শুরুটা করেছিলো জার্মানি, যখন পুরো ইউরোপ শরণার্থীদের প্রবেশের বিপক্ষে ছিলো। জামার্নের শরণার্থী গ্রহণের কারণ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানির বেশিরভাগ মানুষই শরণার্থীই ছিলো।
তারা পুরনো স্মৃতি ভুলতে পারেনি, তেমনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো এবং অন্য দেশগুলোকেও অনুরোধ করেছিল সাহায্য করতে। এমনকি মুসলমানদের জন্য অনেক জার্মান ইহুদি সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছে।
এ বছর তাই দেশটি আট লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার ঘোষণার পরও এই সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। যুদ্ধের হাত থেকে প্রাণে বাঁচতে পালিয়ে আসা মানুষগুলোকে আশ্রয় দেওয়া ছাড়া জার্মানির কোনো বিকল্প নেই। জার্মানিতে বর্তমানে আড়াই লাখের বেশি আশ্রয়-আবেদন জমা রয়েছে, যেগুলোর প্রক্রিয়া এখনো শেষ হয়নি।
জার্মানি এখন বিশ্বের সর্বনিম্ন জন্মহারের দেশগুলোর একটি। সে হিসেবে দেশটির শিল্প খাত শরণার্থীদের সম্ভাবনাময় কর্মশক্তি হিসেবে দেখছে। কিন্তু শরণার্থীদের মাত্র প্রতি ১০ জনে একজন কাজে নিযুক্ত করার উপযোগী। শিশু ও বৃদ্ধসহ বাকি নয়জনকেই দীর্ঘ মেয়াদে সামাজিক সহযোগিতা দিয়ে যেতে হবে।
প্রতিদিন আসা শরণার্থীদের জার্মানির ১৬টি অঞ্চলে ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে। এ বছরের শুরু থেকে গত সপ্তাহ পর্যন্ত জার্মানিতে ঢুকেছে সাড়ে চার লাখ শরণার্থী। তারা বলছে, ‘জার্মানিই এখন একমাত্র দেশ, যারা আমাদের মতো মানুষদের মানুষ বলে মনে করে।’
এর আগে চাপের মুখে ইউরোপীয় কমিশন জোটের ২৮টি দেশের জন্য ১ লাখ ৬০ হাজার শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে কোটা বেঁধে দেয়। এ কোটা মেনে নিতে নারাজ পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশ। আশ্রয়প্রার্থীরা কেউই চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, রোমানিয়ার মতো দেশগুলোতে থাকতে চায় না। তাদের উদ্দেশ্য জার্মানি বা সুইডেন। তাই এ কোটা কোনোভাবেই কাজ করবে না।
ইইউ এর অনেক সরকার প্রধান বলছে, ‘সিরিয়া থেকে যারা আসছে, তারা যুদ্ধের ভয়ে আসছে না। তারা আসছে মূলত প্রতিবেশী দেশের শরণার্থী শিবিরগুলো থেকে আর তাদের উদ্দেশ্য উন্নত দেশে পদার্পণ করা’।
এদিকে হাঙ্গেরি সরকার শরণার্থীদের প্রবেশের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। শরণার্থীরা তাই অন্য পথ বেছে নিয়েছে। এখন তারা স্লোভেনিয়া হয়ে উত্তর ইউরোপের পথ ধরবে তারা। লক্ষ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সমৃদ্ধ কোনো দেশে আশ্রয়। আসলে তাদের লক্ষ্যই জার্মানিতে যাওয়া অথবা ইংল্যান্ড, ইতালি কিংবা সুউডেনের মতো উন্নত দেশে। আর এই কারণেই শরণার্থীদের জায়গা দেওয়া নিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে বিভক্তি তৈরি হয়েছে।
ইইউর সীমান্ত সংস্থা বলছে, চলতি বছর এ পর্যন্ত অন্তত পাঁচ লাখ অভিবাসী ও শরণার্থী ইইউ’র বিভিন্ন দেশের সীমান্তে গেছে। এসব মানুষের অধিকাংশই সিরিয়া থেকে পালিয়েছে। গত সোমবার পর্যন্ত শরণার্থীদের অনেকে হাঙ্গেরি এবং অস্ট্রিয়া হয়ে জার্মানিতে পৌঁছায়। কিন্তু এ জনস্রোত ঠেকাতে জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার সীমান্তে এখন কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের সরকার ভূমধ্যসাগরে মানবপাচার চক্রের বিরুদ্ধে নৌ অভিযান সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থার (আইএমও) হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরে এ পর্যন্ত ৪ লাখ ৩০ হাজারের বেশি শরণার্থী ও অভিবাসী ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছেছে।
এ সময় পথেই মারা গেছে বা নিখোঁজ হয়েছে ২ হাজার ৭৪৮ জন। সংকট এতোটা জটিল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর)-এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
৯ হাজার ৩০০ কর্মী নিয়ে সংস্থাটির কার্যক্রমের বার্ষিক বাজেট ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার। জার্মানিসহ ইইউ শরণার্থী মুসলমানদের সাহায্যের জন্য মানবতার হাত বাড়ালেও তুরস্ক বাদে হাত বাড়ায়নি সৌদিসহ উন্নত আয়ের মুসলিম দেশগুলো।
ব্রিটিশ সরকার এর মধ্যে বলেছে, সৌদি সরকার যদি মুসলমানদের সাহায্য না করে, তাহলে আমরা কেনো করতে যাবো। এর মধ্যে জার্মানিতে সৌদি আরব হাজার কোটি টাকা দিয়ে ২০০ মসজিদ তৈরি করার ঘোষণা দিয়েছে। অথচ তারা সাহায্যের জন্য হাত বাড়ায়নি এইসব অসহায় মুসলিম শরণার্থীদের দিকে ।
এদিকে ইউরোপের সাধারণ মানুষ বলছে , সিরিয় শরণার্থীরা উগ্র। তাদের মধ্যে স্বাভাবিক মানুষের গুণাবলী অনেক কম। বিশেষ করে মুসলমানদের যে গুণাবলী দেখে জার্মানিসহ অনেক দেশের সাধারণ মানুষ সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছে, তারা এইসব শরণার্থীদের আচরণ দেখে বেশি হতাশ। এরই মধ্যে তিনটি চার্চ ভেঙেছে, অধিকার আদায়ের জন্য বিক্ষোভ ও ভাঙচুর করেছে।
শরণার্থীরা বলেছে, তারা যেখানে বাস করবে সেই জায়গাটায় কোনো চার্চ থাকতে পারবে না, চার্চ ভাঙচুরের কারণে পুলিশের এবং স্থানীয় প্রতিবাদকারীর সাথে তাদের সংঘর্ষও হয়েছে। শরণার্থীরা ঢাল স্বরূপ ব্যবহার করছে তাদের শিশুদেরকে। ক্যামেরার সামনে কিংবা প্রতিবাদ সমাবেশের সামনে নিয়ে আসছে এইসব অল্প বয়স্ক শিশুদের, তাদের দিকে তাকিয়ে কেউ যেনো কিছু না বলতে পারে এবং দ্রুত তারা সেখানে সমস্ত অধিকার পায়।
লক্ষাধিক শরণার্থীর ঢল যখন পুরো ইউরোপ জুড়ে তখন ইউরোপে বাংলাদেশী নাগরিকেরা আতংকিত। বেশির ভাগ দেশে সেখানকার কর্মজীবীর মানুষের আয়ের উপর ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কর দিতে হয়। এমনিতেই কাজের সংকট আর তার উপরে এই অতিরিক্ত করের বোঝা প্রায় পুরো ইউরোপ জুড়েই।
ইউরোপের বেশির ভাগ দেশই তাদের নাগরিকদের আগামী বছরের জন্য শতকরা ৩ থেকে ৫ ভাগ বাড়তি কর দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছে। কারণ এই সব অবৈধ শরণার্থীদের সুযোগ সুবিধা সাধারণ মানুষের করের টাকাতেই বহন করতে হবে। শরণার্থী হিসেবে প্রচুর বাংলাদেশী ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করেছিলো উন্নত দেশে প্রবেশ করা।
কিন্তু পুরো ইউরোপ বলছে, ‘বাংলাদেশীদের তারা তাদের দেশে প্রবেশ করতে দেবে না, কারণ বাংলাদেশে কোনো সমস্যা নেই। তাদেরকে নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে’। এর আগে ইউরোপ থেকে ‘আইএসের হয়ে যুদ্ধ করতে ৩০ জনের মতো বাংলাদেশী সিরিয়া ও ইরাকে গেছে।
এ জন্য অনেকেই বলছে ইইউ বাংলাদেশীদের ব্যাপারে নমনীয় নয়। যদিও প্রায় পাঁচ হাজার বাংলাদেশী সেখানে প্রবেশের চেষ্টা করছে।
এখন ইউরোপীয়রা মনে করছে, মুসলমানদের মধ্যে দুটি শ্রেণি আছে। একদল ধর্মীয় উগ্রপন্থী মুসলিম অন্যদল স্বাভাবিক মূল্যবোধের মুসলমান। সিরিয়রা ও ইরাকীয় প্রথম পক্ষীয়। পুরো ইউরোপ জুড়ে মুসলমান শরণার্থীদের ঢল এবং ইউরোপের খ্রিষ্টান ধর্মাম্বলীরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা যে উদ্বিগ্ন সেটা কিছু উগ্রমৌলবাদী মুসলমানদের আচরণেরই ফল।
তারা বলছে, এর পেছনে ও কোনো উদ্দেশ্য আছে যা ভবিষ্যতে ইউরোপীদের মানবতাবাদী ও অন্যান্য ধর্মালম্বীদের জন্য শুভ হবে না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)