আমরা বারবারই বলবো এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আঠারো কোটি মানুষের মাঝে কেউ না কেউ অসবাদগ্রস্ত হবে। একটি নির্দিষ্ট হারে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা পড়বেই। একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক নারী লাঞ্ছিত হবে, আত্মহত্যা করবে। বহু মনুষেরই হতাশার পারদ উপরে উঠবে। এসব স্বাভাবিক বিষয়। তাই কেউ যখন অবসাদগ্রস্থ হয়ে ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা করেন তখন আমরা নিশ্চিত হই আমরাও একই পথের পথিক হতে পারি। কেউ যখন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে শরীরে আগুন ধরিয়ে আত্মহনন করেন তখন আমাদেরও এমন পরাজয় কিংবা আত্মঘাতি সাহসের পারদ উপরে উঠতে থাকে। আমরা শুধু ভাবতে থাকি, এই কাজটিও তাহলে খুব বেশি কঠিন নয়। এমন ঘটনা চাইলেই ঘটানো সম্ভব। কেউ আমাকে আটকাবে না। আমি আমার যাবতীয় ক্ষতি ও হতাশার ঘোষণা দিয়ে আমাকেই আগুনের জন্য প্রস্তুত করতে পারি। আমি সুবিচার দাবি করে নিজেরই কবর খুঁড়তে থাকি।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের জায়গাটি গনগনে গরম। সাধারণের বিশ্বাস এখানে দাঁড়িয়ে যে কোনো কথা বললে তা সরকারের কাছে পৌঁছে যায়। আমিও বহু বছর আগেই দেখেছি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে চার পাঁচজন কোনো ব্যানার নিয়ে দাঁড়ালেই তা পুলিশের বিশেষ শাখা, গেয়েন্দা শাখায় রিপোর্ট হয়ে যায়। তার মানে সরকারের নজরদারির মধ্যে চলে আসে। কথাবার্তা হুঁশঁজ্ঞান করে বলার ব্যাপার থাকে। বেশি হার্ডলাইনে গেলে ঝামেলার আশংকা থাকে। আমরা ভেবে নেই বিদ্যুৎ গতিতে সবকিছু ঘটে যায়। কিন্তু আসলে কী ঘটে?
সাবেক ছাত্রনেতা গাজী আনিস জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে দেশ জাতিকে তার ব্যক্তিগত একটি সংকটের চিত্র উপস্থাপন করে, কোথাও কোনো আশার আলো না দেখে এমন বিপন্ন জীবনের ভার আর বহন না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। আমরা তথাকথিত সচেতন মানুষেরা বলি, আত্মহত্যার মতো বোকামি না করলেও হতো। কি এমন হয়েছিল যে আত্মহত্যা করতে হবে? যা হয়েছিল, তার তো বিচার হতে পারতো! সে তো সরকারের প্রভাবকে অনেক বেশি কাজে লাগাতে পারতো। আর সরকারি প্রভাব সঙ্গে থাকলে তার তো অনেক কিছু করার সুযোগ থাকে। বাইরে থেকে বা দূর থেকে আমরা এভাবেই ভাবি। বাস্তবতা হলো সরকারি প্রভাব সবাই খাটাতে চাইলেই পারে না। রাজনীতির মাঠ আর সরকারি প্রভাব কাজে লাগানো এক জিনিস নয়। দুটির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। কাজী আনিস দুর্দিনের ছাত্রনেতা। সুদিনের রাজনীতি তার জানা ছিল না হয়তো। জানা থাকলেও সমুদ্রের কোনো ঢেউয়ে হয়তো উপরে উঠেছিলেন, তারপর আরেক ঢেউয়ে হয়তো তলিয়ে গেলেন। কিন্তু তার আত্মহননটা মেনে নেয়া যায় না। একটি উন্নয়নে অগ্রসরমান দেশে এমন হতাশা ও আত্নহনন খুব খারাপ ইঙ্গিত বহন করে।
ক্ষমতা ও প্রভাব বলয়ে জীবন বড়বেশি কক্ষচ্যুত হয়। পুঁজিনির্ভর সমাজ বাস্তবতায় অন্ধকারে টাকা গোছানোর কাজটি এখন পৃথিবীর অগণন মানুষের কাছে সবচেয়ে মধুময় ভাগ্যোন্নয়ন। আমরা যাকে বলি জীবন জীবিকা। এই জীবন জীবিকার পথে প্রতি সেকেণ্ডে প্রতিযোগিতা আছে। প্রতিমুহূর্তে আছে পুলসিরাত। সবার অগোচরেই কত মানুষ যে পুলসিরাত থেকে টুপ করে আগুনে বা সাগরে ঝরে পড়ছে তার হিসাব নেই। এই জায়গাতেই বড় বেশি হতাশা দানা বেঁধে যায়। উচ্ছ্বল উদ্যোমী মানুষ হঠাৎ হতোদ্যম হয়ে পড়ে। চোখের সামনে ভেসে ওঠা নিজের দ্রুত ভাগ্য উন্নয়নের পথগুলো অচেনা হয়ে যায়। চোখের পলকেই লোকটি কিনারাহীন পাথারে পড়ে যায়। গাজী আনিস শরীরে আগুন লাগিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়ার পর আমার প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুদের কেউ কেউ বলছেন, তিনি কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ ছিলেন। তারও অনেক ঝামেলা ছিল।
কী ঝামেলা ছিল? তিনি হেনোলাক্স কোম্পানিতে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে সেই টাকা আর ফেরত পাচ্ছিলেন না বলে অভিযোগ করেন। সঙ্গে আরো নানান গল্প থাকতে পারে। নানা তথ্য থাকতে পারে। এইসব অজানা ও কাল্পনিক অনেক তথ্যের ভিত্তিতে আমরা তার ঝামেলা খুঁজতে পারি। কিন্তু বাস্তবতা হলো প্রতিদিন এমন অসংখ্য গাজী আনিস বিচারের আশায় দ্বারে দ্বারে ধর্না দিচ্ছেন। বিপন্ন বিধ্বস্ত হয়ে ঘুরছেন। পরিবার পরিজন নিয়ে অকুল পাথারে পড়ছেন, তারা শুধু আত্মহত্যার পথটি বেশি নিচ্ছেন না। জীবনের অনেক বিপর্যয় মাথায় করে তারা টিকে আছে।
এক বছরে দুজন বিপন্ন বিধ্বস্ত গার্মেন্টস ব্যবসায়ীর সঙ্গে আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছে। যারা ব্যবসায় প্রতারিত হয়ে নিঃস্ব হয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। যারা আইন ও বিচারের সুনজর পেলেই জীবনের সৌন্দর্যের প্রতি বিশ্বাস হারাতেন না। অনেক মানুষকেই গুমরে কাঁদতেও দেখি। এদের ভেতরেই কেউ কেউ আত্মহননের পথ বেছে নেয়া ছাড়া আর উপায় দেখেন না।
সময়কে দুঃসহ হয়ে ওঠা থেকে বাঁচাতে হবে। গাজী আনিসের ঘটনাটিকে বাতাসে মিলিয়ে যেতে দেয়া যাবে না। ঘটনার গভীরে যেতে হবে। সত্য বের করে আনতে হবে। দায়ির সাজা নিশ্চিত করতে হবে। তার পরিবার পরিজনের পাশে দাঁড়াতে হবে। সরকারকেই দেখাতে হবে কাজগুলো। আমাদের সাংবাদিকদের সামিল থাকতে হবে সত্য বের আনার অভিযানে, স্রোতে মিলিয়ে যাওয়ার নয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)