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতকে ৫-১ গোলে উড়িয়ে দেয় তারা। লোথার ম্যাথিউস আগের বিশ্বকাপে রক্ষণভাগে খেলেছিলেন। এবার আক্রমণভাগে উঠে আসেন। প্রথম দুই ম্যাচে তিনটি গোল করে সবাইকে অবাক করে দেন।
আগের বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনার অবস্থা অতটা ভালো ছিল না। ডিয়েগো ম্যারাডোনার হাঁটুর ইনজুরি ছিল। আরো বেশ কয়েকজনের ইনজুরি সমস্যা ছিল। একাদশ সাজাতেই তারা হিমশিম খাচ্ছিল। দলটি গ্রুপ পর্বে ক্যামেরুন এবং রোমানিয়ার পরে থেকে দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার সুযোগ পায়। শেষ পর্যন্ত ফাইনালেও উঠে আসে।
ব্রাজিল প্রথম রাউন্ডে দুর্দান্ত খেললেও দ্বিতীয় রাউন্ডে আর্জেন্টিনার কাছে ধরাশায়ী হয়। দলটি এই ম্যাচে বল দখলের লড়াই, আক্রমণ-সবদিক থেকে এগিয়ে ছিল। বেশ কয়েকবার গোলবার তাদের হতাশ করে। শেষ পর্যন্ত ম্যারাডোনার চারজনকে কাটিয়ে দেওয়া পাস ধরে ক্লদিও ক্যানিজিয়া গোল করে ব্রাজিলকে হারিয়ে দেন।
আর যা কিছু আলোচিত
বাছাইপর্বে নাইজেরিয়ার এক ফুটবলার মাঠে মৃত্যুবরণ করলে বিশ্বকাপেও শোকের ছায়া নেমে আসে। দেশটির ২৩ বছর বয়সী ফুটবলার স্যামুয়েল ওকোয়ারাজি অ্যাঙ্গোলার বিপক্ষে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন। মেক্সিকোকে টুর্নামেন্টে নিষিদ্ধ করা হয়। ফিফার অনূর্ধ্ব-২০ টুর্নামেন্টে সচেতনভাবে বেশি বয়সী খেলোয়াড় নামানোয় তাদের এই শাস্তি দেয়া হয়। ইতালি বিশ্বকাপেই প্রথমবারের মতো কোনো আফ্রিকান দেশ হিসেবে ক্যামেরুন শেষ আটে উঠে আসে। রিপাবলিক অব আয়রল্যান্ড পেনাল্টি শুটআউট বাদে কোনো ম্যাচ না জিতেও শেষ আটে উঠে আসে। আটে উঠে আসার পথে তারা মাত্র দুটি গোল করেছিল।
ফাইনাল ম্যাচে আর্জেন্টিনা ০-১ গোলে হেরে যায়। সেই সময়ের বিবেচনায় ফাইনালে গোল না করতে পারা প্রথম দল হয় তারা। ওয়েস্ট জার্মানি চ্যাম্পিয়ন হলে দারুণ একটি রেকর্ডের মালিক হন বেকেনবাওয়ার। কোচ এবং ক্যাপ্টেন হিসেবে প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের গৌরব অর্জন করেন তিনি।
বিশ্বকাপের টুকিটাকি
চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট জার্মানি। মোট দল ২৪টি। বাছাইপর্বে মোট দল ১১৬টি। খেলতে পারেনি ডেনমার্ক, ফ্রান্স এবং পর্তুগাল। সবাইকে অবাক করে চূড়ান্ত পর্বে চলে আসে কোস্টারিকা, রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ড এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। ৬ গোল করে গোল্ডেন বুট জেতেন ইতালির সালভাদর শিলাচি। মোট গোল হয় ১১৫টি। ম্যাচপ্রতি গোলসংখ্যা ২.২১, বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে কম গোলের হার এটি। বেশি গোল করে জার্মানি, ১৫টি।