মাস পেরোনোর আগেই বাজবে রাশিয়া বিশ্বকাপের বাঁশি। ২০টি বিশ্বকাপ পেরিয়ে এসেছে ফুটবল মহাযজ্ঞের যাত্রাপথ। প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল উরুগুয়ে। আগের আসরগুলোর পরতে পরতে ঠাসা রোমাঞ্চকর নানা গল্প। চ্যানেল আই অনলাইনের পাঠকদের ধারাবাহিকভাবে ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে ইতিহাসের ধূলিজমা সেসব পাতায়। আজ থাকছে স্পেন বিশ্বকাপ ১৯৮২’র কথা-
স্পেনে বসে বিশ্বযজ্ঞের ইতিহাসের ১২তম আসর, ১৯৮২ বিশ্বকাপ। ব্যপ্তি ছিল ১৩ জুন থেকে ১১ জুলাই। পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ইতালি।
ইতালির তৃতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা ছিল সেটি। আর গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় নেয় আগের আসরের শিরোপাধারী আর্জেন্টিনা। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ মঞ্চে এসেছিল আলজেরিয়া, হন্ডুরাস, কুয়েত এবং নিউজিল্যান্ড।
ফিরে দেখা: বিশ্বকাপ-১৯৩০, বিশ্বকাপ-১৯৩৪, বিশ্বকাপ-১৯৩৮, বিশ্বকাপ-১৯৫০, বিশ্বকাপ-১৯৫৪,
বিশ্বকাপ-১৯৫৮, বিশ্বকাপ-১৯৬২, বিশ্বকাপ-১৯৬৬, বিশ্বকাপ ১৯৭০, বিশ্বকাপ-১৯৭৪, বিশ্বকাপ-১৯৭৮
সেবার বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম ফাইনাল নিষ্পত্তি হয়েছিল পেনাল্টি শটে।
প্রথম রাউন্ডের ম্যাচেই ইতিহাস গড়ে হাঙ্গেরি। এল সালভাদরকে ১০-১ গোলে হারায় তারা। বিশ্বকাপে এটাই সবচেয়ে বড় জয়। তার আগে ১৯৫৪ বিশ্বকাপে হাঙ্গেরিই ৯-০ গোলে জিতেছিল সাউথ কোরিয়ার বিপক্ষে। আর ১৯৭৪ বিশ্বকাপে একই ব্যবধানে জায়ারকে (বর্তমান কঙ্গো) হারিয়েছিল যুগোস্লাভিয়া।
১৯৮২ বিশ্বকাপের স্বাগতিক হিসাবে স্পেনকে ১৯৬৬ সালেই বেছেছিল ফিফা। তার আগে ১৯৭৪ বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য পশ্চিম জার্মানিকে সমর্থন করেছিল স্পেন, সেই সূত্র ধরে ৮২’র জন্য স্পেনকে সমর্থন দেয় পশ্চিম জার্মানি।
স্পেন বিশ্বকাপেই প্রতিযোগীর সংখ্যা ১৬ থেকে ২৪ দল করা হয়। আফ্রিকা এবং এশিয়া থেকে দল বাড়াতে এই পদক্ষেপ নেয় ফিফা।
স্পেন বিশ্বকাপ ছিল নেদারল্যান্ডসের জন্য বেদনাদায়ক। কারণ ওই বিশ্বকাপে খেলতে পারেনি দলটি। বাছাইপর্বেই বাদ পড়ে যায় ১৯৭৪ ও ১৯৭৮ বিশ্বকাপের রানার্সআপ দল। বাছাইপর্ব পার হতে পারেননি মেক্সিকো, সুইডেনও। তবে এক যুগের বিরতির পর আবার ফিরে আসে সোভিয়েত ইউনিয়ন।
সেবার বিশ্বকাপ বয়কট করার কথা ভাবছিল ইংল্যান্ড, নর্দার আয়ারল্যান্ড এবং স্কটল্যান্ড। কারণ বিশ্বকাপ শুরুর আগেই ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে ব্রিটেন ও আর্জেন্টিনার যুদ্ধ চলছিল।
যুদ্ধ চলাকালেই ব্রিটিশ ক্রীড়ামন্ত্রী নিল ম্যাকফারলেন নির্দেশে জানান, আর্জেন্টিনা এবং ব্রিটেনের প্রতিনিধির মধ্য কোনো খেলা হওয়া উচিত হবে না। যদিও সেই নির্দেশ বার্তা আগস্টে দুদেশের শত্রুতা শেষ হওয়া পর্যন্ত খোলাসা হয়নি।
ম্যাকফারলেন প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের কাছে পাঠানো এক রিপোর্টে জানান, আহত হওয়ার ভয়ে কয়েকজন খেলোয়াড় ও কর্মকর্তা বিশ্বকাপে অংশ নিতে অস্বস্তি বোধ করছিলেন।
সেই অবস্থায় ব্রিটিশ সরকারকে এক বার্তায় ফিফা পরামর্শ দেয় যে, তারা যেন বিশ্বকাপ বয়কট না করে। কারণ কোনোভাবেই ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ থেকে সরে যেতে বলা যাবে না। আর এটা করা হলে সেটা আর্জেন্টাইনদের অনুপস্থিতিতে তাদের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ও রাজনৈতিক চাপের সামিল হিসাবে গণ্য হবে।
পরে কোনো দেশের বয়কট ছাড়াই বিশ্বকাপ শুরু হয়। উদ্বোধনী ম্যাচে শিরোপাধারী আর্জেন্টিনাকে ১-০ গোলে হারিয়ে দেয় বেলজিয়াম। বার্সেলোনার ঘরের মাঠ ন্যু ক্যাম্পে সেদিন হতাশ হয়েছিলেন কাতালান সমর্থকরাও। সদ্য বার্সায় নাম লেখানো ম্যারাডোনা যে তাদের প্রত্যাশা মতো খেলতে পারেননি।
হতাশার শুরু ছিল আসরে শেষপর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন হওয়া ইতালিরও। নতুন আসা ক্যামেরুনের সঙ্গে ড্র করে তারা। পরের দুই ম্যাচও ড্র করে ইতালি। বিশ্বকাপের প্রথম দল হিসাবে গ্রুপপর্বের তিন ম্যাচ ড্র করেও পরের রাউন্ডে ওঠে আজ্জুরিরা। আফ্রিকান দলটি আটকে দিয়েছিল পোল্যান্ডকে।
গ্রুপপর্বের পারফরম্যান্সের কারণে ইতালির কড়া সমালোচনা করেন দেশটির বিখ্যাত সাংবাদিক টিফোসি। এজন্য তিনি দায়ী করেন সিরি আ’য় বেটিং স্ক্যান্ডালে জড়িয়ে জাতীয় দলের কয়েকজন খেলোয়াড়ের নিষিদ্ধ হওয়ার ঘটনাকে।
ওই বিশ্বকাপে ছিল স্পেন-আলেজিয়ার রাজনৈতিক উত্তাপও। প্রথম ম্যাচে জায়ান্ট পশ্চিম জার্মানিকে ২-১ গোলে হারিয়ে দেয় আলেজেরিয়া। তাদের জয়ে গ্রুপ জমে ওঠে। জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার শেষ ম্যাচে এমন সমীকরণ দাঁড়ায়, জার্মানি যদি ১ বা ২ গোলে জেতে তাহলে দুদলই পরের রাউন্ডে কোয়ালিফাই করবে। তবে জার্মানি এর চেয়ে বড় ব্যবধানে জিতলে অস্ট্রিয়াকে ছাপিয়ে পরের রাউন্ডে চলে যাবে আলজেরিয়া। আর জার্মানি যদি ড্র করে অথবা হারে, তাহলে তাদের বিদায়ঘণ্টা বাজবে।
এমন ম্যাচের ১০ মিনিটে মাথায় গোল পায় জার্মানি। সেই গোলের পরই স্পেনের দর্শকরা আলজেরিয়াকে উদ্দেশ্য করে দুয়ো দিতে থাকে- ফুয়েরা, ফুয়েরা। মানে আউট আউট। পরে বিশ্বকাপ থেকে বাদ যাওয়া আলজেরিয়া ফিফার কাছে নালিশ জানায়।
চারনম্বর গ্রুপের খেলায় ঘটে আরেক ঘটনা। ফ্রান্স ও কুয়েত ম্যাচে একটি গোলকে কেন্দ্র করে মাঠে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। কুয়েতের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ ফাহাদ আল-আহমেদ আল-জাবের আল-সাবাহ গোল পুনর্বিবেচনার জন্য মাঠে নেমে গেলে খেলাই বন্ধ হয়ে যায়। পরে খেলা শুরু হলে ৪-১ ব্যবধানে ম্যাচ জেতে ফ্রান্স।
দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রথম ম্যাচে ইতালির কাছে ২-১ ব্যবধানে হারের পর সেমিফাইনালে যেতে ব্রাজিলের বিপক্ষে জিততেই হবে এমন সমীকরণের পর্যায়ে চলে যায় আর্জেন্টিনা হিসাব। কিন্তু সেই ম্যাচেও ব্রাজিলের কাছে ৩-১ গোলে হেরে যায় আলবিসেলেস্তারা। ব্রাজিলের জাও বাতিস্তাকে ফাউল করে লাল কার্ড দেখেন ম্যারাডোনা। তবে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে জিতলেও শেষ ম্যাচে ইতালির কাছে হেরে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের মতো ব্রাজিলেরও দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে বিদায়ঘন্টা বাঁজে।
প্রথম সেমিফাইনালে পোল্যান্ডকে ২ গোলে হারিয়ে সহজেই ফাইনালে ওঠে ইতালি। তবে দ্বিতীয় সেমিতে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বীতা হয় জার্মানি ও ফ্রান্সের। নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময় মিলিয়ে ম্যাচ ৩-৩ গোলে অমীমাংসিত থাকার পর পেনাল্টিতে ফরাসিদের ৫-৪ গোলে হারিয়ে ফাইনালে যায় জার্মানরা।
তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচেও হেরে যায় ফ্রান্স। ফরাসিদের হারিয়ে নিজেদের বিশ্বকাপ ইতিহাসে সেরা পারফর্ম (তৃতীয় হয়) করে পোলিশরা। ফাইনালে প্রায় একতরফা ভাবে জার্মানিকে ৩-১ গোলে হারিয়ে নিজেদের তৃতীয় শিরোপা জেতে ইতালিয়ানরা।
বিশ্বকাপ জিতে বেশকিছু রেকর্ড গড়ে ইতালি। গ্রুপপর্বের প্রথম তিন ম্যাচ ড্র করেও ইতিহাসের প্রথম দল হিসাবে বিশ্বকাপ জেতে দলটি। এই জয়ের মধ্যদিয়ে ব্রাজিলের তখন পর্যন্ত তিন বিশ্বকাপ জয়কে স্পর্শ করে ইতালি। ২০১০ সালে স্পেনের আগে সবচেয়ে কম গোল করে বিশ্বকাপ জেতা দলের নামও ইতালি। সবচেয়ে বেশি বয়সে বিশ্বকাপ জেতার রেকর্ড গড়েন ইতালিয়ান গোলকিপার দিনো জফ।
১৯৮২ বিশ্বকাপের টুকিটাকি: বিশ্বকাপের ১২তম আসর ছিল। স্বাগতিক স্পেন। চলে ১৩ জুন থেকে ১১ জুন (২৪দিন)। ৬ মহাদেশ থেকে ২৪টি দল অংশ নেয়। ১৪টি শহরের ১৭টি ভেন্যুতে খেলা হয়। চ্যাম্পিয়ন ইতালি, রানার্সআপ পশ্চিম জার্মানি। তৃতীয় পোল্যান্ড, চতুর্থ ফ্রান্স। মোট গোল ১৪৬ (ম্যাচ প্রতি ২.৮১ গোল)। সর্বোচ্চ গোলদাতা পাওলো রোসিও (ইতালি, ৬ গোল)। ম্যাচপ্রতি দর্শক সংখ্যা ৪০,৫৭৯ জন।