
গণমাধ্যম জীবনের প্রায় অর্ধশতক ছুঁই ছুঁই করছেন শাইখ সিরাজ। আমি এই মানুষটিকে বলতে চাই ‘বহুদর্শী এক দেশনায়ক’। সাধারণত রাজনীতির মানুষের সঙ্গে এমন বিশেষণ যায়। আমি শাইখ সিরাজের পেশা, নেশা, ধ্যান, জ্ঞান ও রাজনীতি দেখেছি। টানা দুই দশক ধরে ছায়ার মতো দেখেছি তার প্রবণতা। এগুলোর ভেতরে গিয়ে কিছু বিস্ময়পৃষ্ঠা আমার সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
তিনি কি শুধুই কৃষি নিয়ে মত্ত থেকেছেন? তার বহুরৈখিক চিন্তার জায়গাটি শুধু আবরণ ধরে আবিস্কার করা যায় না। টেলিভিশন দেখেও বোঝা সম্ভব নয়। তিনি কোথায় কোথায় আকর্ষণ বোধ করেন? কেন করেন? বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার অব্যবহিত পর বাঙালির জীবন বাস্তবতার যে জায়গাগুলোতে তিনি দৃষ্টি রেখেছেন, কথা বলেছেন এবং সাধারণের কথা তুলে এনেছেন সেই জায়গাগুলোই বাংলাদেশ নামের জাতিরাষ্ট্রের প্রাণশক্তি।
তিনি যখন কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্য ছুঁয়েছেন তখন এদেশের স্কুল ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে যুব সমাজের কাজ, দৃষ্টিভঙ্গি ও শক্তি নিয়ে কাজ করেছেন। উন্মুক্ত পৃথিবীতে মানুষের জীবিকার খোলামাঠে যে অপরিসীম শিক্ষা রয়েছে, সেই শিক্ষা তিনি মাঠ থেকে নিয়েছেন, আর সেটি বিতরণ করেছেন ভবিষ্যতের নায়কদের মাঝে। স্কুল প্রাঙ্গণে পুষ্টিকর সবজি আবাদের কী এমন ফলাফল হতে পারে, সেটি যখন অন্যদের কাছে ধোঁয়াশার মতোন, তিনি তখন সত্যটি বুঝেছেন। যখন আমাদের দেশে এত বেশি চাকরির ক্ষেত্র গড়ে ওঠেনি তখন তিনি তরুণ সম্প্রদায়কে বলেছেন, মাটির সঙ্গে থেকে কীভাবে জীবনের ফুল ফোটানো যায়। স্বাধীন বাংলাদেশের সামনে এগোবার আলো জ্বলতো যে জায়গাগুলোতে তার মধ্যে একটি ক্ষেত্র ছিল ৫০০ একর আয়তন বিশিষ্ট তেজগাঁও শিল্প এলাকা। আমাদের নিজস্ব শিল্পের সম্ভাবনাময় প্রসার নিয়ে তিনি কথা বলেছেন চল্লিশ বছর আগে। মানুষকে দেখিয়েছেন, দেশের নিজস্ব শক্তির জায়গাটি।
পৃথিবীতে গণমাধ্যম আবিষ্কৃত হওয়ার পর মানুষ জীবনের বহুমুখিনতা নতুনভাবে বুঝেছে। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার ছয় বছর আগে এই ভূমিতে টেলিভিশন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে শহরের মানুষের জীবনবোধ ও রুচি অসাধারণভাবে সুগঠিত হতে শুরু করে। যখন ঘরে ঘরে টেলিভিশন ছিল না তখন টেলিভিশন সুবিধার বাইরের মানুষদের জীবনাচারকে টেলিভিশনে উপস্থাপনের অসাধারণ এক কাজ করতে থাকেন শাইখ সিরাজ। টেলিভিশনের শক্তির সঙ্গে নিজের কল্পনা আর আত্মবিশ্বাস মিলিয়ে গণমানুষের সামনে তা পরিবেশনের যে মধুকরি নেশা, সেই নেশার যত গভীরে তিনি গেছেন, সেখানে সম্ভবত আর কেউ পৌঁছতে পারেননি। সেকারণে তার দীর্ঘতম পথচলার একটি ধারাবাহিক অগ্রগতি বা প্রবৃদ্ধি দেখা যায়। প্রতিনিয়তই তিনি জাগরণের ভেতর দিয়ে গেছেন। আলোড়ন তুলেছেন। বিস্ময় সৃষ্টি করেছেন। আজ আমরা শুধু মানুষের অনুপ্রেরণা আর সৃষ্টি ও উদ্যোগের উৎসাহকে আবিস্কার করতে পারি, কিন্তু ভেতর থেকে জেগে ওঠার সূত্রটি যে কত বিপুল শক্তিধর হতে পারে তার হয়তো খোঁজই করি না।

বাংলাদেশ টেলিভিশনে নানান পথ হেঁটে একসময় মাটি ও মানুষ করতে শুরু করেন শাইখ সিরাজ। সেসময়ে টেলিভিশনের একদল মানুষ তার অস্থিরতার সাক্ষী ছিলেন। সাক্ষী ছিলেন নিকটতম বন্ধুরা। সেই সময়টিই ছিল অন্যরকম। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের ছাত্র। চাকরির বাইরের মানুষ। নিজের কাজটিকে মিশন করে তোলার সুযোগ ছিল। যখন নিজস্ব আগ্রহ, টেলিভিশন কেন্দ্র আর দর্শক এই তিনের মধ্যে একটি বন্ধন রচিত হলো তখন টেলিভিশন নামের যন্ত্রের সামনে পেছনের যাদুর সঙ্গে মানুষের ভালোমন্দকে তিনি মেলাতে প্রয়াসী হলেন। সেসময় চাকরি, ব্যবসা আর নেশা তিনেরই হাতছানি ছিল। তিনি থেকে গেলেন নেশার মাঝে। তখন টেলিভিশনের কৃতি মানুষেরা সব শাইখ সিরাজের বন্ধু ও নিকটতম সুহৃদ। তাদের কাছে বিষয়গুলো এত বেশি আকৃষ্ট হবার মতো কিছু ছিল না। তারা কাজটির মধ্যে অন্যরা ভবিষ্যৎও খুঁজে পেতেন না। মাঠের ফসল, পুকুরের মাছ, কাছা দেয়া কৃষকের ভুলভাল বাক্যবাজি কিংবা গরু ছাগলের মধ্যে আধুনিক জীবনের সুর তখন খুঁজে পাওয়ার সময় নয়। ঠিক সেই সময়ে বাসার ছাদে কাজী পেয়ারা, বাড়ির উঠোনে মুরগির ঝাঁক আর পুকুর ভরা মাছের ভেতর আগামীর বাংলাদেশ রচিত হতে দেখতেন শাইখ সিরাজ। এগুলো নিয়ে এখনকার সময়ে দেশের সকল শিক্ষিত সজ্জন অসাধারণ ব্যাখ্যা দেন। শাইখ সিরাজের বন্ধুরা বিস্ময়ে অভিভুত হন। রাজনীতির নেতারা শুধু আসন ছেড়ে বসতে দেন না, তার কর্মের উচ্চতার পাশে দাঁড়িয়ে গর্ববোধ করেন।
শাইখ সিরাজ সত্তরের কাছাকাছি বয়সের এক তরুণ। দেশের মানুষ যে কেউ যেকোনো জায়গা থেকে ‘আমিই বাংলাদেশ’, দাবি করতে পারেন। কিন্তু হাতে গোনা কয়েকজন মানুষের এই দাবি শতভাগ মানুষের সমর্থন পাবে সেখানে শাইখ সিরাজের নাম অগ্রগণ্য। বাংলাদেশ নয় শুধু গোটা পৃথিবীর অতি সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করেন, মানুষের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি ‘নোবেল পুরস্কার’। দেশের অগণিত সরল প্রাণ মানুষ শাইখ সিরাজের জন্য ‘নোবেল পুরস্কার’ প্রত্যাশা করেন, অন্তরের অন্ত:স্থল থেকে। শাইখ সিরাজ বলেন, মানুষের ভালোবাসা নোবেল পুরস্কারের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। গ্রামের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ তাকে এত বেশি ভালোবাসেন, তার সঙ্গে সহজে মিশে গিয়ে জীবনের গভীর গল্প জুড়ে দেন, সেটি বস্তুগত যেকোন প্রাপ্তির সঙ্গে তুলনাহীন।
বাঙালি সমাজ, কৃষি সমাজ আর গণমাধ্যম সমাজে পরিণত বয়সের বিপুল জনপ্রিয় একটি নাম শাইখ সিরাজ। প্রশ্ন জাগে, তিনি কি শুধুই কৃষির? নাকি গণমাধ্যমের? নাকি দেশ ও মানবতার সামগ্রিক কল্যাণ ভেবে ছুটে চলা এক স্বেচ্ছাসেবী? কৃষি বিশেষজ্ঞ সমাজে একটি সমীক্ষা প্রচলিত আছে, সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের কৃষির সঙ্গে ঊনিশটি মন্ত্রণালয়ের যোগসূত্র আছে। সত্যিকার অর্থে কৃষি নেই কোথায়? কৃষি ছাড়া কৃষ্টি নেই। জীবনের উপস্থিতি যেখানে সেখানেই আছে কৃষি। শাইখ সিরাজ কথায় কথায় বলেন, পৃথিবী যতদিন থাকবে, মানুষের খাদ্য ততদিন থাকবে। আর খাদ্য যতদিন থাকবে ততদিন থাকবে কৃষি। এক কৃষির পথে হাঁটতে গিয়ে তিনি দেশের কোনো পথেই হাঁটতে বাদ রাখেননি। জাতির সকল শক্তির জায়গাতে রেখেছেন গভীর পর্যবেক্ষণ। আমাদের কৃষির অগ্রগতি, কৃষিশিল্পের অগ্রগতি, প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, রপ্তানি শিল্প, যোগাযোগ, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা, পররাষ্ট্রনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ধর্ম সবখানেই তিনি প্রান্ত থেকে শীর্ষবিন্দুতে গিয়ে কথা বলেছেন। সত্য তুলে ধরেছেন। তার শান্ত, সৌম ও সাবলীল উচ্চারণের ভেতর কী হচ্ছে, কী হতে পারতো, আর কী হওয়া উচিৎ-তার খোঁজ যেমন মেলে, একইভাবে পাওয়া যায় উদ্দীপ্ত হওয়ার মতো বহু কিছু। তাই মানুষ উজ্জীবিত হন। জীবনের সূত্র খুঁজে পান। দেখা গেছে, মাঠের ফসল নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি কোনো কৃষক অথবা কৃষি শ্রমিক পরিবারে গিয়ে হাজির হলেন। তিনি তার জীবনাচারের গভীর সত্যগুলো ভিডিও, সাক্ষাৎকার আর উপলব্ধির ভেতর দিয়ে তুলে আনলেন। সেটি যখন প্রচার হলো তখন একজন অর্থনীতিবিদ খুঁজে পেলেন অসাধারণ গবেষণা ক্ষেত্র। একজন উন্নয়ন সংগঠক খুঁজে পেলেন একটি প্রকল্পের ভিত্তি, একজন উদ্যোক্তা খুঁজে পেলেন জীবন গড়ার নতুন সূত্র, শহর নগরের অভিজাত শ্রেনীর মাথায় ঢুকলো জীবনকে কাছ থেকে দেখবার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি।
শাইখ সিরাজ পৃথিবীর দেশে দেশে শুধু কৃষির উৎপাদন, বাণিজ্য, গবেষণা ও সম্প্রসারণের নিবিড় চিত্র তুলে আনেননি, মানুষের জীবনের গুণগত পরিবর্তনের ধাপগুলোতে এক অনুসন্ধানী দৃষ্টি রেখেছেন। মানুষ যখন বাহ্যিক রাজনীতি আর প্রচলিত অর্থনীতির মাপকাঠি নিয়ে পৃথিবীকে মাপতে যান, শাইখ সিরাজ তখন টান দেন মানুষের জীবনের গভীর সত্য ধরে। সেটি হচ্ছে প্রাত্যহিক খাদ্য ও তার উৎস। একই ভাবে নাগরিক শুদ্ধাচার থেকে শুরু করে প্রতিটি মানবিক জায়গাতে তার রয়েছে গভীর মনোযোগ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও সমাজের উন্নয়নের পেছনের নিয়মকগুলো তিনি খোঁজার চেষ্টা করেছেন বিরামহীন ভাবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দৃষ্টান্ত তিনি টেলিভিশনে তুলে ধরেছেন, মানুষ অদেখা অজানা অনেক কিছু দেখেছেন। কিন্তু যেটি দেখেননি সেটি হচ্ছে এগুলোর বাইরে তার যে পর্যবেক্ষণ তা তিনি বিভিন্ন ফোরামে তুলে ধরেছেন দৃষ্টান্ত হিসেবে। সেগুলোও সমাজ ভেদে অন্যরকম একটি জাগরণের কাজটি করেছে।
আমাদের বন্ধু দেশ ভুটানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি মানুষের সুখের প্রবৃদ্ধির হিসেব করা হয়। সুখের প্রবৃদ্ধির ওপর নির্ভর করে দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি। মনে আছে এখন থেকে দুই দশক আগে বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তায় আনেন শাইখ সিরাজ। তিনিও হিসেব কষতে শুরু করেন, দেশের সাধারণ তৃণমূল মানুষের রুগ্ন, জরাজীর্ণ, হাসি আনন্দবিহীন মুখাবয়বেকর ভেতর দিয়ে যে তথ্য একবাক্যে পাওয়া যায়, তা হলো তারা ভালো নেই। তারা ভালো থাকেন না। অথচ গ্রামের মানুষের আনন্দমুখরতার ভেতর দিয়ে পাল্টে যেতে পারে জীবনধারা । তিনি কৃষি অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিয়ে অনুষ্ঠানের সঙ্গে তাদের আনন্দ বিনোদনের অনুষঙ্গ যুক্ত করে গ্রামীণ সংস্কৃতির এক নবজাগরণ ঘটিয়েছেন। তিনি গ্রামের খেলার মাঠে গিয়ে বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে হয়ে ওঠেন আরেক বাঁশিওয়ালা। তার যাদু হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালার মতোই। প্রতি ঈদেই তিনি অনুষ্ঠান করেন কৃষকের ঈদ আনন্দ। সেটিই হয়ে ওঠে টেলিভিশনের সেরা বিনোদন অনুষ্ঠান। ওই অনুষ্ঠান থেকে গ্রামের মানুষ আনন্দে জেগে ওঠার প্রয়াস পায়, শহরের মানুষ পায় প্রাণশক্তি ও ইতিবাচক চিন্তার খোরাক। গ্রামের শান্ত সরল মানুষের শক্তিমত্তা ও নৈপূণ্য তৈরি করে দেশপ্রেমের এক নতুন ব্যঞ্জনা।
একজন মানুষ কতটা গণমাধ্যমের হতে পারেন তা শাইখ সিরাজের সুদীর্ঘ পথচলার গতি, সাফল্য ও বিরামহীন কর্মকাণ্ডের ভেতর গিয়ে আবিস্কার করা যায়। তার বহুমাত্রিক কৃষি বিষয়ক গণমাধ্যম তৎপরতার সুফল হিসেবে আমাদের কৃষি অগ্রগতি, মানুষের চেতনার বিকাশ থেকে শুরু করে যে যে দিকগুলো উন্মোচিত হয়েছে সে ব্যাপারে অধ্যাপক ড. শেখ শফিউল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধীনে পিএইচডি অভিসন্দর্ভ সম্পন্ন করেন। সেটি পৃথিবীতে কৃষি বিষয়ক সাংবাদিকতার সাফল্যের প্রশ্নে এক অনন্য নজির।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম বিকাশের প্রশ্নে শাইখ সিরাজ সবচেয়ে সফল এক কারিগর । বাংলাদেশ টেলিভিশন আমল থেকে স্যাটেলাইট টেলিভিশন যুগ, সেখান থেকে অনলাইন ও সামাজিক মাধ্যমের যুগে দর্শকের সামনে তিনি সমানভাবে আদৃত ও গ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশ টেলিভিশনের যুগ থেকেই তিনি বিপুলভাবে মানুষের মাঝে পৌছে গেছেন। পরে তার নিজের মালিকানা অংশীদারিত্বের টেলিভিশন চ্যানেল আই’তে সিকি শতাব্দী ধরে তিনি গণমাধ্যমের যে ‘গণদায়’ ও “গণদাবি” তা ধর্মের মতো করে পূরণ করে চলেছেন। এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। একটি টেলিভিশনের দর্শক রুচি তৈরি করা ও তাদেরকে নিয়মিতভিত্তিতে “গণমাধ্যম সেবা” দিয়ে যাওয়ার যে মহোত্তম দায়িত্ব সে কাজটি তিনি সাফল্যের সঙ্গে করতে পেরেছেন। তার পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে গভীর সম্পর্কের জায়গা থেকে। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবার জীবনের আনন্দ বেদনার যে সুগভীর সুর তা তাকে আলাদা করে শিখতে হয়নি। আর তৃণমূল দরিদ্র শ্রেণিকে তিনি তার কাজের সবচেয়ে বড় উপজীব্য করেছেন। এই দুটি শ্রেণি মিলেই বৃহৎ বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশ অনুশীলনের ক্ষেত্রে শাইখ সিরাজ “গণমাধ্যমের ধর্ম”টিকে সবচেয়ে লাগসইভাবে সক্রিয় রাখতে পেরেছেন। খুব অভিজাত, উচ্চাকাঙক্ষা, বাণিজ্য সফলতার স্বপ্ন দিয়ে যেটি সম্ভব নয়। গণমাধ্যমে যে চিন্তার মাত্রা থাকা উচিৎ, গণমাধ্যমের সঙ্গে মানবিক সম্পর্ক, বাঙালি সমাজে গণমাধ্যমের স্থায়ীত্বের জন্য বাঙালিয়ানার সঠিক অনুশীলন আর গণতান্ত্রিক চর্চা, এই জায়গাগুলোতে তিনি তার অনন্যতা দেখিয়েছেন। এটি গণমাধ্যম হিসেবে চ্যানেল আই’য়ের সাফল্যেরও অন্যতম দিক।
আর আজকের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জন্যও তিনি হয়ে উঠেছেন সবচেয়ে সফল এক ‘কন্টেন্ট ম্যাজিশিয়ান”। পৃথিবীময় বাংলাভাষার মানুষেরা তার কন্টেন্ট এ হুমড়ি খেয়ে পড়েন। কারণ, তিনি গণমাধ্যমের নাড়ি বোঝেন। সাধারণ মানুষের ক্ষুধা, চাহিদার পাশাপাশি সময়ের প্রয়োজনটি তার উপলব্ধিতে সহজভাবে ধরা দেয় বলেই তিনি মানুষের কাছে অপরিহার্য একজন। তার ইউটিউব চ্যানেলে প্রায় ৩৩ লাখ গ্রাহক প্রায় ১২’শ এর কাছাকাছি সংখ্যক অনুষ্ঠান দেখছেন। পৃথিবীর দর্শকরা কোটি কোটি ঘণ্টা যুক্ত থাকছেন তার ভিডিওতে। এটি হয়ে উঠেছে মানুষের গঠনমূলক পরিবর্তনের এক যাদুক্ষেত্র। একটি অনন্য অডিও ভিজ্যুয়াল লাইব্রেরি। একইভাবে ফেসবুকে তার পেইজে যুক্ত রয়েছেন প্রায় ৯০ লাখ মানুষ। এই ৯০ লাখ নয় শুধু তাদের মাধ্যমে আরও বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবনধারায় প্রতিদিন অনুরনণ তুলছেন শাইখ সিরাজ। এই বিপুল মানুষের ভীড়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে গ্রামের হাড়জিরজিরে প্রান্তিক কৃষক পর্যন্ত রয়েছেন। যার হাতে কৃষি উঠেছে তাদের মাঝেই ছুটে গেছেন শাইখ সিরাজ। এই ছুটে যাওয়ার কাজটিও এক ধরণের মিথস্ক্রিয়া। অগণন স্বপ্নচারী মানুষের স্বপ্নের কুঁড়ি ফুটে উঠেছে তার অনুষ্ঠান দেখে, কথা শুনে। তারপর তিনি যখন খোঁজ পেয়েছেন ছুটে গেছেন তার স্বপ্নক্ষেত্রে। এখানেই গণমাধ্যম ও মানুষের বাস্তব সম্পর্কের অনন্যতা। এখন পৃথিবীব্যাপী বিস্তৃত হয়েছে এই সম্পর্কের জাল। যেখানেই বাংলাদেশি সেখানেই বাংলাদেশের কৃষি। যেখানে কৃষি সেখানেই শাইখ সিরাজ।
গণমাধ্যমের বহুমুখি শক্তিময়তায় শাইখ সিরাজকে সামনে রেখে অগণিত মানুষ পাল্টে গেছেন। সুক্ষভাবে এই পরিবর্তনের প্রভাব রয়েছে দেশের অন্যান্য গণমাধ্যমেও। তিনি যে পথ রচনা করছেন, সেই পথটি অনুসরণ করেছেন বহু মানুষ। যদিও অনুষ্ঠান নির্মানে তার যে সম্পাদনা নীতি, গণমানুষের প্রতি তার যে দায়বদ্ধতা, অন্য যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কন্টেন্ট মেকার হিসেবে আসছেন তাদের কাছে হয়তো সে বিবেচনা সেভাবে নেই। তার কাজগুলোর ভেতরে এসবের শিক্ষাও রয়েছে। অনেকে সেগুলো অনুসরণের চেষ্টা করেন। সত্যিকার অর্থে এখন ফসলের মাঠে লাঙল জোয়াল আর গরু না গেলেও ক্যামেরা যায়। সবুজ ফসলী প্রান্তরের ছবি এখন ফসলের মতোই ফোটে টিভিতে, মোবাইল স্ক্রিনে, পত্রিকার পাতায়। এর পেছনের একমাত্র অনুঘটক শাইখ সিরাজ।
পৃথিবীতে ভাইরাল এসেছে, কিন্তু গণমাধ্যমের প্রকৃত শক্তি ফুরিয়ে যায়নি। খড়কুটোর মতো অনেক কিছুই উড়ছে। কিন্তু গণমাধ্যমের যে ভারী কাজ, যে দায় সেখানে শাইখ সিরাজের মতো মানুষের অবদান সভ্যতার এক নতুন দৃষ্টান্ত হয়ে স্থায়ী আসন দখল করে আছে। দায়িত্ব, কর্তব্য আর ব্যক্তিগত শ্রম নিষ্ঠায় গণমাধ্যম প্রয়াসের ইতিহাসে উৎকর্ষের যে পাহাড় তিনি রচনা করেছেন, সেখানে এখন রাষ্ট্রযন্ত্রের অনেক দায় যুক্ত হয়ে গেছে। যার মাধ্যমে শাইখ সিরাজের দেশচিন্তা, গণমাধ্যম তৎপরতার সকল দিকগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জায়গাতে সংযুক্ত করা যায়। সময়ের তাগিদে সেগুলোও জেগে উঠবে। যুগসন্ধীক্ষণের এই সময়ে তার বিরামহীন কাজগুলো মানুষের বহুরৈখিক দৃষ্টি খুলে দেবে। উৎপাদনমুখি একটি শক্তিশালী দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী হয়ে উঠবে তৃণমূল কৃষক শ্রেণি; শাইখ সিরাজের স্বপ্ন যেখানে।