সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির বরখাস্ত হওয়া পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভুঁইয়া ধরা পড়েছেন। রায়হান আহমদ নামের একজন যুবককে পুলিশ ফাঁড়িতে পিটিয়ে হত্যার প্রধান অভিযুক্ত তিনি। ঘটনার পর তাকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, এরপর গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি পালিয়ে যান। পালিয়ে যাওয়ার প্রায় মাসাধিক সময় অতিবাহিত হলেও পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে পারছিল না। তিনি ভারত পালিয়ে গেছেন এমনই বক্তব্য ছিল পুলিশের। এনিয়ে সিলেটের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষেরা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছিল। নিহত রায়হানের পরিবারের সদস্যরাও বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন, তারা মন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করেছেন, দেখা করেছেন স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গেও। পরিবারের ওইসব কর্মসূচিতে স্থানীয় মানুষেরা একাত্মতা প্রকাশ করেছিল, তারাও অংশ নিয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচিতে। এমন অবস্থায় সোমবার এসেছে সুখবর। সিলেটের কানাইঘাট সীমান্ত এলাকায় কিংবা সীমান্তের ওপার থেকে ধরা পড়েন আকবর। এরপর তাকে বাংলাদেশের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আকবরকে হাতে পেয়ে সিলেট জেলা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে। এরপর রাতে জেলা পুলিশ সুপারের সংবাদ সম্মেলন করে গ্রেপ্তারের ক্রেডিট নেওয়ার চেষ্টার পর তাকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন ভারতে পালিয়ে যাওয়াকালে আকবরকে পুলিশ কর্তৃক গ্রেপ্তারের দাবি করেছেন। তার দাবি, ‘স্থানীয় কিছু বন্ধুর সহযোগিতায়’ পুলিশ আকবরকে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশ সুপারের দাবি, ‘আকবর কানাইঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে পারে এমন তথ্য আমরা পেয়েছিলাম। সেই তথ্যে রোববার থেকে কানাইঘাট সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়। সকালে সাদা পোশাকে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়।’ ওই সংবাদ সম্মেলনে সিলেটের এসপি তার দাবির স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, ‘সে আগে ভারতে পালিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসতে পারে। তবে আমরা তাকে সীমান্ত এলাকা থেকেই গ্রেপ্তার করেছি।’ এরআগে অবশ্য গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছিলো, রায়হান আহমদ মারা যাওয়ার দুদিন পরই আকবর সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ দিয়ে ভারতের মেঘালয়ে পালিয়ে গেছেন।
পুলিশ সুপারের এই দাবির সত্যতায় বিপত্তি ঘটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল আকবরকে আটকের কিছু ভিডিওচিত্রে। ওসব ভিডিওতে দেখা যায়, একদল যুবক আকবরের হাত-পা-কোমরে দড়ি দিয়ে বেঁধে পাহাড়ি ছড়া দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে আসছেন। এসময় ওই যুবকরা আকবরকে বিভিন্ন প্রশ্নও করেন। ওই যুবকদের বেশিরভাগই বাংলায় কথা বললেও তাদের শারীরিক গঠন ও কণ্ঠস্বর ছিলো অবাঙালিদের মতো। কানাইঘাট এলাকার স্থানীয় কয়েকজন জানিয়েছেন, ভিডিওতে যে যুবকদের দেখা গেছে তারা খাসিয়া সম্প্রদায়ের এবং যে জায়গার ছবি দেখা গেছে তা ভারতের অভ্যন্তরের। এছাড়া আটকের সময়ে ভেসে আসা বিভিন্ন কথাবার্তা খাসিয়াদের নিজস্ব ভাষা আর কিছু ছিল হিন্দি ভাষাতেও, আকবরও তাদের জিজ্ঞাসাবাদে কিছু হিন্দি শব্দ-বাক্য উচ্চারণ করেছেন। এ থেকে অন্তত পুলিশ সুপারের দাবিকৃত বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকা থেকে গ্রেপ্তারের সত্যতার প্রমাণ মেলে না।
আকবরকে আটক করা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একাধিক ভিডিও প্রকাশ হয়েছে। পুলিশ সত্যি সত্যি যদি ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময়ে তাকে গ্রেপ্তার করত তাহলে এইধরনের ভিডিওধারণ ও প্রচারের সুযোগ ছিল না। পুলিশ সুপার বলছেন, সাদা পোশাকধারী পুলিশ সদস্যরা তাকে গ্রেপ্তার করেছে, স্থানীয় কিছু বন্ধুর সহযোগিতায় পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে আকবরকে- এইধরনের বক্তব্য অসত্য প্রমাণ হয় মূলত ভিডিওধারণ ও ভিডিওচিত্র প্রকাশের ঘটনা থেকেই। পোশাকি কিংবা সাদা পোশাকধারী পুলিশের উপস্থিতি যদি সেখানে থাকত তাহলে অন্তত এইধরনের কিছু ঘটত না। এছাড়াও খাসিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে আলাপকালে আকবর পরিষ্কার করে জানিয়েছেন, ঊর্ধ্বতন একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার পরামর্শে গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি পালিয়ে যান। এই বক্তব্য আসতে পারে এমন সম্ভাবনা যখন থাকে তখন পুলিশের উপস্থিতি থাকলে আর যাই হোক কোনো ধরনের ভিডিওধারণ ও ভিডিওপ্রকাশ অসম্ভবই ছিল।
পুলিশের বহিষ্কৃত এসআই আকবর ধরা পড়ার যেসকল ভিডিওচিত্র প্রকাশিত হয়েছে তাতে করে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, এই ঘটনায় আসল নায়ক পুলিশ নয়, এটা সীমান্তের ওপারের খাসিয়াদের কাজ। তারা খুনে অভিযুক্ত বহিষ্কৃত এই পুলিশ সদস্যকে আটক করেই তাদের দায়িত্ব পালন করেনি, একই সঙ্গে মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তাদেরকে পানির বোতল এগিয়ে দিতেও দেখা গেছে আকবরকে, তারা তার ওপর নির্যাতন করেনি। ‘মাত্র ১০ হাজার টাকার জন্যে মানুষ মারছস’- এমন ক্ষোভোক্তি করলেও তারা আকবরের গায়ে হাত তুলেনি। তারা তাকে মারবে না বলেও আশ্বস্ত করেছে বারবার।
এখানে অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, সীমান্তের এপারে কিংবা ওপারের খাসিয়ারা আকবরকে চেনে কীভাবে? ফেসবুকে এমন মন্তব্যও করেছেন অনেকেই। অথচ এটা সাধারণ বোধজ্ঞানের বিষয় যে পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হানকে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যার ঘটনাটি সারাদেশে তুমুল আলোচিত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে এই ঘটনাটি সবাই জানে। সবাই আকবরের চেহারা সম্পর্কেও অবহিত-পরিচিত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের শক্তিশালী ভূমিকার এই সময়ে খুনে অভিযুক্ত ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ কারও চেহারা কেউ চিনবে না- এ ভাবনাটাই তো হাস্যকর।
আমি নিজে দেখেছি, শহুরে সমাজের চাইতে গ্রাম্যসমাজে যেকোনো আলোচিত ঘটনার রেশ অনেকদিন থেকে যায়। সিলেটের এমসি কলেজের সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা, ফাঁড়িতে পুলিশের নির্যাতনে রায়হান আহমদ নামের যুবককে হত্যার ঘটনা এখনও গ্রাম্যসমাজে আলোচিত বিষয়। গ্রামের হাটেবাজারে এখনও চায়ের কাপে ঝড় ওঠে ওইসব ঘটনার নানামুখী বিশ্লেষণে। সুতরাং প্রান্তিক অঞ্চলে কিংবা পাহাড়ের মানুষেরা যে কথিত সভ্য সমাজের নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা থেকে দূরে এটা ভাবা ঠিক হবে না।
হ্যাঁ, আকবর গ্রেপ্তার এড়াতে খাসিয়াদের মতো বেশ ধরেছিলেন। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া কয়েকটি ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, আকবরের মুখে দাড়ি। পরনে খয়েরি রঙের ফুল হাতা শার্ট। গলায় মালা। খাসিয়াদের বেশ ধরলেও খাসিয়ারা যে তাদের স্বজাতি চিনবে না এটা ভাবাই যায় না। এছাড়া পোশাকপরিচ্ছদ বদলালেও আদিবাসী খাসিয়াদের মত চেহারা বানানো সম্ভব ছিল না তার পক্ষে, সম্ভব না কারও পক্ষে। এতে করে চেহারা দেখেই ত তাদের বুঝা সম্ভব কে খাসিয়া আর খাসিয়া নয়?
বলছিলাম আকবরকে গ্রেপ্তার নিয়ে। পুলিশ বলছে- আকবরকে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওদিকে, ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একাধিক ভিডিও বলছে সীমান্তের ওপার থেকে খাসিয়ারা আকবরকে ধরে এনে বাংলাদেশের রহিম উদ্দিন নামের একজন যুবকের কাছে তুলে দিয়েছে। এখানে কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন এই রহিম উদ্দিন পুলিশের সোর্স নয় তো? হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। হতে পারে এই যুক্তিতে কারণ রহিম উদ্দিন আকবরকে বিজিবির কাছে তুলে না দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন। আবার রহিম উদ্দিন পুলিশ সোর্স নন এমন যুক্তিও আছে কারণ সীমান্ত এলাকায় নানামুখী বৈধ-অবৈধ বাণিজ্যে এপার-ওপারের মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে অনেকেই। এখানে খাসিয়াদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়ত আছে এই রহিম উদ্দিনের।
এখানে আকবরকে গ্রেপ্তার নিয়ে সিলেট জেলা পুলিশের বক্তব্য যে অসত্য ও গ্রেপ্তারের ক্রেডিট নেওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা সেটা প্রমাণ হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বক্তব্যে। বিজিবি’র ১৯ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাঈদ হোসেন বলেছেন, ‘আকবরকে ভারত সীমান্তের অভ্যন্তরে খাসিয়ারা আটক করেন। পরে তারা সীমান্ত এলাকার রহিম উদ্দিন নামের এক বাসিন্দার সঙ্গে যোগাযোগ করে সীমান্তেই আকবরকে তার হাতে তুলে দেন। রহিমই পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে আকবরকে পুলিশে হস্তান্তর করে।’ তিনি বলেন, ‘এটি সীমান্তের একটু দুর্গম এলাকা। আর বিএসএফ বা আমরা বিষয়টি জানার আগে স্থানীয়রাই হস্তান্তর করে ফেলেছেন।’
সিলেট জেলা পুলিশ কেন ক্রেডিট নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে- এমন প্রশ্ন ওঠতে পারে। একে ত এই ঘটনা সারাদেশে ব্যাপক আলোচিত। তার ওপর সাম্প্রতিক সময়ে সিলেটের একাধিক ন্যক্কারজনক ঘটনা সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। সিলেটের এমসি কলেজের সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার পর দেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনেরই পরিবর্তন করেছে সরকার। ফাঁড়িতে পুলিশের নির্যাতনে যুবক হত্যার ঘটনা একইভাবে আলোচিত হয়েছিল সারাদেশে। এমন অবস্থায় সিলেট জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে আগে প্রেসবিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলতেও হয়েছিল এমসি কলেজ ও বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি জেলা পুলিশের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় নয়, ওটা মহানগর পুলিশের। পাশাপাশি থাকা স্থানীয় পুলিশের দুই কর্তৃপক্ষের একটা যখন ‘নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার নামে নিজেদের সমালোচনা থেকে বাঁচতে মরিয়া ছিল’ তখন এই ঘটনার পর ওয়ান্টেড আকবর ধরা পড়ার ক্রেডিট নিয়ে নিজেদের অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাটাই করেছে কেবল। এখানে অবশ্য তাদের সফল হতে দিচ্ছে না ভাইরাল কিছু ভিডিও যেখানে পরিস্কারভাবে প্রমাণ হয় ধরা পড়ার ঘটনাটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হয়নি, হয়েছে ভারতের অভ্যন্তরে।
আকবর শেষ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন এটা স্বস্তির খবর। এই গ্রেপ্তারে একক কৃতিত্ব সীমান্তের ওপারের আদিবাসী খাসিয়াদের। তারা মানবিক, তারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাদেরকে সালাম।
খুনে অভিযুক্ত আকবরকে পালাতে যারা সহযোগিতা করেছিলেন, তারা তাকে পরামর্শ দিয়ে পালিয়ে যেতে উদ্ধুব্ধ করেছিলেন, তাদের নাম আমরা এখনও জানি না। আমাদের চাওয়া সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির। একই সঙ্গে চাওয়া ক্রেডিট নিয়ে অযথা কাড়াকাড়ি যেন না হয়। ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় আকবরকে গ্রেপ্তার করেছে সিলেট জেলা পুলিশ- এটা সত্য নয়। আমরা চাই অসত্যকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা যেন না হয়। দায়িত্বটা পুলিশের!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)