আজ সেই ভয়াল ২৯ সেপ্টেম্বর। ২০১২ সালের এই দিনে সাম্প্রদায়িক উগ্রপন্থীরা ঝলসে দিয়েছিল কক্সবাজারের রামু উখিয়ার বৌদ্ধ বিহার ও পল্লী। বিভীষিকাময় সেই রাতে আগুনের লেলিহান শিখা থেকে প্রাণে বাঁচতে দিগবিদিক ছোটাছুটি করেছিলেন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের হাজারো অসহায় নারী-পুরুষ। ভোর হতেই তারা হারিয়ে ফেলেন জীবনের যা কিছু অর্জন। ভেঙ্গে যায় শত বছরের সাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য। প্রিয় আরাধনার স্থান ভেঙ্গে ধংসস্তুপে পরিণত হয়। সেই কাল রাতের কথা মনে করে এখনো আতঁকে ওঠেন কক্সবাজারের বৌদ্ধ সম্প্রদায়।
ঘটনার ৭ বছর পূর্ণ হলেও এখনো ধরা পড়েনি মূল হোতারা। তাই এখনো শংকা কাটছে না বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের। তবে খুব সল্প সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও পুড়ে যাওয়া মন্দির বিহার এবং বসতবাড়ী আধুনিক নকশা ও শৈলীতে দৃষ্টিনন্দন করে সংস্কার আর পুনর্নির্মাণ করে দেয়ায় খুশি বৌদ্ধ সম্প্রদায়।
রোববার নানা আয়োজনে এ কাল দিনটিকে স্মরণ করবে কক্সবাজারের বৌদ্ধ সম্প্রদায়। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ফেসবুকে একটি ছবি ট্যাগ করাকে কেন্দ্র করে রামুর বিহার ও বসতিতে হামলা অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ও লুটপাট চালানো হয়। সেই রাতে ধর্মান্ধতার আগুনে পুড়ে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় এ বিহারগুলো। পুড়ে ছাই হয় হাজার বছরের পুরনো বৌদ্ধ পাণ্ডলিপি। লুট হয় প্রাচীন ও দূর্লভ অনেক বৌদ্ধ মূর্তি। এর পরের দিন ৩০ সেপ্টেম্বর একই ধরনের হামলা সংঘটিত হয় উখিয়ার বিহারে।
এই দুই দিনে রামু ও উখিয়ার ১৯টি বৌদ্ধ বিহার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ১৮টি মামলা করেন। অপর একটি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি বাদী হয়ে মামলা করলেও পরবর্তীতে বিবাদীদের সঙ্গে আপোষ নামা দিয়ে খালাস করেছেন। বিচারাধীন ১৮টি মামলায় সাক্ষী না পাওয়ায় বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘসূত্রিতা। এ নিয়ে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছুটা হতাশা আর আতঙ্ক রয়েছে। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতা অলক বড়ুয়া বলেন, সমস্যা না হলেও আমরা একটু শঙ্কিত। কারণ মূল আসামি যারা তারা এখনো ধরা ছোয়ার বাইরে। সেজন্য আমরা শঙ্কিত।
একই রকম আতঙ্ক থাকার কথা জানিয়ে রামু সীমা বিহারের সাধারণ সম্পাদক তরুণ বড়ুয়া বলেন, মিয়ামনার থেকে রোহিঙ্গাদের ঢল আসার পর থেকে আমরা আতঙ্কের মধ্যে আছি।
ঘটনার ১১ মাসের মাথায় বৌদ্ধ বিহার ও বসতির ক্ষতচিহ্ন মুছে নতুন করে তৈরি হয় এসব বিহার ও বসত বাড়ি। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে রামু ও উখিয়া উপজেলার ১৯টি বৌদ্ধ বিহার পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে এক বছর পার না হতেই দিগন্ত মাথা তুুলে দাঁড়িয়েছে নবনির্মিত বৌদ্ধ মন্দিরগুলো। এই নির্মাণ শৈলী বৌদ্ধদের হৃদয় মন্দিরে দিয়েছে দোলা। ভূলিয়ে দিয়েছে অতীতের সকল যাতনা। এ গুলো এখন পর্যটন স্পটে পরিণত হয়েছে বলে জানান কবি লেখক সুনিল বড়ুয়া। রামুর কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদের সহ সভাপতি সুনিল বড়ুয়া আরো বলেন, মাত্র এক বছরের মাথায় ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধ বিহারগুলো দৃষ্টিনন্দনভাবে পুনর্নির্মাণ করে দিয়েছে সরকার। এজন্য আমরা রামুর বৌদ্ধ সম্প্রদায় সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ।
রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের আবাসিক অধ্যক্ষ প্রজ্ঞানান্দ ভিক্ষু বলেন, বিচারাধীন ১৮টি মামলায় সাক্ষী না পাওয়ায় বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘসূত্রিতা। এ নিয়ে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছু হতাশা থাকলে ও এ ঘটনা যেন আর না ঘটে সেরকম দৃষ্টান্ত চান তারা।
একুশে পদকে ভূষিত বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু পণ্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের বলেন, আমরা এখনো আতঙ্কের মধ্যে রয়েছি। যদিও সরকার আমাদেরকে পাহারা দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। তবে আরো নিরাপত্তার প্রয়োজন বলে জানান তিনি।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, ২০১৭ সালে দেশে রোহিঙ্গা আসার পর বৌদ্ধ সম্প্রদায় কিছুটা আতঙ্কের মধ্যে থাকলেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর পদক্ষেপে তা স্বাভাবিক হয়ে যায়। এর পর থেকে বিহারসহ সব বৌদ্ধপল্লীতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। থানা পুলিশের পাশপাশি প্রতিটি বিহারে এপিবিএন দায়িত্ব পালন করছে।
রামু-কক্সবাজার সদর আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল বলেন, এ সহিংসতার সাথে জড়িতরা আজ ঘৃণিত,আজ তারা সবার কাছে অপরাধী।
রামুর ঘটনার ৭ বছর উপলক্ষ্যে দিনব্যাপী কর্মসূচি রয়েছে আজ। তার মধ্যে ভোর ৫ টায় বুদ্ধপূজা, সকাল ৭ টায় জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন, ৯টায় অষ্ট পরিষ্কার দান, দুপুরে অতিথি ভোজন, দুপুর ২ টায় শান্তি শোভাযাত্রা, সাড়ে ৩ টায় স্মরণসভা, সন্ধ্যা ৬ টায় মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও বিশ্বশান্তি কামনায় সমবেত প্রার্থনা। বৌদ্ধ মন্দিরে দেয়া আগুন নিভে গেছে। তাদের মনে যে ছাই চাপা আগুন ছিল তা নিভানোর লক্ষ্যে রামু হামলায় প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় আনার দাবি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের।