সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে হারানো জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি বলে মন্তব্য করেছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্মরণে নাগরিক স্মরণ সভায় আগত তার দীর্ঘ দিনের সহযোদ্ধা ও রাজনৈতিক সহকর্মীরা। তারা বলেছেন: তিনি শুধু একজন সংসদ সদস্যই ছিলেন না; তিনি নিজেই একটি ইনস্টিটিউট। আমরা চাইলেই তার শূন্যস্থান পূরণ করতে পারবো না।
আজ বৃহস্পতিবার বিকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নাগরিক কমিটি আয়োজিত স্মরণ সভায় বক্তারা এ কথা বলেন।
স্মরণ অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তারা দীর্ঘদিনের বন্ধু ও সহযোদ্ধা শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন: স্বাধীনতার পর আমি পার্লামেন্টে এসেছিলাম বরিশাল থেকে আর সুরঞ্জিত এসেছিলেন সিলেট থেকে। আমাদের মধ্যে একটা পার্থক্য ছিলো! আমি ছিলাম আওয়ামী লীগের সাংসদ আর তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র। সেই সময় স্বতন্ত্র থেকে পাশ করে আসা খুব একটা সহজ ছিলো না। তারপরও পার্লামেন্টে তার ভূমিকা ছিলো সব সময় অন্যাদের থেকে আলাদা। অনেক সময় দেখা গেছে- তিনি বঙ্গবন্ধুরও বিরোধিতা করতেন। তাতে কিন্তু বঙ্গবন্ধু মনক্ষুণ্ণ হতেন না। সব সময় কাছে ডেকে তার কথা শুনতেন।
ন্যাপ থেকে তিনি এসেছিলেন। কিন্তু আমাদের আদর্শিক জায়গা ছিলো এক। আমরা যেমন অসাম্প্রদায়িক উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতাম, তিনিও তাই। তাকে হারিয়ে আজ আমরা দিশেহারা। পার্লামেন্টে তার শূন্যতা আজ আমরা অনুভব করছি। চাইলেই তার মতো একজন অভিজ্ঞ পার্লামেন্টেরিয়ান আমরা পাবো না।
৭২’র সংবিধান ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রেও তার ছিলো অগ্রণী ভূমিকা। সুযোগ থাকলেও রাষ্ট্র ধর্ম ইসলামকে আমরা বাদ দিতে পারিনি। সংবিধান সংশোধন কমিটির কো-চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি একক সিদ্ধান্তে ইসলামকে বাদ দিতে প্রস্তুত ছিলেন। আমরা অনেক কষ্টে বুঝিয়ে তাকে রাজি করাই। কো-চেয়ারম্যান হলেও প্রকৃত অর্থে তিনিই ছিলেন চেয়ারম্যান! কেননা, চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী অসুস্থ থাকায় সবকিছু তাকেই দেখতে হয়েছে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট যখন গ্রেনেড হামলা হলো, আমি আর সুরঞ্জিত ট্রাকের কাছেই ছিলাম। দু’জনই আহত হয়েছিলাম। আজ তার না থাকার দিনে তাকে আরও বেশি মনে পড়ছে।
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে তিনি সবসময় সোচ্চার ছিলেন।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন তার বক্তৃতায় বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দিন গুলো স্মরণ করেন। তিনি বলেন: আমরা স্বাধীনতার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি করেছি। স্বাধীনতার পর এক সঙ্গে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন করেছি। তার মতো জ্ঞানী লোক আমি খুব কম দেখেছি। পার্লামেন্টের অধিবেশন থাকলে আগের রাতে তার বাসায় চলে যেতাম। আগামীতে কি হতে পারে এবং কি আলোচনা করা উচিত আমরা আলোচনার মধ্যদিয়ে আগেই ঠিক করে রাখতাম।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শুধু একজন সংসদ সদস্য নয়, অন্যান্য সাংসদের জন্য শিক্ষক ছিলেন মন্তব্য করে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী শ্রী বীরেণ শিকদার বলেন: ৯৬-এ আমি যখন পার্লামেন্টে সদস্য হয়ে এলাম। অভিভাবক হিসেবে সুরঞ্জিত দাকে পেলাম। পার্লামেন্ট সংক্রান্ত কোনো সমস্যায় তিনি চটজলদি সমাধান দিতেন। দেখা যাচ্ছে, আমরা কোনো আইন সম্পর্কে বুঝতে পারছিনা, তার কাছে চলে যেতাম। তার কোনো বই লাগতো না। তিনি ছিলেন নিজেই একটি ইনস্টিটিউট। যেকোনো বিষয়ে বই ছাড়াই ব্যাখা দিয়ে আমাদের বুঝিয়ে দিতেন।
যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথ বলেন: তার অভাব প্রতিটা ক্ষেত্রে অনুভব হবে। তিনি ছিলেন আমাদের অভিভাবকের মতো। যেকোনো সমস্যায় আমরা তার পরামর্শ পেতাম।
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন: আমরা দু’জনেই প্রথম থেকেই বাম রাজনীতি থেকে এসেছি। আমাদের গড়ে উঠাটাও ওই আদর্শ থেকে। তিনি সব সময় চাইতেন, অসাম্প্রদায়িক এক বাংলাদেশ। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই। তবে, সাম্প্রদায়িক শক্তি এখনও আমাদের গ্রাস করতে চাইছে। তার অসমাপ্ত কাজ এখন আমাদের শেষ করতে হবে।
স্মরণ সভায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকী, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি রামেন্দু মজুমদার, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন এবং সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের সহধর্মিনী জয়া সেন গুপ্ত।