মনে পড়ে আব্বা, একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমরা এক সাথে গেলাম? আমি পড়তে আর তুমি পড়াতে। আমরা যে যার ক্লাসে, এমন সময় গণ্ডগোল শুরু! এরশাদ এর স্বৈর শাসনামলে যেটা হয় দাড়িয়েছিল নিত্যনৈমিত্তিক। গোলাগুলি হয়েছিল সেদিন। আমি বন্ধুদের সাথে আশ্রয় নিই আমাদের সেমিনার রুমে। উৎকণ্ঠিত হয়ে ছিলাম তোমার জন্য! পরিস্থিতি একটু শান্ত হতেই দৌড়ে যাই সাংবাদিকতা বিভাগে, চেয়ারম্যান এর ঘরের দরজায়ে কড়া নাড়ি! তুমি ওই ঘরে ছিলে আরও শিক্ষকদের সাথে, কি যে আশ্বস্ত হয়েছিলাম তোমাকে ওখানে পেয়ে! তুমি ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বলেছিলে “কোথায়ে আমি তোমার খোজ করব, না তুমি আমার খোঁজে ছুটে এসেছো!” তোমার কথায় আমার আশ্বস্ত হৃদয়ে একটু গর্ব বোধও যোগ হয়েছিল, নিজেকে দায়িত্বশীল ভেবে! এখন তোমার নাতনি যখন আমাকে আগলে রাখে, আমার পাশে এসে দাঁড়ায়, তোমার কথা অনেক বেশি মনে হয়, মনে হয় তুমিও আমার পাশে।
সেদিন আমরা বাড়ি ফিরেছিলাম দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলাপে। তুমি বলছিলে আর আমি শুধু গোল গোল চোখ করে আগ্রহ ভরে শুনেছি, আর ভেবেছি আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। যেখানে আমার আশার আলো ছিল ধিকিধিকি জলা প্রদীপ, সেখানে তুমি দেখতে পেতে নতুন সূর্যোদয়ের উজ্জ্বল কিরণ। দেশের ব্যাপারে সব সময় আশাবাদী তুমি। যতোই জর্জরিত হোক দেশ রাজনৈতিক দমনে, অর্থনৈতিক প্রতিকূলতায় বা সামাজিক অবক্ষয়ে, তোমার লেখায়ে তার সমাধান খুঁজেছ, দিয়েছও। যে ধারায় দেশ ও দশের মঙ্গল তারই দিকে আহবান জানিয়েছ তুমি।
গত দশ বছরে প্রতিকূলতার সাথে যুদ্ধ করে দেশ এগিয়ে চলেছে ঠিকই। তবে তোমার মত দেশপ্রেমিকেরা আর কিছুদিন থাকলে আমার বিশ্বাস আরও শক্ত হতো আমাদের অবস্থান। তোমার অগ্রজ মুসা চাচা, ফয়েজ চাচাদের সাথে তোমার নিয়মিত ফোনালাপ মনে পড়ে। তোমার লেখা পত্রিকায়ে প্রকাশিত হলে অথবা তোমার রিপোর্ট বিবিসিতে প্রচারের পর লম্বা আলাপ চলতো তোমাদের দেশ আর রাজনীতি নিয়েই মূলত। তুমি বাংলাদেশ টাইমসে কাজ করার সময় সুযোগ পেলে শহীদুল হক চাচাকে নিয়ে চলে আসতে বাসায় হাওয়াই ফাইভ ও দেখার আশায়! আম্মা তড়িঘড়ি তোমাদের জন্য খাবারের আয়োজন করতেন। নাকে মুখে গুঁজে আবার দৌড় দিতে খবরের পেছনে! তোমরা বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় এক স্বর্ণযুগ এনেছিলে আব্বা! দেশকে তার সৃষ্টি থেকে শুরু করে ৯০ দশকে স্বৈর শাসন থেকে মুক্ত করায় তোমরা ছিলে নির্ভীক সৈনিকদের কাতারে! চাচাদের বলো অনেক ভালবাসা আর শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করি তাদের। যেদিন তুমি চলে গেলে, মুসা চাচা এত কেঁদেছিল জানো! খালি বলছিল আমার যাবার পালা খোকনের আগে, ও কেনো চলে গেল! এখন হয়তো তোমরা সকলে আছো একে অপেরের হৃদয়ের কাছাকাছি, সুন্দর শান্তিময় কোন স্থানে।
তোমার অনুজ আমিন চাচা, নাফা চাচা আর হাসান চাচাদের তুমি কতই না স্নেহ করেছ! তারা বিভিন্ন সময় তোমার সাথে কাজ করেছেন। তুমি তাদের সামাদ ভাই। খবর সংগ্রহ শেষে তারা এসে তোমার সাথে বৈঠক করতেন। তাদের কাজে তোমার উত্তেজনা, কখনো বকাবকি সবই তারা চুপচাপ শুনতেন! অনেক সময় উনারা, আম্মা আর আমরা এসব নিয়ে হাসাহাসিও করেছি! উনারা হয়ে উঠেছিলেন আমাদের পরিবারের সদস্য, উনাদের পরিবার ছিল আমাদের বর্ধিত পরিবার। তুমি অনেক খুশি ছিলে উনাদের সাফল্যে! তোমার সর্বশেষ অনুজ জাকির ভাই তোমার স্মৃতিতে শ্রদ্ধা স্বরুপ ‘আতাউস সামাদ জীবনে ও পেশায়’ সংকলন প্রকাশ করেছেন ২০১৪তে। তোমার পড়ার টেবিলটা এখন উনি ব্যাবহার করেন! তোমারদের এই পরস্পর শ্রদ্ধা ও ভালবাসার বৃত্ত, অগ্রজ আর অনুজদের নিয়ে, আজকের দিনে বড়ই কাঙ্ক্ষণীয়। ভালবাসা আর শ্রদ্ধার এই বীজ তুমি বপন করেছ আমাদের মাঝেও। জানলে খুশি হবে আমারও আজ এরকমই এক বৃত্তের মধ্যে বাস। যার বাসিন্দারা আমরা একে অপরের পাশে, সুখে দুখে, একে অপরের মঙ্গল কামনায়।
তোমার কথা লিখছি আজ দশ বছর ধরেই, পাতার পর পাতা, আমাদের জীবন থেকে নেয়া। তবে তার অনেকটাই আমার মনের খাতায়! কাগজে কলমে তার অভিব্যক্তি আমাকে এমন এক বাস্তবতার সামনে দাড় করায় যা আজও আমার জন্য অনেক কঠিন। তাই এবার তোমাকেই লিখছি! একসাথেই হাঁটব এ পথ, ছোট ছোট পা ফেলে। প্রথম যেদিন তোমার বিরামস্থান আজিমপুর থেকে প্রার্থনা আর বুক ভাঙ্গা কান্না শেষে বাড়ির দিকে পা বাড়াই, মনে হল তুমি বললে, “চল মা, এবার আমি তোর সাথে সব জায়গায়ে যেতে পারি।” তোমার ঢিলেঢালা কর্ড এর প্যান্ট আর হাওয়াই শার্ট পরে, পায়ে বাটার স্যান্ডেল। মিনতি করি পাশে থেকো, সাহস জুগিয়ো, তোমার মত না হলেও যতোটা পারি নিজের মত করে পৃথিবীর ঋণ যেন পরিশোধ করতে পারি।
জানো আব্বা, তুমি চলে যাবার পর আম্মা তোমার অনেক গল্প করেছে যা জানা ছিল না আমাদের! ৭০ দশকে যখন আমরা দিল্লিতে থাকি, এক দাওয়াতে গিয়েছিলে তোমরা। ওখান থেকে হঠাৎই অফিসে যেতে হয় তোমাকে। ফিরে এসে আম্মাকে নিয়ে বাড়ি চলে এসেছিলে না খেয়ে। পরে আম্মাকে বলেছিলে কাজ সেরে ওই বাড়িতে যখন আবার ঢুকছিলে তখন চালক ভাইদের বাইরে খাবার দেয়া হয়েছিল। ভেতরে গিয়ে টেবিলে সাজানো খাবারের বিশাল আয়োজন আর বাইরের খাবারের মধ্যে এত ফারাক দেখে তোমার ক্ষুধা মিটে যায়।
তুমি আসলেও অনেক আবেগপ্রবণ মানুষ! তোমাদের বিয়ের পরপর আম্মার জন্য নাকি কী এক দামি ক্রিম টাকা জমিয়ে কিনে বাড়ি ফিরছিলে, পথে পরিচিত কার সাথে দেখা। সে কেন ব্যাগ হাতড়ে ওই ক্রিম এর কৌটা ধরেছিল তুমি আর সেটা আম্মাকে দাওই নি! বুড়ো বয়েসেও দেখেছি আম্মার জন্য গরমে পাউডার আর শীতে ক্রিম নিয়ে আসতে তুমি। ঈদে পরবে সব সময় শাড়ি তুমিই পছন্দ করে উপহার দিয়েছ আম্মাকে, তোমার আর আম্মার পছন্দ ছিল একই! কোন এক বিদেশি সিনেমা দেখে আম্মাকে আবেগাপ্লুত হয়ে কথা দিয়েছিলে আমরা কোনদিন sayonara (জাপানি ভাষায় বিদায় বলা) বলব না। যাবার সময় তা আর বলার সুযোগও হয়নি তোমার। আর আম্মাও তড়িঘড়ি পাট গুটিয়ে ওপারে পাড়ি জমালো তোমাকে সঙ্গ দিতে। বিধাতা তোমার কথা শুনেছেন বোধকরি।
জানি তুমি অনেক ইতিহাসের সাক্ষী! তার বেশ কিছু আমাদের জন্মের আগে অথবা আমাদের অনেক ছোটো বেলায় ঘটা। যেমন বঙ্গবন্ধুর সাথে তোমার বিশেষ কিছু মুহূর্ত তোমার লেখায় পড়েছি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুনানির সময়, আবার ৭১ এর ২৫ মার্চ সন্ধ্যায়। যে সন্ধ্যায় তিনি তোমাকে বলেছিলেন “I have given you independence, now go and preserve it!” মনে হলেও আমার গা কাঁটা দেয়ে! বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তির পর লন্ডন আর দিল্লি হয়ে দেশে ফেরার সময়ে দিল্লি থেকে তুমি তাঁর সাথে প্লেনে যোগ দিয়েছিলে। খুব কাছে থেকে দেখে লিপিবদ্ধ করেছ তাঁর আবেগপূর্ণ প্রতিক্রিয়া! তখন থেকে ২০১২ পর্যন্ত দেশের কত মাইল ফলকে দেখি তোমার চিহ্ন! যেমন রাজনীতির অঙ্গনে তেমন দেশের সাধারণ মানুষদের পাশে। উড়ির চরে সাইক্লোনের পর, রোহিঙ্গা রেফুজি ক্যাম্পে, বন্যার্ত মানুষের সংগ্রামে, স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে, আরও কত জায়গায়! দেশও তোমাকে ভালবেসে ভূষিত করেছে একুশে পদকের সর্বোচ্চ সম্মানে। তুমি বিনম্র কৃতজ্ঞ প্রাণে যা গ্রহণ করেছ। দেশের জন্য তোমার ভালবাসা আর অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ আরও যতো পদক আর মেডেল তোমার লাজুক ঝোলায়, তা আজ অনুপ্রাণিত করুক পরবর্তী প্রজন্মকে এই আশা করি। আমাদের ছেলেমেয়েদের অনুপ্রাণিত করি তাঁদের নানার/দাদার জীবনাদর্শ আর জীবনচারণকে পাথেয় করার। তোমার মত নরম, সমবেদনশীল আর কৌতুহলী মন, অন্যায়ের সাথে আপসহীন বেক্তিত, বেশ অনেকটা দুঃসাহসিকতা, বিনম্র স্বভাব আর অক্লান্ত পরিশ্রমের স্পৃহা তাঁদের মধ্যে গড়ে উঠলে পৃথিবীর যে কোনখানেই তারা ভালো থাকবে, ভালো করবে, সকলকে নিয়ে।
তবে তাদের এও বলি, ন্যায় আর সত্যের পথ সরল হলেও সহজ নয় সবসময়। স্বৈরাচারী এরশাদের একের পর এক মিথ্যাচার তোমার বিবিসির রিপোর্টে উন্মোচিত হওয়ায় সহ্য করতে না পেরে তোমাকে অন্যায়ভাবে ১৯৮৭ তে কারাবন্দী করে তারা। ভুলিনি সেই রাত, সেই দিনগুলি। তোমার পরিবার, তোমার বন্ধুরা, তোমার দেশ ছিল তোমার সাথে। রাখতে পারেনি বেশিদিন তোমাকে কারারুদ্ধ করে। বহু বছর পর পাড়ার এক বন্ধুর সাথে স্মৃতিচারণে বন্ধুটি বলে সে আর তার মা জেল হাসপাতালে তোমাকে দেখতে গিয়েছিল। তুমি নাকি উনাকে অবাক করে ক্ষমা চেয়েছিলে, তোমাকে গ্রেপ্তারের রাতে সারা পাড়া জাগিয়ে পুলিশ ঘেরাওয়ের জন্য। বন্ধুটি আরও বলে যে মাঝেমধ্যেই সকালে ওদের স্কুলে যাবার সময় তুমি রিকশা করে বাজার থেকে ফিরতে, তখন রিকশা থেকে নেমে রিকশা পাঠিয়ে দিতে ওদের স্কুলে নিয়ে যাবার জন্য। ছোটবেলার সেই মিষ্টি স্মৃতি এতদিন পর দেখা হওয়ায় জানালো আমায়। আমার বন্ধুরা অনেক ভালোবাসে তোমাকে, সবসময় মনে করে। এত ব্যস্ততার মাঝেও তুমি তাদের সাথে গল্প করতে। কারো সাথে তাদের কাজ নিয়ে, কারো সাথে তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে, কারো সাথে সমাজ সংস্কৃতি নিয়ে।
অনেক নামি দামী, মানিগুণীদের সাথে তোমার ওঠাবসা থাকলেও এই সুন্দর মনের, খ্যাপাটে ভাবের, নিষ্পাপ হাসির আমার আব্বা তুমি। আমার কাছে তুমি স্কুলে পড়ালেখা নিয়ে বার্ষিক বকুনি দেয়া আব্বা, প্রতি ঈদে নামাজ থেকে এসে আমাদের নিয়ে নাশতা করা আব্বা, অনেক রকম মাছ বাজার করতে পছন্দ করা সৌখিন আব্বা। ভাগ্নে ভাতিজাদের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পৃথিবীর তামাম বিষয় নিয়ে গল্প করতে ভালোবাসা আব্বা। জীবনের শেষ কটা বছর একনিষ্ঠ ভাবে আমার ছোট বোনকে তার ছবি আঁকায় অনুপ্রেরণা যোগানো আব্বা। আমার ভাইয়ার সাথে খুনসুটি লেগে থাকা অথচ তার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি গর্বিত আমার আব্বা। ফুপ্পিদের আদরের খোকন আর কাক্কুর প্রিয় ছোটভাই আমার আব্বা। আমার আম্মাকে আজীবন প্রাণঢালা ভালবাসা দিয়ে ঘিরে রাখা আব্বা তুমি।
একেবারে আমার পছন্দের বিপরীত রঙ্গিন জামা কিনে দেয়া, এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষার হলের বাইরে খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, বাংলাদেশের বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল বাঘ শিকারি পচাব্দি গাজিকে আমাদের মাঝে এনে সাক্ষাৎকার নেয়া আব্বা তুমি। তুমি আমার বিশ্ববিদ্যালয় যাবার সময় আদর করে দেয়া আর সাজগোজের অপ্রয়োজনীয়তা নিয়ে আমাকে বক্তৃতা দেয়া আব্বা। আমাকে কর্মক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত করা আব্বা। আমার বিয়ের সময় আমার হবু স্বামীর একান্তে সাক্ষাৎকার নেয়া, আমার মেয়েকে একেবারেই কোলে পিঠে করে মানুষ করা, সবুজ ঘাসে খেলতে নিয়ে যাওয়া, জলে ঢিল মেরে ঢেউ তোলা, গাছে চড়ান, নাতনির জন্য মুরগি আর খরগোশ পালা আব্বা তুমি। কখনো কষ্টে, অভিমানে ডুকরে ওঠা মন কেঁদে বলে আর আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে যাওয়া আব্বাও তো তুমি! পরোক্ষণেই নিজেকে শুধরাই! বিধাতার বিধানে আমাদের আগমন আর প্রস্থান। বৃথা অভিমান কাটিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে তোমার আর আম্মার জন্য সকল মঙ্গল ও চিরশান্তি কামনা করি। আর কৃতজ্ঞতা জানাই নত শিরে, তোমাকে আমার প্রাণের মাঝে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। চিরদিন।
(প্রয়াত সিনিয়র সাংবাদিক আতাউস সামাদ স্মরণে তার কন্যার স্মৃতিচারণ)
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)