আমীরুল যখন জানালো তারিক সুজাতের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান জার্নিম্যান থেকে আলী ইমাম-এর একটা সুদৃশ্য মনোরম বই প্রকাশিত হয়েছে তখন প্রথমেই আমার মনে হলো, তারিক সুজাতের জার্নিম্যান থেকে চমৎকার একটা বই কবে বের হবে? আলী ইমামের বই ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’ এখনো চোখে দেখিনি। তবে । অনুমান করি লেখা যেমন সুন্দর হবে তেমনই বইটাও অসাধারণ হবে এর মুদ্রণ সৌকর্যে।
তারপর আমীরুল বলল, তারিক সুজাত বইটা নিয়ে হাসপাতালে ছুটে গেছে। আলী ইমাম ভয়াবহ অসুস্থ। শুভ্র বিছানায় শায়িত। আপাতত চলৎশক্তিহীন। বইটা তার সামনে মেলে ধরেছে তারিক সুজাত। আলী ইমাম ভাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছেন বইটার দিকে। সেই মুহূর্তে তার চোখ দুটো উজ্জ্বলতায় চিকচিক করে উঠেছে। কিন্তু আলী ইমামের আনন্দের পরিমাণটা বোঝা যায়নি। তারিক বইটা দ্রুততার সঙ্গে প্রকাশ করেছে। শুধুমাত্র বইটা আলী ইমামকে দেখানোর জন্য । তবে অনুমান করি বাবা যেমন নিজ সন্তানকে কাছে পেলে খুশি হয়ে ওঠে আদর করে-আলী ইমামও তাই করেছেন।
আমার তখন মনে পড়ে গেল পুরনো দিনের কথা। আলী ইমামের প্রথম বই প্রকাশিত হয়েছে ১৯৭৬ সালে। বইয়ের নাম দ্বীপের নাম মধুবুনিয়া। প্রকাশক বর্ণমিছিল। অসাধারণ ছাপা। সাধারণ প্রচ্ছদ। কিন্তু আমাদের কাছে তখন সেটা অসাধারণ ব্যাপার। প্রথম বই। আমরা প্রত্যেকে আনন্দিত। বইয়ের প্রচ্ছদে ফ্ল্যাপ লিখে দিয়েছেন কবি শামসুর রাহমান। তারপর আলী ইমামের একের পর এক ৬০০ এর অধিক বই প্রকাশিত হয়েছে। আমার মনে হয়, আলী ইমামের মতো এত অধিক সংখ্যক বই দুই বাংলায় আর কারো নেই।
প্রচণ্ড কর্মবীর মানুষ আলী ইমাম। একই সাথে দুই হাতে লিখছেন। একই সাথে টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাণ করছেন। কখনো অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে ছুটছেন। আশ্চর্য রকমের পরিশ্রমী তিনি। দ্রুত কাজ করার ক্ষমতাও তীব্র। এমন ক্ষমতা আর কারো আছে কিনা জানি না। বাংলাদেশ টেলিভিশনে অসংখ্য লাইভ অনুষ্ঠানের প্রযোজক তিনি। অনেক অনুষ্ঠান আছে যে অনুষ্ঠানে প্রচারের সময় মিউজিক যুক্ত হয় কিংবা কোনো নাটকের সংলাপ সরাসরি প্রচার হয়েছে। কিন্তু আমার মনে পড়ে আলী ইমাম ৪০ মিনিটের একটা প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণ করেছেন সুন্দরবনের উপর। এডিটিং করতে দেরি হয়ে যায়। তখন আলী ইমাম অনএয়ারে সুন্দরবন সম্পর্কে ধারা বর্ণনা দিয়ে যান অনর্গল। বিটিভিতে এমন ঘটনা আলী ইমামের পক্ষেই সম্ভব। বিটিভির যে কোনো অনুষ্ঠান সম্পর্কেই আলী ইমামের স্বচ্ছ ধারণা ছিল। তিনি যেমন অসংখ্য অনুষ্ঠান নির্মাণ করেছেন তেমনি অসংখ্য অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছেন। অনুষ্ঠান উপস্থাপনার জন্য কখনো তাকে সুট প্যান্ট বা পাজামা পাঞ্জাবি পরতে দেখিনি। তিনি সাধারণভাবে যে প্যান্ট বা হাওয়াই শার্ট পরে আছেন তা পরেই ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে যেতেন। শুধু এলোমেলো অবাধ্য চুলগুলো ঠিক করে নিতেন। সাধারণ ভঙ্গিতে কত যে অসাধারণ কথা বলেছেন অনএয়ারে তার হিসাব নাই।
আলী ইমামের দ্বিতীয় বই ‘অপারেশন কাঁকনপুর’। কিশোরবাংলা ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালে। বই বের হয় ১৯৭৯ সালে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে তখন রোববারে ‘এ সপ্তাহের নাটক’ প্রচারিত হতো। খুব জনপ্রিয় ছিল সপ্তাহের নাটক। সেই স্লটে অপারেশন কাঁকনপুর নাটক হিসেবে প্রচারিত হয়। নাটকটি প্রযোজনা করেন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। নাট্যরূপ দেন বিখ্যাত নাট্যকার মমতাজউদদীন আহমদ। সেই প্রথম বড়দের স্লটে ছোটদের নাটক প্রচারিত হয়। ছোটদের অনুষ্ঠান প্রচার হয় সাধারণত বিকেলে। কিন্তু নাটকটি প্রাইমটাইমে প্রচার হয়। সে যুগে ব্যাপারটা অনেক বড়। আজকাল ঈদ বা পূজা সংখ্যায় ছোটদের উপযোগী উপন্যাস বা কোনো লেখা ছাপা হয়। বিটিভিতে সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই অপারেশন কাঁকনপুর প্রচারিত হয়েছিল।
আলী ইমাম এর সঙ্গে প্রথম কবে দেখা হয়েছিল? স্পষ্ট মনে পড়ে ডিআইটির বারান্দায়। তখন ঢাকা কেন্দ্র টেলিভিশনের কার্যালয় ছিল ডিআইটি ভবন। তখন ‘অমর কাহিনি’ নামে একটা সিরিজ নাটক প্রচার হতো। শিশু কিশোরদের উপযোগী নাটক। প্রযোজনা করতেন খালেদা ফাহমী। এই সিরিজের একটা পর্ব ছিল কলম্বাস। কলম্বাসের ছেলেবেলার চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ডাক পড়েছে আমার। মূল চরিত্রে অভিনয় করেন ঢাকার চলচ্চিত্রের খলনায়ক বাবর। কলম্বাসই ছিল তার অভিনীত প্রথম টিভি নাটক। চিত্র পরিচালক ছোটকু আহমেদের ছোটভাই দোদুল আহমেদও সেই নাটকে অভিনয় করেন। তখন সেই ষাট দশকের মাঝামাঝি এইসব অনুষ্ঠানও সরাসরি প্রচার হতো। একদিন বিকেলে বাবার সাথে বিটিভিতে যাই নাটকের স্ক্রিপ্ট আনতে। হাতের লেখা পা-ুলিপি। স্পষ্ট ঝকঝকে হাতের লেখা। পরদিন রিহার্সেল হতো। রিহার্সেল দেখার জন্য এলেন মুস্তাফা মনোয়ার। প্রযোজক খালেদা ফাহমী তো ছিলেনই। প্রথম রিহার্সেলের সময় দেখলাম একজন তরুণ একটু দূরে চুপচাপ বসে আছে। তিনি কোনো অভিনয়ে অংশ নিলেন না। রিহার্সেল শেষে প্রযোজক খালেদা ফাহমী পরিচয় করিয়ে দিলেন, এই হচ্ছে নাট্যকার। ইনার নাম আলী ইমাম। আলী ইমামের নামের সাথে আমি খুবই পরিচিত। দৈনিক ইত্তেফাকের কচি কাঁচার আসরে তার লেখা নিয়মিত ছাপা হয়। আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে সে কথা তাকে জানালাম। আলী ইমাম তখন ততধিক উচ্ছ্বাস নিয়ে বললেন, তোমার ছবি ‘প্রেসিডেন্ট’ মুক্তি পাওয়ার পর গুলিস্তানে আমি লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কেটে দেখেছি। আমাদের দেশে প্রথম ছোটদের ছবি।
প্রথমদিনেই আমরা পরস্পরের আপন হয়ে গেলাম। সেই বন্ধন আজও অটুট হয়ে আছে। রিহার্সেলের মধ্যে একদিন আলী ইমাম বললেন, তোমার মা তো বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন। তুমি তো বই পড়তে ভালোবাসো। একদিন তোমাদের বাসায় যাব। তোমার মায়ের সঙ্গে পরিচিত হবো।
তিনি আরও বললেন, আমিও বই পড়তে ভালোবাসি। পুরনো বই, পত্র-পত্রিকা আছে। ১৯৫২ সালের ‘দেশ’ পত্রিকা আছে আমার কাছে। দেবসাহিত্য কুটিরের বেশ কয়েকটি পূজাবার্ষিকী আছে।
আমি বললাম, আমিও একদিন আপনার বাসায় যেতে চাই। নিশ্চয়ই। আমি তো খুব কাছেই থাকি। হাঁটাপথে যাওয়া যায়। আজকেই চলো। সেই বিকেলেই গেলাম ৮৬ ঠাটারিবাজারে। বাসার নিচে বিশাল প্রেস। ঘটাং ঘটাং শব্দে ছাপা চলছে। প্রেসের প্রতি তখন আমাদের দুর্বলতা। প্রেসে বই ছাপা হয়। সেই বই আমরা পড়ি। সরু সিঁড়ি বেয়ে আমরা ছাদে গেলাম। ছাদের ওপর একটা ঘর। চিলেকোঠা। ঘরে প্রবেশ করেই বিস্ময়ের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। চারপাশে বই আর বই। চেয়ার টেবিল আর ছোট্ট একটা চৌকি পাতা। বইয়ের স্তুপে প্রবেশ করে মন আনন্দে নেচে উঠল। সিঁড়ি দিয়ে যখন উপরে উঠছিলাম তখন তার বাবার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। তিনি নরম সুরে বলছেন, হেলাল তুই ফিরেছিস!
সেই প্রথম জানলাম আলী ইমামের ডাকনাম হেলাল। তারপর থেকে তিনি আমাদের প্রিয় হেলাল ভাই হয়ে উঠলেন।
ঠাটারিবাজারের সেই চিলেকোঠায় বহুবার গিয়েছি। প্রতিবার বিস্মিত হতাম বইয়ের সংগ্রহ দেখে। শুধুই ভাবতাম, একটা মানুষ এত বই কিভাবে সংগ্রহ করে। কিভাবে পড়ে শেষ করে। সেই বিস্ময় আজও কাটেনি।
একবার কলকাতা যাচ্ছি। যাবার সময় হেলাল ভাইকে বললাম, কিছু লাগবে হেলাল ভাই? কি নিয়ে আসব আপনার জন্য?
হেলাল ভাই আমাকে একটা ঠিকানা দিলেন। এখানে তুমি পুরনো সন্দেশ পত্রিকা পাবে। আমার জন্য কিছু পরিমাণ সন্দেশ নিয়ে এসো। এই হচ্ছে হেলাল ভাই। তিনি বই চাইতেন। বই ও পত্রিকার প্রতি তার গভীর ভালোবাসা।
আলী ইমাম ভাইয়ের সাথে আমাদের বয়সী সবারই অনেক অনেক স্মৃতি। তিনি সব বয়সী মানুষের বন্ধু হতে পারেন। এ এক আশ্চর্য গুণাবলী। তার সমসাময়িক বন্ধুরা মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর, শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন, ভূঁইয়া ইকবাল, আল মাহমুদ, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু প্রমুখ দীর্ঘ তালিকা। ঈষৎ অনুজদের মধ্যে নায়ক আফজাল হোসেন, ইমদাদুল হক মিলন, আবদুর রহমান, সাইফুল আলম, হাসান হাফিজ, লুৎফর রহমান রিটন, আমীরুল ইসলাম থেকে শুরু করে আনজীর লিটন পর্যন্ত তার বন্ধু। সবাই আলী ইমামকে কাছের মানুষ প্রিয় মানুষ মনে করে। তাদের প্রত্যেকের সাথেই আলী ইমামের হাজার হাজার স্মৃতি। তার অগ্রজদের সঙ্গেও তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। কবি শামসুর রাহমান, তার ঠাটারিবাজারের বাসায় একসময় নিয়মিত যেতেন। রিকশায় চড়ে তারা দুজন পুরনো ঢাকা ঘুরেছেন। আলী ইমাম খুব ভোজনরসিক। ঘুরে ঘুরে খেতেন। নবাবপুরে নামকরা পাগলার গ্ল্যাসি, সাইনু পালোয়ানের বিরানি কিংবা গেন্ডারিয়ার সুতলী কাবাব থেকে শুরু করে কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের কোন রেস্তোরাঁর বয়স একশো বছর। এইসব ছিল তার নখদর্পনে।
আলী ইমাম এর সাথে এত স্মৃতি। কোনটা রেখে কোনটা লিখি। লিখতে লিখতে পত্রিকার পাতা ফুরিয়ে যাবে কিন্তু স্মৃতি শেষ হবে না।
আলী ইমাম নিজেকে টেলিভিশন ও লেখালেখির বাইরে অনেক কাজে সংযুক্ত রাখতেন। কচিকাঁচার মেলা, চাঁদের হাট, শিশুসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা নগর জাদুঘর, গণহত্যা জাদুঘর নানা সংগঠনে তিনি কাজ করে থাকেন। মন্তাজ নামে প্রথম দিকে একটা সিনে ক্লাব তৈরি করেন তারা। চলচ্চিত্র আন্দোলনের সঙ্গেও ছিলেন। ভারতীয় দূতাবাসে চলচ্চিত্র কোর্সে সতীশ বাহাদূরের কাছে হাতে কলমে ট্রেনিং নেন। সেই কোর্সে সবচেয়ে উজ্জ্বল ফলাফল ছিল আলী ইমামের। জনপ্রিয় ‘এপার ওপার’ ছবির চিত্রনাট্য তার লেখা। সত্যজিৎ রায়ের অসম্ভব ভক্ত তিনি। জীবনজুড়ে তিনি সত্যজিৎ চর্চা করেছেন। রূপোলি ফিতে নামে চলচ্চিত্রের বই লিখেছেন। আর সত্যজিৎ রায়ের উপর দশ বারোটা বইও রয়েছে তার। এমনই চলচ্চিত্র পাগল আলী ইমাম।
লেখাটা লিখতে গিয়ে বারবার মনে হচ্ছে এই লেখা কি আলী ইমাম পড়তে পারবেন? পড়ে হেসে উঠবেন? কাঁধে হাত রেখে বলবেন, আরে সাগর একসাথে আমাদের জীবনটা কেটেই গেল। চোখে এখন চালশে পড়েছে। বয়স হয়েছে। স্মৃতির ভেতর চলে যাচ্ছি আমরা।
কিন্তু আর কি এমন সুস্থভাবে দেখা হবে আলী ইমামের সাথে?
প্রার্থনা করি, খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন আলী ইমাম। আমার লেখাটা পড়বেন। চোখ বড় বড় করে আনন্দের সাথে বলবেন, নিজেরাই নিজেদের নিয়ে লেখা শুরু করে দিলে সাগর?
আমি কি তখন বলতে পারব আপনার কাজের কথা লিখলে তো সেটা মহাকাব্য হয়ে যাবে। তাই লেখাটা আপাতত এখানেই শেষ করছি। কিন্তু তার যারা বন্ধু ছোটভাই স্থানীয় তাদের বলব, আলী ইমামের বিশাল কর্মময় জীবনের কথা। তার প্রতিভার কথা। নতুন প্রজন্মকে অবশ্যই জানানো প্রয়োজন।