মিনায় আল-জিসর হাসপাতালের সামনে কেমন এক ঘোর লাগা অবস্থায় বসে আছেন বাংলাদেশের হাজি মুহাম্মদ বেলাল। দেশের কাউকে সামনে পেলেই আকুল হয়ে কান্না জড়ানো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করছেন ‘আমার স্ত্রীকে দেখেছেন’। ঠিক তার পরেই আবার ফিরে আসছেন বাস্তবতায়, শতশত হাজির মতো তার স্ত্রীও পদদলিত হয়ে নিহত হয়েছেন ২০৪ নম্বর স্ট্রিটে, এটা তিনিও জানেন তবে মানতে পারছেন না। মানতে পারার কথাও নয়। যে মানুষটিকে নিয়ে একসঙ্গে হজ করার জন্য ২০ বছর ধরে তিলতিল করে টাকা জমিয়েছেন, যে মানুষটি তাকে কথা দিয়েছিলেন আজীবন এক সঙ্গে থাকার, তাকে তিনি চিরতরে হারিয়েছেন মাত্র কয়েক মুহূর্তের মিনা-বিভীষিকায়।
সৌদি’র আল হায়াত পত্রিকায় উঠে এসেছে মিনা দুর্ঘটনায় বাংলাদেশী হাজি বেলালের এই বিয়োগান্তক শোকগাঁথা। প্রতিবেদনটির সঙ্গে প্রকাশিত ছবির বর্ণনায় দেখা যায় হাসপাতালের সামনে এহরাম পড়েই ফুটপাথে বসে আছেন বেলাল। চোখ বেয়ে নামছে অশ্রুধারা। পাশে থাকা সঙ্গী বেলালকে সান্ত্বনা দিতে পবিত্র কোরআনের আয়াত পাঠ করছেন।
২৫ বছর আগে জীবিকার সন্ধানে বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে পাড়ি জমানো বেলাল স্থানীয় একটি পোশাকের দোকানে কাজ করেন। কাজ করে যা পেতেন তা থেকে সঞ্চয় করেছিলেন স্ত্রীকে দেশ থেকে নিয়ে এসে একসঙ্গে হজ পালন করবেন বলে। অবশেষে ২০ বছর পর তা সম্ভবও করেছিলেন। হজে আসতে পেরে তিন সন্তানের জননীর আনন্দের সীমা ছিলো না। কিন্তু কে জানত আসার সময় সন্তানদের জড়িয়ে ধরে নেয়া বিদায়ই হবে তার শেষ বিদায়।
কান্না চাপা কণ্ঠে বেলাল বলেন,‘ আমার স্ত্রী ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক একজন মানুষ। তাকে হজে আনতে আমি ২০ বছর ধরে টাকা জমিয়েছিলাম। এতদিন তার কাছ থেকে দূরেও ছিলাম। অনেকদিন পর যখন তার দেখা পেলাম, ঠিক তার কয়েক মুহূর্তপরই আবার চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেললাম’।
স্ত্রী হজের সমস্ত আনুষ্ঠানিকতাও পালন করে যেতে পারলেন না বলে আফসোস করে বেলাল বলেন,‘ সকাল সাড়ে সাতটার দিকে আমি তাকে নিয়ে জামারাতে (শয়তানকে পাথর মারার স্থান) যেতে স্ট্রিট নম্বও ২০৪ দিয়ে রওনা হতেই দেখলাম মানুষের স্রোত। এতটাই চাপ ছিলো যে দুজনেই পড়ে যাই। ভিড় আমাদের মাড়িয়ে যাচ্ছিলো। আমি কোনো রকমে উঠে আমার স্ত্রীকে রক্ষার চেষ্টা করলাম, না পেরে সাহায্যের জন্য চিৎকার করলাম। কিন্তু তখন কেউ কারো কথা শোনার অবস্থায় ছিলো না’।
দীর্ঘদিন পর দেখা হওয়া জীবন সঙ্গিনীকে হারানো বেলাল আরও বলেন,‘ সে আমাকে আর সন্তানদেরকে শেষবিদায়ও জানিয়ে যেতে পারলো না। একমাত্র সান্তনা যে পবিত্র মাটিতে তার দাফন হবে, সৃষ্টিকর্তার দরবারে পাবেন শহীদী মর্যাদা’।