সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মারা গেছেন। নানা ব্যস্ততায় তাঁর অসুস্থতার খবর ঠিক মত পায়নি আমি। মৃত্যুর আগেরদিন রাতে দেখলাম উনি অসুস্থ হয়ে হাস্পাতালে ভর্তি। ভাবলাম, ঠিক হয়ে যাবেন, বয়স তো আর খুউব বেশী না। উনার বয়স বেড়েছে অপমানে, না বলতে পারা ক্ষোভে দুঃখে। তাঁর বয়সী অনেক মানুষ এখনো শারীরিকভাবে অনেক শক্ত। উনি কেন থাকবেন না। রুপোর চামচ মুখে দিয়ে যার জন্ম। বিশাল সম্পত্তির মালিক হয়েও যাপন করতেন সাধারণ জীবন। গুলশান, বনানী বারিধারা বা ধানমণ্ডি নয় থাকতে জিগাতলায়, নিজ বাড়িতে। কিন্তু সকালে ঘুম ভাংগার পরেও ফেসবুকে চোখ পড়লো, দাদা নেই, চলে গেছেন না ফেরার দেশে। দেখি কয়েকজন অমানুষ তার সম্পর্কে বাজে বাজে মন্তব্য করেছে, যদিও বেশী মানুষই তাঁর জন্য মর্মাহত।
খালেদা জিয়ার মতো তাঁর রাজনৈতিক শত্রুও শোক বার্তা দিয়েছেন। স্বাধীনতা বিরোধী চখা মিয়ার ছেলে মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও মুক্তিযোদ্ধা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, তিনি সৎ লোক ছিলেন। হ’তে পারে সেটা লোক দেখানো, তবুও কম কী!
ভেবেছিলাম কথাটা বলবো না, দেরি করবো। কিন্তু আজ মনে হয় না বললে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের আত্মার সাথে বেইমানী করা হবে। তাই জানা কথা সবাইকে বলা দরকার, ঋণ শুধতে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে যারা দুর্নীতির অভিযোগ আনে তাদেরকে বলি, আপনার একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন, যে ড্রাইভার হিরো হয়েছিলো তার গ্রামের বাড়ি কোথায়? সেই ড্রাইভার কার পোষা লোক ছিল? সে কি কোন সাবেক মন্ত্রীর লোক যিনি দুর্নীতির বায়বীয় অভিযোগে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন, যার বড় বড় ব্যাবসা আছে চীনের সাথে। কিন্তু যোগাযোগ খাতে ব্যাবসা ভালো হচ্ছিল না, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জন্য। ষড়যন্ত্রের ব্যাপারটা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পরে টের পেয়েছিলেন, তাই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগপত্র গ্রহন করতে বাধ্য হয়েও তাঁকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করে রেখেছিলেন।
ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সব দেশেই সংখ্যালঘু শ্রেণির মানুষদের নানা নির্যাতন সহ্য করে থাকতে হয়। সব দেশেই সংখ্যালঘুরা তুরুপের তাস, ক্ষমতা বদলের উপজীব্য। সাম্প্রতিক কালের মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের উপর নির্মমতার ঘটনা বা আমেরিকার নির্বাচন আর তৎপরবর্তী ঘটনা তার জলন্ত প্রমাণ। সামান্য কিছু দালাল ছাড়া সব দেশেই সংখ্যালঘুরা তুলনামূলকভাবে ভালো মানুষ হয়। ব্যতিক্রম আছে কিছু যেমন ভারতে আছে বিজেপি’র মুসলমান মন্ত্রী আর বাংলাদেশের হিন্দু গয়েশ্বর রায়ের মতো রাজাকার তোষণকারী। কীভাবে তার কয়েকটি উদাহরণ এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গের সরকারী দলের লোকের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের টাকা দেওয়া হয় সংখ্যালঘুদের উস্কে দিতে। ৪ বছর আগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন নস্যাৎ করতে হেফাজতীদের হেলিকপ্টারের সারাদেশ ভ্রমনের টাকা এসেছিলো ভারত থেকে, এমন অভিযোগ আছে। এদেশের বিভিন্ন দলের এমনকি আওয়ামী লীগের সাইনবোর্ড লাগিয়েও করা হয় অত্যাচার সংখ্যলঘুদের উপর। এই বাংলায় হিন্দুদের উপর অত্যাচার হ’লে ঐ বাংলায় তথা সমগ্র ভারতে তার প্রভাব পড়ে। অপরদিকে ভারতে মুসলমানদের উপর অত্যাচার হলে বাংলাদেশে অনেকের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লাভ হয়। ভারতের সবাই জানে মমতা দিদি বা কংগ্রেস ভারতের মুসলমানদের প্রতি খুব দয়ালু। পত্র পত্রিকায় এমন দেখা গেলেও বাস্তবে অবস্থা ভিন্ন।
ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মুসলমানরা কেমন আছেন একটা খাতে তার একটা পরিসংখ্যান দেখা যাক। ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের সময় চাকরীতে মুসলিমদের অবস্থান ছিল খুব ভালো। তখন চাকরিতে মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব ছিল ৩৪%। মুসলিমদের আর্থিক অবস্থা খতিয়ে দেখতে ইন্দিরা গান্ধী ১৯৮০ সালে গোপাল কৃষ্ণ কমিশান নিয়োগ করেন। এই কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী মুসলিমরা শুধু বেকারই নয়, কিছু কিছু এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ তাদের নাম নথিভুক্ত করতেও অস্বীকার। এই রিপোর্টে আরো বলা হয় আশির দশকে মুসলিম আই.এ.এস (ইন্ডিয়ান এডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস) অফিসারের হার ছিল মাত্র ৩.২৭ শতাংশ, এই.পি.এস অফিসারের হার মাত্র ২.৭ শতাংশ এবং অনান্য কেন্দ্রীয় সরকারী চাকরিতে তাদের হার মাত্র ১.৫৬ শতাংশ। এমনকি রাজ্য স্তরের চাকরিতেও মুসলিমদের হার মাত্র ৬.০১ শতাংশ। অথচ এই রিপোর্ট প্রকাশের ৩০ বছর পরেও মুসলিমদের অবস্থা একই রয়ে গেছে।
ভারতের মুসলিমদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য কয়েক বছর আগে ভারত সরকার এক বিশেষ কমিটি গঠন করেন। কমিটির সভাপতি ছিলেন দিল্লি হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচার। তাঁর নেতৃত্বে এই কমিটি সারা ভারত জুড়ে মুসলিমদের উপর বিশাল সমীক্ষা চালায়।
সাচার কমিটির রিপোর্টটি দেখুন-
চাকরিপদ – মোট সংখ্যা – মুসলমানদের সংখ্যা – মুসলমানদের শতকরা হার
আই.এ.এস – ৩,৮৮৩ – ১১৬ – ২.৯৯ %
আই.পি.এস – ১,৭৫৩ – ৫০ – ২.৮৫ %
ইনকাম ট্যাক্স – ৮৮১ – ২৭ – ৩.৬ %
রেলওয়ে ট্রাফিক এবং আকাউন্ট – ৪১৫ – ১১ – ২.৬৫ %
ব্যঙ্ক – –(অজানা) – ২,৪৭৯ – ২.১৮ %
কেন্দ্রীয় দপ্তর – ৮,২৬,৬৬৯ – ৩,৩৪৬ – ৪.৪১ %
রাজ্য সরকারী দপ্তর – – (অজানা) ৪৯,৭১৮ – ৬.০১ %
১৯৭১ সালের তালুকদার কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ক্যাডারে ২৬৪ জন আই.এ.এস অফিসারের মধ্যে মাত্র ২ জন মুসলিম। গোপাল কৃষ্ণ রিপোর্ট অনুসারে, উল্লেখযোগ্য মুসলিম জনসংখ্যাবিশিষ্ট তিন রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, আসম ও বিহারের ক্লাস ওয়ান সেক্টরের অফিসারের মধ্যে একজনও মুসলিম নেই। সর্বভারতীয় মোট ২,২৩২ জন ক্লাস ওয়ান অফিসারের মধ্যে মাত্র ৩৬ জন মুসলিম। এর মধ্যে ২২ জনই কেরালার। উল্লেখ্য, কেরালাতে অনেক মুসলিম, ভারতের সব থেকে শিক্ষিত, স্বচ্ছল, ক্ষমতাশালী মুসলিম কেরালায়।
রাজ্যগুলিতে মুসলিমদের জনসংখ্যা ও চাকরীর হার
রাজ্য——মুসলিম জনসংখ্যা—-চাকরির হার
পশ্চিমবঙ্গ – ২৫.২ % – ২.১ %
কেরালা – ২৪.৭ – ১০.৪
উত্তর প্রদেশ – ১৮.৫ -৫.১
বিহার – ১৬.৫ – ৭.৬
আসাম – ৩০.৯ – ১১.২
ঝাড়খন্ড – ১৩.৮ – ৬.৭
কর্ণাটক – ১২.২ – ৮.৫
দিল্লী – ১১.৭ – ৩.২
মহারাষ্ট্র – ১০.৬ – ৪.৪
অন্ধ্রপ্রদেশ – ৯.২ – ৮.৮
গুজরাট – ৯.১ – ৫.৪
তামিলনাড়ু – ৫.৬ – ৩.২
পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে ভারতে মুসলিমদের সংখ্যার অনুপাতে চাকরিতে তাদের প্রতিনিধিত্ব খুবই কম। বার বার কমিশন গঠন করা হয়েছে, কমিশন রিপোর্ট দিয়েছে, সুপারিশও করেছে। কিন্তু সরকার কোন রকমের উদ্যোগ নেয়নি। তাই মুসলিমদের অবস্থার উন্নতিও হয়নি। মুসলিমদের অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে, হচ্ছে, হয়ে চলেছে। আমেরিকার একটি পত্রিকার মতে ভারতে মুসলিমদের সংখ্যা প্রায় ২৫ শতাংশের মতো। যদিও ভারত কখনোই নাকি মুসলিমদের সঠিক সংখ্যা জানায় না।
হিন্দু ধর্মমতে গরুর মাংস খাওয়া বৈধ ও উপকারী, বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ আর ইতিহাস ঘাটলে তা জানা যায় (ঋগ্বেদ ১০/৮৬/১৩ এবং ১৪; বিষ্ণু পূরাণ ৩/১৬; বেদ- ১/১৬৪/৪৩, ১/১৬২/৩, ৪/১/৬); মহাভারত খন্ড ২০৭, আরো আছে)। স্বামীজী (Collected works of Swami Vivekanonda, Advaita Asshrama, 1963, Vol III, Page-172)আর গান্ধীজীও(MK Gandhi, Hindu Drama, New Dellhi, 1991n, Page-120) গোমাংস খাওয়ার পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে সম্রাট অশোকের আমলে গো-হত্যা বন্ধ করা হয়, যিনি ছিলেন বৌদ্ধ, হিন্দু নন। তার পরে থেকে শুধু রাজনৈতিক ফায়দা নিতে ভারতে গরুকে ব্যবহার করা হয়। সাম্প্রতিক কালে গরুর মাংস খাওয়া বা রাখার দায়ে ভারতে পিটিয়ে হত্যা করা হয় নিরিহ মুসলিম নামের মানুষদের। বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মতো চমৎকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জায়গায় রসরাজদের বলির পাঠা করা হয় টাকা বা জমির লোভে। সরকারী খাস জমি দখলে সরকারী দলের সমর্থক লোকেরা সংখ্যলঘু সরলমতি সাঁওতালদের ব্যবহার করে বলি হিসেবে।
বাংলাদেশে উপজাতিসহ শতকরা কতভাগ সরকারী চাকরীতে ধর্মীয়সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দুরা আছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান সরকারীভাবে পাওয়া কঠিন। উপজাতিরা প্রায় সবাই ধর্মীয় সংখ্যালঘু, তাদের জন্য কোটা আছে ৫%। যার প্রায় পুরোটা যায় চাকমা আর গারোদের ঘরে, অন্যরা উচ্ছিষ্ট ছাড়া কিছুই পান না। ট্রান্সপারেন্সী ইন্টারন্যশানাল বাংলাদেশ তাদের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখিয়েছেন যে বাংলাদেশে মুসলিম বাদে অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সরকারী চাকরীতে প্রতিনিধিত্ব আছে শতকরা ১০ ভাগের মতো যা, তাদের মোট জনসংখ্যার অনুপাতের খুব কাছাকাছি।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণে বিভিন্ন সময়ে সরাকারের যে পদক্ষেপ তার পিছনে ক্রিয়াশীল থাকে একধরণের চাপ। সেটা দুই ভাবে হয়। এক হচ্ছে মিটিং মিছিল, অন্যটি হচ্ছে যুক্তি, তথ্য প্রমাণ ও বিশ্বদরবারে নিজেদের মর্যাদা রক্ষায় করনীয় কী তা সরকার প্রধান কে, নীতিনির্ধারকদের বুঝানো। গণজাগরণ মঞ্চ মানবতাবিরোধীদের বিচারে বিশাল সমাবেশ করে বিরাট ভূমিকা রেখেছে, সরকারকে সহায়তা করেছে। অপরদিকে হেফাজতের মহাসমাবেশ ও হুংকার সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে স্কুলের পাঠ্য বইকে ইসলামীকরণে মারাত্মক প্রভাবিত করেছে। সেখানে মুক্ত চিন্তার মানেষেরা শুধুমাত্র পত্রপত্রিকায় কলাম লিখে আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখে দায় মিটিয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চের মত একটা বড় সমাবেশ করলে, আন্দোলনে নামলে সরকার সাহস পেতো পাঠ্যপুস্তক সংশোধনে। কারণ সব সরকারই ক্ষমতার রাজনীতি করে, ক্ষমতায় টিকে থেকেই তাঁদের কাজ করতে হয়, দেশ ও দশের জন্য। ক্ষমতার বাইরে থেকে অতি বামদের মতো শব্দ বোমা মেরে দেশ ও দশের কোন উন্নতি করা যায় না।
যুগে যুগে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতো কিছু উন্নত মনের মানুষ বাংলায় ছিল বলে এখনো এখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা কিছুটা হলেও ভালো আছে। তাঁরা সরকারকে কিছুটা হলেও ব্যালান্স হ’তে সাহায্য করেন, ভালো পরামর্শ দেন। তাই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যু প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার মানুষের জন্য, একটা সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় বড় ধরণের ধাক্কা। এই ধাক্কা সামাল দিতে জাতিকে অনেক সময় দিতে হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)