চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

হাইব্রিড যুদ্ধ এবং বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতা

পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে যুদ্ধ একটি বড় উপাদান। সভ্যতার আদি থেকেই বিশ্বের দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ লেগেই আছে। সভ্যতা যত এগিয়ে গেছে যুদ্ধ বা যুদ্ধাস্ত্র তত আধুনিক হয়েছে। এই প্রাযুক্তিক পৃথিবীতে যুদ্ধ এখন নতুন মাত্রা পেয়েছে। বর্তমান বিশ্বে হাইব্রিড যুদ্ধ নতুন এক সংযোজন।

যুগ যুগ ধরে রাজনৈতিক শত্রুতার কারণে এক বা একাধিক দেশ বা অঞ্চলের মধ্যে চলে আসছে হাইব্রিড যুদ্ধ। যা বর্তমান সময়ের আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আসলে হাইব্রিড যুদ্ধ কি?

ইউরোপীয় সেন্টার অফ এক্সিলেন্সের পরিচালক তিজা টিলিকাইনেনকে হাইব্রিড যুদ্ধের সংজ্ঞা দিতে বলা হলে তিনি বলেন:  স্বীয় স্বার্থের কারণে কোন তথ্যপ্রবাহকে ব্যবহার করে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে হামলা করা। এসব হুমকি এতটাই ঘোলাটে, অদৃশ্য এবং অনির্ধারিত যে যেকোন দেশের পক্ষেই এধরণের হুমকি মোকাবেলা করা অত্যন্ত জটিল এবং দুরহ কাজ।

বর্তমান সময়ে গত এক যুগের মধ্যে এমন কিছু হামলার ঘটনা ঘটেছে যা হাইব্রিড যুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে বাল্টিক সাগরে ডেনমার্ক ও সুইডেনের উপকূলের মাঝামাঝি জায়গায় এক বিস্ফোরণের ফলে নর্ড স্ট্রিম গ্যাস পাইপলাইনে বড় ধরণের ছিদ্র তৈরি হয়। রাশিয়া থেকে গ্যাস জার্মানিতে নেয়ার জন্য এই পাইপলাইন তৈরি করা হয়। বিস্ফোরণের সাথে সাথেই রাশিয়া জানায়, তারা এর পেছনে নেই। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনের কারণে তাদের শায়েস্তা করতে রাশিয়াই এই ঘটনাটি ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ করে। এর ফলে যাতে ইউরোপ জ্বালানি সংকটে পড়ে।

এছাড়া নির্বাচনে গোপন হস্তক্ষেপের ঘটনাও হাইব্রিড যুদ্ধের উদাহরণ হতে পারে। ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রক্রিয়া তদন্তে দেখা গেছে, রাশিয়া সুপরিকল্পিতভাবে ঐ নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে। রাশিয়ার উদ্দেশ্য ছিল হিলারি ক্লিনটনের বিজয়ের সম্ভাবনাকে কমিয়ে ফলাফল ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুকুলে নিয়ে আসা। তবে তদন্তের এই ফলাফল তারা সবসময় অস্বীকার করেছে।

অভিযোগ আছে অনলাইন বটস ব্যবহার করে এই কাজ করেছে রাশিয়া। সেসময় সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে রাশিয়ার সরকার সমর্থিত অনলাইন কর্মীদের একটি দল সোশ্যাল মিডিয়ায় মিথ্যা অ্যাকাউন্ট খুলে নিয়মিত ভাবে হিলারি ক্লিনটনকে ট্রল করেছে।

হাইব্রিড যুদ্ধের আরেকটি কৌশল হচ্ছে, কোনো বিষয় বা ঘটনার একটি কাল্পনিক, মিথ্যা এবং উদ্দেশ্যমুলক ব্যখ্যা তৈরি করে প্রচার করে যাওয়া। যাতে সাধারণ মানুষ প্রভাবিত হয়ে পড়ে। সম্প্রতি ইউক্রেনে হামলার পর অনলাইনে এ ধরণের প্রচারণার পরিমাণ বেড়েছে। নিজের নিরাপত্তার জন্য এই হামলা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল বলে মস্কো যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা শুধু রাশিয়ায় ছাড়াও পুরো ইউরোপের অনেক মানুষই বিশ্বাস করে।

এসব হুমকি যাতে পশ্চিমা দেশগুলো চিহ্নিত করে নিজেদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে সে জন্য ন্যাটো জোট এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ফিনল্যান্ডে হাইব্রিড সিওই সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছে। ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশ কতগুলো দেশের ৪০ জনের মত বিশেষজ্ঞ এখানে কাজ করেন। এছাড়াও ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজনও রয়েছেন সেখানে।

প্রতিষ্ঠানটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন টেইজা টিলিকাইনেন। তিনি বলেন: বর্তমানে তারা আর্কটিক অঞ্চলকে প্রাধান্য দিচ্ছেন এবং সেখান থেকে হাইব্রিড হুমকি চিহ্নিত করা হয়েছে। কারণ সেখানে প্রচুর জ্বালানির মজুদ আছে। তিনি আরও জানান: শক্তিধর দেশগুলো এখানে তাদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করবে। রাশিয়া বলে আসছে আর্কটিক একটি বিশেষ অঞ্চল যা বিরোধপূর্ণ এলাকার বাইরে, এখানে খারাপ কিছু হচ্ছেনা। কিন্তু তারপরও রাশিয়া সেখানে তাদের সামরিক শক্তি জোরদার করছে।

হাইব্রিড হুমকির আরেকটি হলো, সাগরের নীচে বিস্ফোরণ। যা নিয়ে এই অঞ্চলের দেশগুলো ক্রমেই চিন্তিত হয়ে পড়ছে। হাইব্রিড হুমকি চোখে দেখা যায়না। কেউ এখানে অস্ত্র হাতে নিয়ে গুলি চালায় না। তবে অদৃশ্য এসব হুমকির ভয়াবহতা একেবারেই কম নয়। কে বা কারা এই হুমকির পেছনে রয়েছে তা নির্ণয় করাটাও খুব কঠিন।

২০০৭ সালে এস্তোনিয়ায় ব্যাপক মাত্রার সাইবার হামলা কে বা কারা ঘটিয়েছে তা এখনও স্পষ্ট নয়। গত বছর বাল্টিক সাগরের নীচে বিস্ফোরণের উৎস সম্পর্কেও শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যায়নি। হামলাকারীরা এই ক্ষেত্রে খুব কমই তথ্য বা প্রমাণ রেখে যায়।

সমুদ্রে কত ধরণের হাইব্রিড হুমকি তৈরি হতে পারে তা নিয়ে হাইব্রিড সিওই একটি হ্যান্ডবুক তৈরি করেছে। তাতে খুব সম্ভাব্য ১০টি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-সাগরের নীচে গোপনে কিছু অস্ত্রের ব্যবহার, একটি দ্বীপের চারপাশে নিয়ন্ত্রিত এলাকা ঘোষণা করা, ছোট ছোট প্রণালীতে অবরোধ তৈরি করা ইত্যাদি।

ইউক্রেনে হামলা শুরুর আগে আজভ সাগরে রুশ তৎপরতা নিয়ে এই সেন্টারে গবেষণার কাজ শুরু করেছে। ২০১৮ সালের অক্টোবর মারিউপোল এবং বারদিয়ানস্ক বন্দর ছাড়ার পর এবং বন্দরে যাওয়ার আগে ইউক্রেনীয় জাহাজগুলোকে রুশ কর্মকর্তাদের পরিদর্শনের জন্য কার্চ প্রণালীতে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হতো। এজন্য জাহাজগুলাকে বেশিরভাগ সময় দু’সপ্তাহ পর্যন্ত নোঙর করে থাকতে হত। এটার কারণে ইউক্রেনের অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়ে।

তবে সেন্টারের বিশেষজ্ঞরা সবচেয়ে অবাক হয়েছেন তথ্য কারসাজির ফলাফল দেখে। ইউরোপ জুড়ে বিভিন্ন জনমত জরিপ বিশ্লেষণ করে তারা দেখেন বেশ কয়েকটি ন্যাটো দেশের সঙ্গে তথ্য যুদ্ধে রাশিয়া এগিয়ে রয়েছে। জনগণের বিরাট অংশ যুদ্ধ নিয়ে রুশ ব্যাখ্যায় বিশ্বাসী।

সেন্টারে কর্মরত একজন চেক গবেষক জেকব কালেনস্কি মস্কোর এই প্রচারণা ঠেকানোর প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে বলেন: আমি মনে করি না রুশদের এই প্রচারণা খুব ধারালো কিংবা জোরালো। তাদের বার্তা খুব একটা আকর্ষণীয় নয়, কিন্তু তারা সাফল্য পাচ্ছে সংখ্যা দিয়ে। ব্যাপক মানুষ ব্যবহার করে তারা এই তথ্য ছড়াচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার প্লাটফর্মগুলোতে এদের জায়গা দেওয়ার কোনও কারণ নেই। সবাই সুপেয় পানির জলাধারে যেতে চায়, কিন্তু ঐ জলাধারে কেউ বিষ ছড়াতে চাইলে তা হতে দেওয়া যায়না।

মিজ টিলিকাইনেন বলেন, এসব হাইব্রিড হুমকির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া তাদের সেন্টারের কাজ নয়। তাদের কাজ হচ্ছে বাস্তব পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে চলমান হুমকি কিভাবে মোকাবেলা করা যায় তা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেয়া।