মাস পেরোনোর আগেই বাজবে রাশিয়া বিশ্বকাপের বাঁশি। ২০টি বিশ্বকাপ পেরিয়ে এসেছে ফুটবল মহাযজ্ঞের যাত্রাপথ। প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল উরুগুয়ে। আগের আসরগুলোর পরতে পরতে ঠাসা রোমাঞ্চকর নানা গল্প। চ্যানেল আই অনলাইনের পাঠকদের ধারাবাহিকভাবে ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে ইতিহাসের ধূলিজমা সেসব পাতায়। আজ থাকছে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ ১৯৭৮’র কথা-
বিশ্বকাপের ১১তম আসর। ১৯৭৮ সাল, ১ থেকে ২৫ জুন, ২৪ দিনের মহাযজ্ঞ বসেছিল আর্জেন্টিনায়। ফাইনালে নেদারল্যান্ডসকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হয় স্বাগতিক আর্জেন্টিনা। নিজেদের ইতিহাসে প্রথম এবং সবমিলিয়ে পঞ্চম দল (উরুগুয়ে, ইতালি, ইংল্যান্ড ও পশ্চিম জার্মানি) হিসাবে ঘরের মাঠে চ্যাম্পিয়ন হয় আলবিসেলেস্তারা।
ফিরে দেখা: বিশ্বকাপ-১৯৩০, বিশ্বকাপ-১৯৩৪, বিশ্বকাপ-১৯৩৮, বিশ্বকাপ-১৯৫০, বিশ্বকাপ-১৯৫৪,
বিশ্বকাপ-১৯৫৮, বিশ্বকাপ-১৯৬২, বিশ্বকাপ-১৯৬৬, বিশ্বকাপ ১৯৭০, বিশ্বকাপ-১৯৭৪
টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী ম্যাচে মুখোমুখি হয় তিউনিসিয়া ও ইরান। এই আসরের মধ্যদিয়ে শেষ হয় ১৬ দলের বিশ্বকাপ আয়োজন। যাতে আয়োজক দেশ বাছাইপর্ব ছাড়াই সরাসরি বিশ্বকাপ খেলে। পরের আসরগুলোতে ২৪ দল অংশগ্রহণ করে। এখন যেটা ৩২ দলে এসে ঠেকেছে।
১৯৬৬ সালেই আর্জেন্টিনাকে আয়োজকের দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৭০ বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পেয়ে মেক্সিকো আগেই বিড থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে।
এই বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে ছিল নাটকীয়তা। ইতালি ও নেদারল্যান্ডসের কাছে হেরে কোয়ালিফাই থেকে বাদ যায় ইংল্যান্ড ও বেলজিয়াম। এছাড়া ১৯৭৬ সালের ইউরোপ সেরা চেকোস্লোভাকিয়া, যুগোস্লাভিয়া, বুলগেরিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নও (বর্তমান রাশিয়া) বাছাইপর্ব পার হতে পারেনি।
বিশ্বকাপ যাত্রার পর সেবারই প্রথম টুর্নামেন্ট খেলতে ব্যর্থ হয় উরুগুয়ে। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের মঞ্চে জায়গা করে নেয় ইরান, তিউনিসিয়া। ১৯৫৮’র পর ফিরে আসে অস্ট্রিয়াও। আগেরবার বিশ্বকাপ মিস করলেও আর্জেন্টিনায় ফিরে আসে পেরু এবং মেক্সিকো।
তবে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পাওয়া পর থেকেই শুরু হয় বিতর্ক। বিতর্কিত বিশ্বকাপগুলোর মধ্য অন্যতম ছিল এই ৭৮’র বিশ্বকাপ।
সাধারণত কোনো দেশে বিশ্বকাপ হলে তা কমপক্ষে ৫ বছর আগেই ঠিক হয়ে যায়। ১৯৭৬ সালের আগেই ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশের দায়িত্ব পায় আর্জেন্টিনা। এসময়ই আবার (১৯৭৬ সালে) আর্জেন্টিনায় সামরিক অভ্যুত্থান হয়, ক্ষমতায় আসে ভিদেলের জান্তা সরকার। দেশে শুরু হয় অরাজকতা। চিরাচরিতভাবেই জান্তা সরকার দেশে চালায় হত্যা, গুমসহ নানা অত্যাচার। ভিন্নমতাবলম্বীদের ব্যাপকহারে গুম করে দেয়া হয়। রাতারাতি নিখোঁজ হন সাড়ে ৫ হাজারের বেশি মানুষ।
জান্তা সরকার ক্ষমতায় আসায় নেদারল্যান্ডসের নেতৃত্বে বিভিন্ন দেশ বিশ্বকাপ স্থানান্তরের ব্যাপারে মতামত জানায়। কিন্তু একটি বিশ্বকাপ সরিয়ে নেয়া এত সহজ ব্যাপার না, তাই বিশ্বকাপ আয়োজন আর্জেন্টিনাতেই থেকে যায়।
তাতে সব দল আসলেও বিশ্বকাপ বয়কট করেন ডাচ কিংবদন্তি, সেই আমলের সেরা ফুটবলার ইয়োহান ক্রুইফ ও জার্মান তারকা ডিফেন্ডার পল ব্রিটনার। মুখে অন্য পারিবারিক কারণ দেখালেও, ক্রুইফের অনেক কাছের লোকের ভাষ্যমতে সিদ্ধান্ত ছিল জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ।
ক্রুইফ কেবল একজন ফুটবলারই নন, এর চেয়ে অনেক বেশিকিছু। কাতালান স্বাধীনতা থেকে শুরু করে যাবতীয় সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সমর্থন থাকত তার। সেই বিশ্বকাপ তার প্রথম ধাক্কাটি খায় প্রথিতযশা দুই ফুটবলারের বর্জনের ভেতর দিয়ে।
টুর্নামেন্ট শুরুর কিছুদিন আগে আয়োজক কমিটির প্রধানকে হত্যা করে জান্তা সরকার। কারণ তিনি নাকি অতিরিক্ত ব্যয়ের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে যাচ্ছিলেন। সেই বিশ্বকাপ স্মরণ করিয়ে দেয় হিটলার আমলের ১৯৩৬ অলিম্পিক ও ১৯৩৪-এ মুসোলিনির ইতালি বিশ্বকাপের কথা।
বিতর্ক বাড়ে আর্জেন্টিনার সব ম্যাচ রাতে দেয়ায়। অভিযোগ আছে স্বাগতিকদের সুবিধা দিতেই এমন ব্যবস্থা করা হয়েছিল। স্বাগতিক আর্জেন্টিনা খুব কষ্টে হাঙ্গেরির সাথে ২-১ গোলে প্রথম ম্যাচে জিতে যায়। আর্জেন্টিনা গ্রুপ পার করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
পরে ব্রাজিল, পেরু ও পোল্যান্ডের সাথে দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলা পড়ে তাদের। নিজেদের প্রথম ম্যাচে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা দুই দলই জিতে নেয়, এরপর ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ম্যাচটি ড্র হয়। শেষ ম্যাচে ব্রাজিল ৩-১ গোলে জয় পেলে আর্জেন্টিনার জন্য সমীকরণ দাঁড়ায় কমপক্ষে ৪ গোলের ব্যবধানে জিততে হবে সেমিতে যাওয়ার জন্য।
সেই ম্যাচটিই হয়ে দাঁড়ায় সবচেয়ে বড় বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। আর্জেন্টিনা ম্যাচটি জিতে যায় ৬-০ গোলে! যদিও আর্জেন্টিনার মাটিতে এই ম্যাচের আগেও কখনো জিততে পারেনি পেরু। তাদের জয়-পরাজেয়র ব্যবধান ছিল ১৫-৩। তারপরও প্রয়োজনের সময় ওই ব্যবধান বিতর্কের ঝড় তোলে।
সেজন্যই পরের বিশ্বকাপে, অর্থাৎ ১৯৮২তে ফিফা নিয়ম পাল্টে বলে দেয়, শেষ রাউন্ডের খেলা হবে একই সময়ে।
পেরু ম্যাচের পর গুঞ্জন ওঠে আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়দের জোর করে শক্তিবর্ধক ড্রাগ দেয়ার কথা। সেই সময়ের পেরু এত দুর্বল বা আর্জেন্টিনা এত সবল দল ছিল না যে স্কোরলাইন ৬-০ হতে পারে। ফলে একের পর এক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আসতে থাকে।
ব্রাজিলের মিডিয়া দাবি করে, পেরু ম্যাচে জেতার জন্য আগেই পেরুর গোলকিপার ও কয়েকজন খেলোয়াড়ের সঙ্গে চুক্তি করে আর্জেন্টিনা। তছাড়া পেরুর গোলকিপারের জন্মও নাকি আবার আর্জেন্টিনায়। সে তত্ত্বও দেয় ব্রাজিল মিডিয়া।
ব্রিটিশ মিডিয়ার দাবি, আর্জেন্টিনা সে সময় পেরুর গমের চাহিদার এক বিশাল অংশের যোগানদাতা ছিল। ওই গম নিয়ে নাকি পেরু সরকারকে চাপ দেয় আর্জেন্টাইন জান্তা সরকার।
লাতিন আরো কিছু সাময়িকীতে আসে আরেক গুজব। আর্জেন্টিনার জেলে বন্দি ১৩ জন পেরুভিয়ান নাগরিককে মুক্তি দেয়ার বদলে এই জয়টি দাবি করে জান্তা সরকার। অভিযোগ ওঠে, চুক্তি হয়েছিল আর্জেন্টিনার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা পেরুর বিদেশি অর্থ নিয়েও। বিতর্ক ছিল তখনকার ১৭ বছরের উঠতি তারকা ম্যারাডোনাকে দলে না নেয়া নিয়েও। তবে এসব কোনো বিতর্কেরই প্রমাণ পাওয়া যায়নি শেষঅবধি।
১৯৭৮ বিশ্বকাপেই নকআউটপর্বে প্রথম পেনাল্টি শটের নিয়ম চালু করে ফিফা। ১২০ মিনিটে খেলা নিষ্পত্তি না হলে পেনাল্টিতে শেষ হয় ম্যাচ।
ওই বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ডে বিভিন্ন বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। প্রথম রাউন্ডেই বাদ পড়ে শিরোপাধারী জার্মানরা। তবে মেক্সিকোকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথম আফ্রিকান দেশ হিসাবে বিশ্বকাপে ম্যাচ জয়ের ইতিহাস গড়ে তিউনিসিয়া।
শুরু থেকে চলা বিতর্ক জারি থাকে শেষেও। ফাইনালে নেদারল্যান্ডস দলকে স্টেডিয়ামে আনা হয় অনেকবেশি পথ ঘুরিয়ে। মাঠের মধ্যে যখন হল্যান্ড দলকে নামানো হয়, তখনও আর্জেন্টিনা দল ড্রেসিংরুমে। কেন এটা করা হয়েছিল? লাতিন সমর্থকরা অন্যান্য যেকোনো জায়গার থেকেই বেশি ফুটবল আবেগময়, তাই স্টেডিয়ামও থাকে বেশি শোরগোলময়। বুয়েন্স আয়ার্সের ৭০ হাজার সমর্থকের সামনে ডাচ দলকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল কেবল দুয়ো শোনার জন্য। ৭০ হাজার দর্শক হুইসেল ফুঁকিয়ে, সিটি বাজিয়ে নেদারল্যান্ডস দলকে দুয়ো দিতে থাকে খেলা গড়ানোর আগ পর্যন্ত।
আর্জেন্টিনার হয়ে প্রথম গোল করেন মারিও কেম্পেস। কিন্তু ম্যাচের শেষমুহূর্তে ডিক নানিনগার গোলে সমতায় ফেরে নেদারল্যান্ডস। খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। ম্যাচ যখন ১-১ সমতা, ডাচ স্ট্রাইকারের একটি শট তখন বারে লাগে। পরে আর্জেন্টিনার হয়ে গোল করেন ড্যানিয়েল বার্টোনি ও কেম্পেস। ফাইনাল ম্যাচ নিজেদের মাঠে ৩-১ গোলে জিতে নেয় আর্জেন্টিনা! ফাইনালে ২ গোল করে মোট ছয় গোল নিয়ে টপস্কোর হন কেম্পেস।
ম্যাচের বিতর্কিত ঘটনার জেরে পোস্ট ম্যাচে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানায় নেদারল্যান্ডস। পরে সংবাদ সম্মেলনে আসেনি ডাচরা। এটা ছিল বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের টানা দ্বিতীয় ফাইনালে হার। আগের আসর, অর্থাৎ ১৯৭৪ সালে জার্মানির কাছে হেরেছিল তারা। ডাচদের দুটি ফাইনাল হারই ছিল আবার স্বাগতিক দেশের বিপক্ষে।
১৯৭৮ বিশ্বকাপের টুকিটাকি: বিশ্বকাপের ১১তম আসর ছিল। স্বাগতিক আর্জেন্টিনা। চলে ১-২৫ জুন (২৪দিন)। পাঁচ মহাদেশ থেকে ১৬টি দল অংশ নেয়। ৫টি শহরের ৬টি ভেন্যুতে খেলা হয়। চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা, রানার্সআপ নেদারল্যান্ডস। তৃতীয় ব্রাজিল, চতুর্থ হয় ইতালি। মোট গোল ১০২ (ম্যাচ প্রতি ২.৬৮ গোল)। সর্বোচ্চ গোলদাতা মারিয়াও কেম্পেস (ব্রাজিল, ৮ গোল)। ম্যাচপ্রতি দর্শক সংখ্যা ৪০,৬৭৯জন।