Site icon চ্যানেল আই অনলাইন

বেবেতো, বাজ্জিও আর আয়ার্তন সেনার বিশ্বকাপ

সপ্তাহ দুই গড়ালেই বাজবে রাশিয়া বিশ্বকাপের বাঁশি। ২০টি বিশ্বকাপ পেরিয়ে এসেছে ফুটবল মহাযজ্ঞের যাত্রাপথ। প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল উরুগুয়ে। আগের আসরগুলোর পরতে পরতে ঠাসা রোমাঞ্চকর নানা গল্প। চ্যানেল আই অনলাইনের পাঠকদের ধারাবাহিকভাবে ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে ইতিহাসের ধূলিজমা সেসব পাতায়। আজ থাকছে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপ ১৯৯৪’র কথা-

দেশ থেকে এসেছে সুসংবাদ। স্ত্রী ডেনিসে ডে অলিভিয়েরা জন্ম দিয়েছেন তৃতীয় সন্তান। বাবা বেবেতো তখন কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে মার্কিনমুলুকে ব্যস্ত বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালের রণকৌশল সাজাতে। তখন কী আর করা যায়?

ফুটবল দেবতা যেন হাসলেন। পরে ম্যাচের ৬৩ মিনিটে বেবেতোর পা দিয়ে করালেন অনিন্দ্য সুন্দর আর মহাগুরুত্বপূর্ণ এক গোল। ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড গোল পেয়ে ছুটলেন। মাঠের কর্নারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে দুহাতে অদৃশ্য সন্তানকে দুলিয়ে দুলিয়ে গোল উৎসর্গ করলেন। উদযাপনে যোগ দিলেন দুই ব্রাজিল সতীর্থ রোমারিও এবং মাজিনহো। একই ভঙ্গিতে যেন আদর করলেন বেবেতোর সদ্যজাত সন্তানকে।

ফিরে দেখা: বিশ্বকাপ-১৯৩০বিশ্বকাপ-১৯৩৪বিশ্বকাপ-১৯৩৮বিশ্বকাপ-১৯৫০, বিশ্বকাপ-১৯৫৪,

বিশ্বকাপ-১৯৫৮, বিশ্বকাপ-১৯৬২বিশ্বকাপ-১৯৬৬বিশ্বকাপ ১৯৭০বিশ্বকাপ-১৯৭৪,

বিশ্বকাপ-১৯৭৮বিশ্বকাপ-১৯৮২বিশ্বকাপ-১৯৮৬বিশ্বকাপ-১৯৯০

১৯৯৪ বিশ্বকাপকে স্মরণ করতে গেলে বারবার ফিরে আসে বেবেতোর সেই গোল উদযাপনের স্মৃতি। পরে তো এমন উদযাপন ট্রেডমার্কই হয়ে গেছে খেলোয়াড় বাবাদের কাছে। সদ্যজাত সন্তানের বাবা হয়েছেন, তো গোল করে হাত দুলিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন বিশ্বকে, ‘এই আমার সন্তান!’

বেবেতোর সেই বিখ্যাত উদযাপন (মাঝখানে)

এবার আসা যাক রবার্তো বাজ্জিও নামের এক দুঃখী ফুটবলারের গল্পে। ১৯৯৪ বিশ্বকাপে পাঁচ গোল করলেন। সবগুলোই নকআউটে। দুর্বল ইতালি কোনরকমে গ্রুপপর্ব পার হলে হাল ধরেন এ জুভেন্টাস ফরোয়ার্ড। দ্বিতীয়পর্বে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে গোল্ডেন গোল, কোয়ার্টার ফাইনালে স্পেনের বিপক্ষে জয়সূচক গোলটাও তার। আর বুলগেরিয়ার বিপক্ষে বাজ্জিওর জোড়া গোলেই ফাইনালের টিকিট কাটে ইতালি।

দুর্দান্ত ফর্মে থাকা বাজ্জিও সেমিফাইনাল চলাকালে হঠাতই পড়লেন চোটে। তবে ব্যথানাশক ইনজেকশন নিয়েই সেমিতেও অব্যাহত রাখলেন পায়ের জাদু। কিন্তু ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে হয়ে গেলেন অনিশ্চিত।

ফাইনালটা অবশ্য খেলেছিলেন বাজ্জিও। ব্রাজিল গোলরক্ষক ক্লডিও টাফফারেলের পরীক্ষাও নিয়েছেন কয়েকবার। যদিও ম্যাচ শেষ পর্যন্ত গড়িয়েছে টাইব্রেকে। জিতেছে ব্রাজিল।

সেই টাইব্রেকই সারাজীবনের জন্য দুঃখ হয়ে থাকল বাজ্জিওর। দল যখন ৩-২ ব্যবধানে পিছিয়ে, বল পায়ে নিলেন সেবারের বিশ্বকাপের অন্যতম নায়ক। যে গোলটা হলেই আশা বেঁচে থাকে ইতালির। কিন্তু বাজ্জিও বল উড়িয়ে ফেললেন গোলবারের বাইরে দিয়ে। চতুর্থবারের মত চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। আর নায়ক থেকে খলনায়ক, পরে ইতিহাসের পাতায় ট্র্যাজেডির নায়ক হয়ে রইলেন বাজ্জিও।

ফেরা যাক আরেক ব্রাজিলিয়ানের গল্পে। আয়ার্তন সেনা। ছিলেন তিনবারের বিশ্বসেরা ফর্মুলা ওয়ান ড্রাইভার। ফুটবলের বাইরে তাকে নিয়েই ছিল ব্রাজিলিয়ানদের সবচেয়ে মাতামাতি। স্বদেশি ফুটবলারদের কাছেও ছিলেন সমান জনপ্রিয়।

বিশ্বযজ্ঞের বছরের ১৭ জুন, বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার দেড় মাস আগে সান ম্যারিনো গ্রাঁ প্রিঁতে দুর্ঘটনায় নিহত হন ব্রাজিলিয়ানদের প্রিয় আয়ার্তন সেনা। ফুটবলারদের মাঝেও রেখে যান গভীর ছাপ।

আয়ার্তন সেনা। ফুটবলার না হয়েও যিনি ছিলেন বিশ্বকাপে!

১৭ জুলাই, ২৪ বছরের হাহাকার ঘুচিয়ে বিশ্বকাপ ঘরে তুললেন ব্রাজিল অধিনায়ক দুঙ্গা। সেবার বহুকাঙ্ক্ষিত শিরোপা উৎসর্গ করা হয় আয়ার্তন সেনার নামে। ফুটবলার না হয়েও বিশ্বকাপে জড়িয়ে যায় এক ফর্মুলা ওয়ান ড্রাইভারের নাম।

১৯৯৪ বিশ্বকাপ ছিল ফুটবল বিশ্বযজ্ঞের ১৫তম আসর। অংশগ্রহণ করে ২৪টি দল। গ্রুপ ছিল ছয়টি। প্রতি গ্রুপের সেরা ও রানার্সআপ দলগুলো ছাড়াও চারটি সেরা তৃতীয় দল খেলার সুযোগ পায় দ্বিতীয় রাউন্ডে।

যা ছিল আলোচিত
ওই বিশ্বকাপেই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায় ডিয়েগো ম্যারাডোনার। গ্রীসের বিপক্ষে গ্রুপপর্বের প্রথম ম্যাচে ১ গোল করার পর নাইজেরিয়া ম্যাচের আগে ডোপ টেস্ট পজেটিভ হন ১৯৮৬ বিশ্বকাপের আর্জেন্টিনা অধিনায়ক। পরে তাকে আর খেলার সুযোগ দেয়নি আর্জেন্টাইন ফুটবল ফেডারেশন। এরপর আর কোনদিনও জাতীয় দলের হয়ে খেলা হয়নি এ কিংবদন্তির।

বিতর্ক কেবল এখানেই থেমে থাকেনি। এক ব্রাজিলিয়ান ভক্তকে আতশবাজি দিয়ে গুরুতর আহত করার অভিযোগ ছিল চিলি গোলরক্ষক রবের্তো রোহাসের বিরুদ্ধে। সেই জেরে ৯৪ বিশ্বকাপে পুরো চিলি দলকেই বহিষ্কার করে ফিফা।

সেই বিশ্বকাপ কেড়ে নিয়েছিল একজনের প্রাণও। গ্রুপপর্বে রোমানিয়ার বিপক্ষে অসাধারণ খেলার পরও কলম্বিয়া হেরে যায় এক আত্মঘাতী গোলে। নিজ দলের জালে বল জড়ান আন্দ্রেস এস্কোবার। সেই ম্যাচ হেরে দ্বিতীয়পর্ব থেকে বাদও পড়ে কলম্বিয়া। বিশ্বকাপ শেষে নিজ দেশে এক পানশালায় এস্কোবারকে গুলি করে হত্যা করে একদল দুর্বৃত্ত। যার মূল হোতা ছিলেন কুখ্যাত ড্রাগলর্ড পাবলো এস্কোবার!

ফাইনাল
ব্রাজিল ও ইতালি দুই দলই ফাইনালে উঠেছিল তাদের সেরা খেলোয়াড় রোমারিও এবং বাজ্জিওর চোট নিয়ে। তাতে প্রভাব পড়ে ম্যাচেও। টুকটাক আক্রমণ থাকলেও গোল পায়নি কোনো দলই। শেষপর্যন্ত ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকে। যেখানে ৩-২ ব্যবধানে ইতালিকে হারিয়ে নিজেদের চতুর্থ বিশ্বকাপ ঘরে তোলে সেলেসাওরা।

এক টাইব্রেকই সারাজীবন আক্ষেপ হয়ে থাকবে বাজ্জিওর

এক নজরে ১৯৯৪ বিশ্বকাপ
বিশ্বকাপের স্বাগতিক ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। খেলেছে ২৪ দল। ওই বিশ্বকাপ অভাববোধ করেছে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মত দুই জায়ান্টের। ৫২ ম্যাচে গোল হয়েছে ১৪১টি, ২.৭১ গড়ে। সবচেয়ে বেশি গোল সুইডেনের, ১৫টি। ওই বিশ্বকাপেই জার্সিতে খেলোয়াড়দের নাম লেখার প্রথা শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্র-সুইজারল্যান্ডের ম্যাচটি ফুটবল ইতিহাসের প্রথম ইনডোর ফুটবল ম্যাচ। খেলা হয়েছে ৯টি স্টেডিয়ামে। দর্শক টানার দিক থেকে নতুন রেকর্ড গড়ে ৯৪ বিশ্বকাপ। গড়ে ৬৮ হাজার ৯৯১ দর্শক দেখেছেন প্রতিটি ম্যাচ।

সেই বিশ্বকাপেই সবচেয়ে বেশি বয়সে গোল করার রেকর্ড গড়েন ক্যামেরুনের রোজার মিলা, ৪২ বছর বয়সে। খেলোয়াড়দের জার্সির সঙ্গে মিলজনিত সমস্যা এড়াতে প্রথমবার ভিন্ন ভিন্ন জার্সি পরেন রেফারিরা। চ্যাম্পিয়ন দল ব্রাজিল, রানার্সআপ ইতালি। আর বুলগেরিয়াকে ৪-০ গোলে উড়িয়ে তৃতীয় হয় সুইডেন।

আসরের সেরা খেলোয়াড়
আসরে গোল্ডেন বুট ভাগাভাগি করেছেন দুজন। বুলগেরিয়ার হ্রিস্টো স্টইচকভ ও রাশিয়ার ওলেগ সালেঙ্কো। দুজনের গোল সংখ্যা সমান ৬টি। সালেঙ্কো ক্যামেরুনের বিপক্ষেই করেছিলেন এক ম্যাচে পাঁচ গোল।

Exit mobile version