কোটি কোটি তরুণ-তরুণীর দেশ বাংলাদেশ। এর চাইতে কম ও বেশি সংখ্যক তরুণ-তরুণীর সংখ্যা আর বহু দেশে স্বাভবতই আছে। কিন্তু বাংলাদেশসহ মাত্র গোটা কতক দেশের তরুণ-তরুণীর কিছু কিছু খবর আমাদের দেশের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়ে থাকে যার অধিকাংশই নেতিবাচক। আবার কেন নেতিবাচক তা কোন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণও কোন পত্রিকার পৃষ্ঠায় স্থান পেতে সচরাচর দেখা যায় না। ফলে, তাদের জীবনের ও ভূমিকার সামগ্রিক চেহারাটি ফুটে ওঠে না।
এক নজরে বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের প্রসঙ্গে যে যে খবর আমরা আমাদের পত্র-পত্রিকায় দেখে থাকি-তা হলো তাদের আক্রমণ (কখনও হয়তোবা সশস্ত্র) বিরোধী দলের মিছিল বা সমাবেশের ছিনতাই, নারী অপহরণ, ধর্ষণ প্রভৃতি। মূলত এগুলি সরকারদলীয় তরুণ-তরুণীদের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়। বিরোধীদলের সমর্থন তরুণ-তরুণীরাও কোন ভিন্ন ছবি তুলে ধরতে পেরেছে-এমনটা সচরাচর দেখা যায় না। অর্থাৎ শক্তির কাছে দুর্বল অসহায় শুধু সামাজিক এবং নৈতিক ক্ষেত্রে নয়-আইনের অধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত যদিও অতীতে নৈতিকতা সমৃদ্ধ তরুণ-তরুণী তাদের আচার ব্যবহার, পোশাক-আশাক চলাফেরা প্রভৃতির ক্ষেত্রে এই উপমহাদেশে উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতো-আজ সে দেশটাতেও সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যার জন্যে সন্ত্রাস, নারী ধর্ষক, খুন, চুরি-ডাকাতি প্রভৃতি অপরাধ আজ ক্রমবর্ধমান।
সঠিকভাবে জানা না থাকলেও একথা দৈনন্দিন সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, সে দেশের তরুণদের অধ:পতন সার্বিক ক্ষেত্রেই অবর্ণনীয়। দৈনিক যে দেশে মসজিদে বোমাবর্ষণ করে ৫০ থেকে ১০০ জন প্রার্থনারত মানুষকে হত্যা করা হয় ধর্মের নামে-সে দেশ যে ভয়াবহ রকমের একটি সন্ত্রাসী দেশ-তা বুঝতে কোন অসুবিধা হয় না এবং সন্ত্রাস যারা করেন-তারা শতকরা ৯০ ভাগই তরুণ-তরুণী। তবে তাদের ওস্তাদ ও বোমা তৈরী ও চালনা যারা শিক্ষা দেন তারা রীতিমত বয়স্ক। পাকিস্তানের এই সন্ত্রাস মুসলিম বনাম মুসলিম-কে খাঁটি মুসলিম তাই নিয়ে দ্বন্দ্ব। এ এক বিস্ময়কর ধর্মীয় আচরণ-যার নিন্দা কোন মোল্লা মৌলভীদের তরফ থেকে কদাপি উচ্চারিত হয় না। সে দেশে যে কোন মুসলমান মরছে না-মরছে অগণিত নিরপরাধ মানুষ-মারছে যারা তারাও ভুল এবং ক্ষতিকর শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ-এই উপলব্ধি যাঁদের মনে বিরাজিত-তারা যেন অসহায় দর্শক-কার্যকর কোন কিছু করার ক্ষমতা যেন তাদের হাতে নেই। রাষ্ট্র দৃশ্যতই সন্ত্রাসীদের প্রভাব দূর করতে অক্ষম তার নৈতিক দুর্বলতা ও অপরাপর ঘাটতির কারণে।
পাকিস্তান যখন অবিভক্ত ছিল-অর্থাৎ বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের আগ পর্যন্ত দেশটির সার্বিক পরিস্থিতি এতটা খারাপ ছিল না-প্রধানত পূর্ব বাংলায় শক্তিশালী গণ আন্দোলন ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে চলমান থাকার প্রভাব-প্রতিক্রিয়া জনিত কারণে। সেই পূর্ব বাংলা ৫১ বছর আগে একটি নবীন গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পর যেন নতুন করে সাম্প্রদায়িকতা ও সন্ত্রাসের কবলে পড়তে চলেছে। অথচ, আগেই উল্লেখ করেছি, পশ্চিম পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক উগ্রতা ও সহিংসতা বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণে থেকেছে পূর্ব বাংলার তরুণদের গণতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ ও লাগাতার আন্দোলন। এতে পূর্ব বাংলার ধর্মীয় সন্ত্রাসীরাও মাথা তুলে দাঁড়াতে সাহস করেনি। তারা যেন লুকিয়েছিল অন্ধকার কুঠুরিতে।
কিন্তু ওই অন্ধকার কুঠুরিগুলি থেকে তারা দলে বলে হিংস্র শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে ঠিকই আবার বেরিয়ে এসেছিল ১৯৭১ এ পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রশ্রয়ে তাদের উৎখাতে এবং তাদেরই আশ্রয়ে ধর্ম রক্ষা-ইসলাম ও পাকিস্তান রক্ষার তথাকথিত আহ্বানে। ধর্ম বা ইসলাম ও পাকিস্তান রক্ষা করতে হবে কাদের হাত থেকে? হিন্দু ভারত নিয়ন্ত্রিত মুক্তিবাহিনীর হাত থেকে। এক ঢিলে দুই পাখি মারার চেষ্টা। ধর্ম ও পাকিস্তানকে এক করে দেখানো এবং হিন্দু-ভারত নিয়ন্ত্রিত মুক্তিবাহিনী বলে স্বাধীনতার বীর যোদ্ধাদেরকে পাকিস্তানের দুশমন-ইসলামের দুশমন বলে চিহ্নিত করা।
কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক সরকার তাদের সেনাবাহিনী ও ওই সেনাবাহিনী সৃষ্ট আলবদর, রাজাকার ও আলশামসের হত্যায় মাত্র নয় মাসের বেশি টেকেনি। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে চীন ও আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের কতিপয় রাষ্ট্র ব্যতিরেকে গোটা বিশ্ব যখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিবাহিনীর পক্ষে দাঁড়ালো-তখন নিমেষেই আবার তাদের পালাতে হলো। বাংলাদেশ নামক নতুন অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক ও সমাজতন্ত্রকামী রাষ্ট্রের অভ্যূদয় ঘটলো। পাকিস্তান ও ইসলাম রক্ষক বলে যারা ওদেরকে বিভ্রান্ত করেছিল তাদের মূল পাণ্ডা বাংলাদেশ ভারত যৌথ বাহিনীর কাছে ঢাকার বৃহত্তম ময়দানে প্রকাশ্যে হাজার হাজার জনতার সামনে যৌথ বাহিনী প্রধানদের কাছে অস্ত্র ও আত্মসমর্পন করলো। বাংলাদেশের কোটি যুবক-যুবতী সমগ্র দেশ জুড়ে অজস্র বিজয় মিছিল সেদিন বের করেছিল। আবারও পালিয়েছিল সারা দেশের যুবক যুবতীর বের করা হাজার হাজার মিছিল থেকে লাখো কণ্ঠে “জয়বাংলা” “জয় বঙ্গবন্ধু” “বাংলাদেশ অমর হোক” এমন সব গগণ বিদারী শ্লোগান শুনে তাদের বুকে কাঁপন ধরার ফলে।
এই যে লাখো লাখো আঞ্চলিক যুবক সেদিন “জয়বাংলা” শ্লোগানে চতুর্দিক মুখরিত করে শত্রুর বুকে কাঁপন ধরিয়েছিল আজ আর তারা যুবক-যুবতী নেই। তারা আজ বাবা-মা-ও না। তারা আজ দাদা-দাদী, নানা-নানী, দাদু-দিদু প্রভৃতি এবং এদের এক বড় অংশ আজ আর এ পৃথিবীতে বেঁচেও নেই। তাই আমাদের তরুণ প্রজন্মগুলি তাদের পূর্বসূরীদের চিন্তু-চেতনা-ভাবনার ধারাবাহিকতা হারিয়ে ফেলেছে।
১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যা, সামরিক শাসক হিসেবে জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব, সংবিধান ও সকল মৌলিক অধিকার স্থগিত, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ, জামায়াতে ইসলামী সহ সকল ধর্মাশ্রয়ী দলের বৈধতা প্রদান, গোলাম আজম পাকিস্তানের নাগরিক ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্বেও তাকে সম্মানে বাংলাদেশে ভিসা ও দেশে ফিরে আসার পর নিরাপত্তা প্রদান ইত্যাদি বলে দেশেল রাজনীতি পাকিস্তানী ভাবধারা ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করা হলো। বাহাত্তরের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র রাইফেলের বাঁট দিয়ে তুলে দেওয়া হলো। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে কারারুদ্ধ করা হলো-পূর্বে আটক করা রাজাকার-আলবদরদের মুক্তি দেওয়া হলো…অসংখ্য সেনা-মুক্তিযোদ্ধাকে বিচারের নামে প্রহসন করে কারাগারে ফাঁসি দিয়ে দেশব্যাপী এক ভয়াবহ সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হলো, রাজনৈতিক দলগুলিকে নিষিদ্ধ করা হলো। সুকৌশলে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ ও ভারত বিরোধী প্রচারণা আবার শুরু হলো। লুকিয়ে থাকা আলবদর রাজাকারেরা একে একে তাদের গোপন আস্তানা থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলো। মানুষকে বিভ্রান্ত করতে সংবিধানের শুরুতে “বিসমিল্লাহ” সংযোজন করা হলো।
অতর্কিত ও অকল্পিত এই পরিস্থিতির শুরুতেই যে তীব্র গণ আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজন ছিল-নেতৃত্বের মারাত্মক দুর্বলতা এবং সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে নিস্পৃহতা প্রভৃতি কারণে তা সম্ভব না হওয়ায় সামরিক বাহিনী ও শত্রুপক্ষ সংহত হতে পারলো। তবে ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায় বামপন্থী তরুণ-তরুণীরা এই হত্যালীলার বিরুদ্ধে তাৎক্ষনিক প্রতিবাদ মিছিল বের করে সামান্য হলেও জাতির সামনে আশা ভরসা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু সার্বিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে প্রচুর বিলম্ব ঘটায় সে আশা ভরসার ধারাবাহিক রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
যা হোক, অত্যধিক বিলম্বে হলেও এক পর্যায়ে এসে সকলে ঐক্যবদ্ধ হওয়া গেল। যুব সমাজের পরিপূর্ণ অংশ না পাওয়া গেলেও একটি বড় অংশ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে এলো। ইতোমধ্যে জিয়াউর রহমান নিহত এবং অপর সামরিক শাসক হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করলেন। তিনি শীঘ্রই একটি রাজনৈতিক দল গঠন করলেন-যেমন করেছিলেন জিয়াউর রহমান। এরশাদ সংবিধানটি জিয়ার মত সংশোধন করে সংযোজন করলেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হইবে ইসলাম। দেশের সর্বোচ্চ আদালত জিয়ার “বিসমিল্লাহ্, ধর্মাশ্রয়ী দলগুলির বৈধতা এবং এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম” অবৈধ ঘোষণাপর পর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সংসদে দুই তৃতীয়াংশে সংখ্যাধিক্যের জোরে উচ্চ আদালত প্রদত্ত রায়কে নস্যাৎ করে পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ করলেন এবং তাতে জিয়ার “বিসমিল্লাহ্” ধর্মাশ্রয়ী দলগুলির “বৈধতা” এবং এরশাদের “রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকেও স্থায়ী বৈধতা দিয়ে দেশবাসীর মনে ক্ষোভ ও বিস্ময় সৃষ্টি করলেও সরকার তা আমলে নেননি।”
জামায়াতে ইসলামীসহ বড় দলগুলির অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি উৎসাহিত হলো-সকল মুক্তিযুদ্ধের ও তার আদর্শের এবং বাহাত্তর সংবিধানের মূলনীতি সমূহে অটল শক্তিগুলি মুক্তিযোদ্ধাদের বেশীরভাগ এভাবে বঙ্গবন্ধুর মূলনীতি পরিত্যাগ ও জিয়া-এরশাদের স্বাধীনতা বিরোধী সাম্প্রদায়িক সংবিধান মেনে নেওয়াকে আজও সমর্থন করতে পারছেন না। এর ফল আজ দৃশ্যমান। দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি উৎসাহিত এবং বহু সংখ্যক সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটিয়েও তারা এমন কি রাষ্ট্রীয় আইনের হাত থেকে রেহাই পেয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানের অনুসারী এই রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার মুসলিম সমাজ মুসলিম সন্ত্রাসীদের হাতে-আর বাংলাদেশে সহিংসতা ঘটাচ্ছে মুসলিম জঙ্গী ও সন্ত্রাসীরা, ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান ও আদিবাসীদের বিরুদ্ধে। এখানে নতুন নতুন জঙ্গীসংগঠন ইসলামের নামে গজিয়ে উঠছে যেমন হেফাজতে ইসলাম। এরা প্রকাশ্যেই বাঙালি সংস্কৃতিরও বিরোধী।
এই জঙ্গী সংগঠনগুলিতে বিপুল সংখ্যক যুবক-যুবতী আকৃষ্ট হয়ে যোগ দিচ্ছে প্রয়োজনে গিয়ে দেশান্তরে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরছে। এদের মগজ ধোলাই করা। এরা বুঝেছে জঙ্গীপনার মাধ্যমে হত্যা প্রভৃতি করলে সরাসরি বেহেশতে যাওয়া যাবে। পরকাল তাদেরকে টানছে-ইহকাল নয়। ফলে অনেক জঙ্গী যুবক অকালে প্রাণও হারাচ্ছে। এর কারণ গভীরভাবে অনুসন্ধান করতে হবে।
আমার বিবেচনায়
এক. রাজনীতিতে কালো টাকা ও দুর্বৃত্তায়ন ব্যাপক যুব সমাজকে হতাশা প্রাপ্ত করায় তারা রাজনীতি থেকে দূরে থাকছে।
দুই. এই হতাশার সুযোগ নিয়ে জামায়াত হেফাজত তাদের মগজ ধোলাই করে সহজে বেহেশত প্রাপ্তির লোভ দেখিয়ে তাদের একাংশকে আকৃষ্ট করছে।
তিন. সাম্প্রদায়িকীকরণকৃত পাঠ্যপুস্তক শিশুকাল থেকেই তাদেরকে সাম্প্রদায়িক করে গড়ে তুলছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)