চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

ডেঙ্গু পরিস্থিতি ও পেঁপে পাতা সমাচার

রাজধানীতে ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু জ্বর। শুধু রাজধানী নয়, রাজধানীর বাইর থেকেও ডেঙ্গু রোগীর খবর আসছে।

ভরা বর্ষায় কখনো বৃষ্টি, আবার বৃষ্টি শেষে সূর্যের প্রতাপ। এই ধরণের আবহাওয়া ডেঙ্গু বাহক এডিস মশা প্রজননকে উস্কে দিচ্ছে। সাধারণত বর্ষার পরে মানে আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস ডেঙ্গুর মৌসুম হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। কিন্তু এবছরের শুরু থেকেই ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হতে শুরু করেছে।

হাসপাতালের বিছানায় ডেঙ্গুর সঙ্গে লড়াই করা এসব মানুষ ও তাদের পরিবারের চোখে অপরাধী সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসনের দিকেই। যদিও এই পরিস্থিতিতেও এখনো নগর কর্তৃপক্ষের দাবি, ‘ভয়ের কিছু নেই, নেয়া হচ্ছে ব্যবস্থা’। তারা ভয়ের কিছু না দেখলেও জনগণ কিন্তু ঠিকই উদ্বিগ্ন। সামাজিক মাধ্যমগুলিতে জনগণ অনেকদিন ধরেই সেসব প্রকাশ করছে নিয়মিত।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা
সর্বশেষ ১৬ জুলাই রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ২১৪, যা এ বছর একদিনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। শেষ ৭ দিনে এই সংখ্যা গড়ে প্রায় ২শ’। ঘণ্টায় প্রায় ৭/৮ জন করে নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৪,৮৫২ জন। এর মধ্যে ১,০২২ জন বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। তার মানে চলতি বছরে মাত্র সাড়ে ছয় মাসে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে এসেছেন প্রায় ৫ হাজার মানুষ।

ডেঙ্গু কন্ট্রোল রুম সূত্র জানা গেছে, জানুয়ারিতে ৩৮ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ফেব্রুয়ারিতে এই সংখ্যা ছিল ১৮ জন, মার্চে ১৭ জন, এপ্রিলে ৫৮ জন, মে মাসে ১৯৩ জন, জুন মাসে ১৭৫৯ জন এবং জুলাই মাসে এ পর্যন্ত ২৮০৭ জন (১৬ জুলাই পর্যন্ত) ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। সেখানে গত বছর মে-জুলাই মাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৩২২ জন।

তবে একটি জিনিস লক্ষনীয় যে, সরকার ডেঙ্গুতে আক্রান্তের যে সংখ্যা প্রচার করছে, প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি। কারণ শুধুমাত্র নামকরা হাসপাতালগুলোর রোগীর সংখ্যা মনিটরিং করছে সরকারি কন্ট্রোলরুম, পাড়া-মহল্লার মাঝারিমানের হাসপাতাল-ক্লিনিক এখনও কাভারেজে আসেনি। আর গত বছরের সংখ্যার সঙ্গে তুলনা করলে বর্তমান পরিস্থিতিকে ভয়াবহ বলা যেতেই পারে।

ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হারও গত বছরের চেয়ে বেড়েছে। এপ্রিল থেকে জুলাইয়ে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ১১ জন (১২ জুলাই পর্যন্ত)। এর আগে ৩ জনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছিল সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। গত বছর একই সময়ে মৃত্যু হয়েছিল ৭ জনের।

এই যে উপরে আক্রান্ত ও মৃতের পরিসংখ্যান, এসব দেশের মানুষ তথা রাজধানীবাসীকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে শিশুসহ অনেকের মৃত্যুর খবর তা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর এসবের জন্য দায়ি করা হচ্ছে সিটি কর্পোরেশনকে। ডেঙ্গুর বর্তমান পরিস্থিতিকে মহামারী পর্যায়ে উল্লেখ করে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন হাইকোর্ট। সেইসঙ্গে দুই মেয়রকে ভৎর্সনাও করেছেন আদালত।

কী করছে সিটি কর্পোরেশন?
তবে সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে, তারা অসহায়। আর তারা পরোক্ষভাবে জনগণের ঘাড়ে দোষ চাপাতে দুই মেয়র বার বার জনগণের বাড়িঘর পরিষ্কারের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। জনগণ নাহয় তাদের বাড়িঘর নিজেরাই পরিষ্কার করলো, কিন্তু বাড়িঘরের বাইরে যেসব জায়গা আছে সেখানে সেভাবে সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রম চোখে পড়ছে না। মাঝে মাঝে পাড়া-মহল্লার গলিতে নালাতে কেরোসিন আর ধোঁয়া সর্বস্স ওষুধ ছিটাতে দেখা যাচ্ছে। তবে চিন্তার কথা হচ্ছে, মশা মারতে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন যে ওষুধ ব্যবহার করে, তা অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (সিডিসি) পৃথক দুটি গবেষণায় দেখেছে, এই ওষুধে মশা মরছে না।

এই অবস্থায় পত্রিকায় ডেঙ্গু সচেতনতায় সিটি কর্পোরেশনের বিজ্ঞাপন আর সভা-সেমিনারের মেয়রদ্বয়ের ‘টোটকা চিকিৎসা আর উপদেশ যুক্ত’ বক্তব্য হজম করতে হচ্ছে রাজধানীবাসীকে। কোনো মেয়র একবার বলছেন, ভয়ের কিছু নেই। আবার কোনো মেয়র বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে পেঁপে পাতার রস খেতে।

এক মেয়রের সঙ্গে দেখা গেল ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে, তিনি আশ্বাস দিলেন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা করবেন। মেয়রও মার্কিন দূতের কথায় বেশ সন্তোষের ভঙ্গিতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বক্তব্য দিলেন।

মেয়রদেরকে এইসব বক্তব্য আর কার্যক্রমে জনগণ বিরক্ত আর ক্ষুব্ধ হয়ে আলোচনা-সামলোচনা করলেও সিটি কর্পরেশনকে কোনো বিশেষ কার্যকর পদক্ষেপ নিতে এখনও দেখা যাচ্ছে না, যাতে জনগণ আত্মবিশ্বাসী হয় পরিস্থিতি মোকাবেলায়। বর্তমানের দুই মেয়রকে তাদের নির্বাচনের আগে পরিষ্কার জায়গা ঝাড়ু দিয়ে নির্বাচনের প্রচারণা শুরু করতে দেখা গেলেও ডেঙ্গুর এই মহামারীর কাছাকাছি পরিস্থিতিতে সেরকম কিছু করতে দেখা যায়নি।

ডেঙ্গুর এই পরিস্থিতিতে করণীয় কী?
সিটি কর্পোরেশন আর রাজধানীবাসীর সমন্বিত চেষ্টা ছাড়া এই অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে মনে হচ্ছে না। সিটি কর্পোরেশন বিশেষ করে রাজধানীর দুই মেয়রকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কাজ করা দরকার। রাজধানীর যেসব এলাকা এডিস মশার আবাস ও প্রজনন এলাকা হিসেবে আগে থেকেই চিহ্নিত, সেখানে বড় আকারের অভিযান পরিচালনা করে সচেতনতার সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার করা জরুরি প্রয়োজন। তাদের কার্যক্রম দেখে ভরসা আর সাহস পেলেই জনগণ এগিয়ে আসবে। শুধু শুধু জনগণের সচেতনতা বাড়ানো বিষয়ে বারবার কথা বলে, মশা মারার দায়িত্ব জনগণের ঘাড়ে চাপালে কাজ হবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া গণমাধ্যম বরাবরই সোচ্চার ডেঙ্গুর মতো যেকোনো পরিস্থিতিতে। সেখানেও তাদের বর্তমান কার্যক্রমকে তুলে ধরা ও জনগণকে আহ্বান জানানোর কাজও একসঙ্গে চলতে পারে।

আবার জনগণকেও শুধু সিটি কর্পোরেশনের আশায় বসে না থেকে নিজেদের উদ্যোগেও ডেঙ্গু নিধনে এগিয়ে আসতে হবে। ব্যক্তিগত, স্কুল-কলেজ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে হতে পারে এডিসের প্রজননস্থল চিহ্নিত করে তা পরিষ্কার করার কাজ। বাড়ি/অফিস বা বাড়ির আঙিনায়, গলি-ঘুপচি বা বাড়ির ছাদে-টবে-নারিকেলের মালা-টায়ারে কোথাও যেন পরিষ্কার পানি জমে না থাকে সে ব্যাপারে সচেতন ও সতর্ক দৃষ্টি রাখা জরুরি।

ডেঙ্গুতে আক্রান্তের ঝুঁকি ও চিকিৎসা
এবার আসা যাক, ডেঙ্গুতে আক্রান্তের ঝুঁকি ও চিকিৎসা বিষয়ে। ডেঙ্গু জ্বরের জন্য দায়ী এডিস মশা শুধু দিনের বেলায় কামড়ায়, সেজন্য দিনের বেলায় সচেতন ও সাবধান থাকলে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমতে পারে। এডিস মশা সাধারণত ভোরবেলা ও বিকেল থেকে সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে ডেঙ্গুর সংক্রমন ঘটায়। এই সময়গুলোতে শিশুরা সাধারণত ঘুমে থাকে বলে তারাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। দিনের বেলা ঘুমালেও মশারি বা মশা দূর করার ওষুধ ব্যবহার করা উচিত। এছাড়া ভোরবেলা টয়লেটে যাবার সময়ে, নামাজ পড়তে মসজিদে গেলে সেখানে, সকালে অফিসে যাবার সময় বিভিন্ন যানবাহনের ভেতরেও এডিস মশা থাকতে পারে। এসব বিষয়ে সাবধান হওয়া একান্ত কাম্য।ডেঙ্গু জ্বর-মশা

চিকিৎসকদের ভাষ্যমতে, ডেঙ্গু আক্রান্তদের সম্পূর্ণ ভালো না হওয়া পর্যন্ত বিশ্রামে থাকতে হবে। এ ছাড়া যথেষ্ট পরিমাণে পানি, শরবত ও অন্যান্য তরল খাবার খেতে হবে। জ্বর কমানোর জন্য শুধুমাত্র প্যারাসিটামল জাতীয় ব্যথার ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। অ্যাসপিরিন বা ডাইক্লোফেনাক জাতীয় ব্যথার ওষুধ খাওয়া যাবে না বলে সাবধানও করেছেন তারা। এতে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। ৪ থেকে ৫ দিন জ্বর থাকলে ঘরে বসে না থেকে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। চিকিৎসকদের পরামর্শ মোতাবেক নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা ও তার ফল অনুসারে ব্যবস্থা নিলে সুস্থ হয়ে ওঠে আক্রান্তরা। যেহেতু এই জ্বরে মৃত্যু ঝুঁকি আছে, সেজন্য সিটি মেয়র বা অন্য কারো কথামতো পেঁপে পাতার রস খাওয়া বা কোনো টোটকা চিকিৎসা নেবার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলা উচিত। নিজে নিজে বা ঘরোয়া কোনো চিকিৎসা অবশ্যই না।

সবার সম্মিলিত চেষ্টা ও সচেতনতায় এই পরিস্থিতি যত তাড়াতাড়ি নিয়ন্ত্রণে আসবে, ততই মঙ্গল।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)