কুমিরভরা খরস্রোতা নদী সাঁতরে পাড়ি দিতেন, কিংবা বালক বেলায় একবার বই পড়ে সেই বই ছিঁড়ে ফেলতেন! এমন আরো বহু কিংবদন্তি জড়িয়ে আছে যে মানুষটির নামের সঙ্গে, তিনি একে ফজলুল হক। বাংলার রাজনীতিতে এক পুরোধা ব্যক্তিত্ব তিনি। যাকে বলা হতো শেরে বাংলা বা বাংলার বাঘ!
আর সেই দাপুটে মানুষটিকে বিরাট আয়োজনে পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে ‘বোস: দ্য ফরগটেন হিরো’র শ্যাম বেনেগাল বাংলাদেশ থেকে বেছে নিয়েছেন ছোট ও বড় পর্দার জনপ্রিয় অভিনেতা শহীদুল আলম সাচ্চুকে!
বলছি বহুল আলোচিত বাংলাদেশ-ভারত এর যৌথ প্রযোজনায় নির্মিতব্য ছবি ‘বঙ্গবন্ধু’র কথা। মুজিব বর্ষ উপলক্ষ্যে মহাযজ্ঞের অংশ এই চলচ্চিত্র।
জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী নিয়ে বিগ বাজেটের এই ছবিতে কারা কারা সুযোগ পাচ্ছেন, এটি জানতে মুখিয়ে ছিলেন সবাই। সকল জল্পনা কল্পনার অবশেষে অপেক্ষার অবসান হলো। ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রে সম্ভাব্য ৫০ জন অভিনেতার নাম প্রকাশ পেয়েছে সম্প্রতি।
বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ইতিহাসের বাঘা বাঘা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদেরও চলচ্চিত্রে ফুটিয়ে তোলা হবে। এমন হেভিওয়েটদের মধ্যে একে ফজলুল হক একজন। যে চরিত্রের জন্য মনোনীত করা হয়েছে শহীদুল আলম সাচ্চুকে।
তবে মজার বিষয় হলো, এই চরিত্রের জন্য অডিশন দেননি দাপুটে এই অভিনেতা। বরং তিনি অডিশন দিতে গিয়েছিলেন বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর চরিত্রে! কিন্তু অডিশন স্থলে উপস্থিত হলে তাকে জানানো হয়, তাজউদ্দিন আহমেদের চরিত্রের জন্য প্রস্তুত হতে! তিনি স্ক্রিপ্টও পড়েছেন তাজউদ্দিন আহমেদের অংশটুকুর!
সাচ্চু বললেন, মূলত এটি ছিলো ডিরেক্টরের টেকনিক! হয়তো অভিনয়ের সতস্ফূর্ততা যাচাই করতেই এমন টেকনিক ব্যবহার করেছেন তিনি।
অডিশন পর্বে সাধারণত কাস্টিং ডিরেক্টরই থাকেন। ‘বঙ্গবন্ধু’ চলচ্চিত্রের অডিশন পর্বেও এমনটাই ঘটেছে। কিন্তু সাচ্চুর অডিশনের সময় উপস্থিত ছিলেন নির্মাতা শ্যাম বেনেগাল স্বয়ং। আর তার সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার বিষয়টিকে ‘সৌভাগ্য’ বলে মনে করেন এই অভিনেতা।
চ্যানেল আই অনলাইনকে এই সাচ্চু বলেন, আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান। কারণ যেদিন আমার অডিশন ছিলো সেদিন বিটিভিতে গিয়ে দেখি সেখানে শ্যাম বেনেগাল উপস্থিত! তিনি আমার মুখোমুখি টেবিলে বসেন। তখন দেখি তিনি চারটি ছবি নিয়ে বসেছেন। বগুড়ার মোহাম্মদ আলী, তাজউদ্দিন আহমেদ, সোহরাওয়ার্দী এবং একে ফজলুল হক।
তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার পরই আমার মাথায় হাত দিয়ে কাস্টিং ডিরেক্টরকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘ওর অডিশন লাগবে না!’ তখন কাস্টিং ডিরেক্টর শ্যামকে বললেন, ‘না স্যার, ওনার ছবি তোলা লাগবে, স্ক্রিন টেস্ট এগুলোর ব্যাপার আছে’। এরপর আমাকে স্ক্রিপ্টের তাজউদ্দিন আহমেদের অংশ থেকে ডায়ালগ দিতে বলা হলো।
এক চরিত্রের জন্য অডিশন দিতে এসে আরেক চরিত্রের জন্য যখন স্ক্রিপ্ট পড়লাম, কৌতুহলবশত তখন বিষয়টি কাস্টিং ডিরেক্টরের সঙ্গে আলোচনা করছিলাম। যা চোখ এড়ায়নি শ্যাম বেনেগালের। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী বলছি! তখন আমি বললাম যে, আমাকে তো মোহাম্মদ আলীর চরিত্রের জন্য বলা হয়েছিলো। তখন শ্যাম আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘এটা আমাদের স্টাইল, আর তুমি জানো না, তুমি কে?’-এমন কথা শুনে আমিও বললাম, ‘ইয়েস, আমিও ডিরেক্টর পারফর্মার’। -বলছিলেন সাচ্চু।
মোহাম্মদ আলীর চরিত্রের প্রস্তুতি নিয়ে অডিশন দিতে গিয়ে স্ক্রিপ্ট পড়লেন তাজউদ্দিন আহমেদের। প্রকাশিত তালিকায় একে ফজলুল হক চরিত্রে নাম দেখেও তাই বিস্মিত নন সাচ্চু। কারণ তিনি ইতোমধ্যে জেনে গেছেন, এটি পরিচালক শ্যাম বেনেগালের নিজস্বতা!যাকে যে চরিত্রে কাস্টিং করার, সেটা তারচেয়ে ভাল আর কেউ জানেন না!
বরং শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পাওয়ায় গর্ব অনুভব করছেন তিনি। সাচ্চু বলেন, শ্যাম বেনেগাল কতো বড় নির্মাতা! তার সক্ষমতা সম্পর্কে কারো সন্দেহ নেই। তিনি মহাত্মা গান্ধী, জহুরলাল নেহেরু, সত্যজিৎ রায়ের মতো মানুষদের নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন, সুভাষ বোসকে নিয়ে ফিচার ফিল্ম করেছেন, এবং সবগুলোই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এমন খ্যাতিমান নির্মাতার নির্দেশনায় ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর সুযোগ পাওয়া ই তো আমার অভিনয় জীবনে পরম পাওয়া।
দৈহিক গড়নের কারণে কি তবে একে ফজলুল হকের চরিত্রে আপনাকে মনোনীত করেছেন নির্মাতা, এমনটা মনে হয় আপনার? প্রশ্নে শহীদুল আলম সাচ্চু বলেন, ‘হতে পারে! তবে সেটা পুরোটাই ডিরেক্টর পারস্পেকটিভ! আগেই বলেছি, আমি ডিরেক্টর পারফর্মার!’
নিজের অনুভূতির কথা ব্যক্ত করে সাচ্চু বলেন, যার জন্য বাংলা ভাষা কতোটা শক্তিশালী সারা বিশ্বে সেটা প্রমাণ হলো, যার জন্য এই দেশ স্বাধীন হলো- সেই মানুষের (বঙ্গবন্ধু) জীবনী নিয়ে নির্মিতব্য সিনেমায় সামান্যতম অংশগ্রহণ থাকতে পারাটাইতো বিশাল! তাছাড়া ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধু আমার কাছে ছিলেন ‘রাসেলের আব্বা’। কারণ আমাদের বাসা ছিলো কলাবাগান, রাসেলের সঙ্গে আমরা খেলতে যেতাম। ৩২ নম্বরের বাড়িতে ঢুকতে যেতে যখন পুলিশ আমাদের পথ আটকাতো, তখন বঙ্গবন্ধু পুলিশকে বলতেন ‘এদের ঢুকতে দাও, এরা রাসেলের বন্ধু’!
তবে এমন গর্বের দিনেও কিছুটা বিমর্ষ শহীদুল আলম সাচ্চু। বললেন, বিরাট আয়োজনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জীবনী নির্ভর ছবিতে আমাদের পরিবারের দু’জন অভিনয় করছি। আমি ছাড়াও আমার ভাতিজা শতাব্দী ওয়াদুদ ও একটি চরিত্রে অভিনয় করবেন। অথচ এমন আনন্দের খবর পাওয়ার এক সপ্তাহ আগে আমার বড় ভাই ফিরোজ আলম (শতাব্দী ওয়াদুদের বাবা) মারা গেলেন। তিনি বেঁচে থাকলে এই খবরে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হতেন। কারণ তিনি শেখ কামালের কাছের বন্ধু ছিলেন।
একে ফজলুল হকের চরিত্রটি পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে ব্যক্তিগতভাবে পুনরায় ইতিহাসে মনযোগ দিচ্ছেন শহীদুল আলম সাচ্চু। বললেন, ফজলুল হক সম্পর্কে ইতিহাস থেকে আমরা যতটুকু জেনেছি আবার সেগুলো জানবো। ডিরেক্টরের গাইড লাইনের অপেক্ষায় আছি, স্ক্রিপ্ট দেখলেও একটা ধারণা পাওয়া যাবে। মানসিক প্রস্তুতির জায়গা থেকে আমি চেষ্টা করছি তিনি কীভাবে হাঁটতেন, চলতেন, ফিরতেন এগুলো রপ্ত করা।