১৯৯১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আর্ন্তজাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের যৌথ উদ্যোগে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, প্রতিবছর ১৪ নভেম্বর ‘বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস’ পালন করা হবে। দিনটি পালনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে ডায়াবেটিস রোগের লক্ষণ, গতিধারা, চিকিৎসা এবং রোগটি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা সর্ম্পকে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা।
১৪ নভেম্বর ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে ঘোষণার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো এই দিন ফ্রেডারিক ব্যাটিং এর জন্মদিন। ফ্রেডারিক ব্যাটিং তার সহযোগী চার্লস বেষ্টকে নিয়ে ডায়াবেটিস রোগ নির্ণয়ের মহৌষধ ইনস্যুলিন আবিস্কার করেন। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়-‘স্বাস্থ্য সম্মত খাবারই ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের উপায়’।
বর্তমান বিশ্বের প্রায় ৩৮২ মিলিয়ন মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ২০৩০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা ৫০ কোটি ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ২০৩৫ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রায় ৫৯২ মিলিয়ন মানুষ অথবা প্রতি ১০ জনে ১জন ডায়াবেটিস রোগী পাওয়া যাবে।
ডায়াবেটিস রোগী কর্মক্ষেত্রে নানা ভাবে বৈষম্যের শিকার হন। আর তাই ডায়াবেটিস রোগীদের অন্যান্য নাগরিকের মতো চিকিৎসা সেবা প্রদান ও সেই সাথে তাদের শিক্ষা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা জাতিসংঘ ঘোষিত মানবাধিকার আইনের অন্যতম প্রধান শর্ত।
আর্ন্তজাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের ১০০টির বেশি সদস্যভুক্ত দেশে একই চেতনায় এই দিবসটি পালন করা হয়। পৃথিবীর উন্নত দেশে যে সব রোগের কারণে মৃত্যু ঘটে বা ঘটার আশঙ্কা থাকে, সেসব রোগের মধ্যে ডায়াবেটিস এর অবস্থান চতুর্থ।
বাংলাদেশে প্রতি বছর ব্যাপকভাবে ডায়াবেটিস রোগী বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজধানীর শাহবাগের ৬৫০ বেডের ডায়াবেটিস হাসপাতাল (জেনারেল) এবং ডায়াবেটিক সমিতির অধিভুক্ত দেশব্যাপী ৫৬টি কেন্দ্র রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। ডায়াবেটিস মূলত দুই ধরনের। এগুলো হল: টাইপ-১ ও টাইপ-২। টাইপ-২ রোগীদের রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা সম্ভব। টাইপ-১ ইনসুলিন নির্ভরশীল ডায়াবেটিস ও টাইপ-২ ইনসুলিন অনির্ভরশীল ডায়াবেটিস।
টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে শিশুই বেশি। তাদেরকে ইনসুলিন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারে শিশু থেকে ২০ বছরের নীচের বয়সী ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বেশি বলে জানা যায়। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কোনো কোনো শিশু-কিশোরের ক্ষেত্রে টাইপ-১ ও ২ উভয় ধরনের ডায়াবেটিসের বৈশিষ্ট্য থাকে।
এ ক্ষেত্রে রোগটিকে প্রায়শ: ‘হাইব্রিড’ মিশ্রিত বা দ্বৈত ডায়াবেটিস বলা হয়। শিশু-কিশোরদের ওজনাধিক্য ও মেদবাহুল্যের সাথে এটি সম্পৃক্ত। সম্প্রতি রাজধানীর কয়েকটি স্কুলে জরিপ চালিয়ে দেখা যায় যে, ফাস্ট ফুডে অভ্যস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ডায়াবেটিসের হার বেশি। এই সকল খাবারে অভ্যস্থদের ওজন ও মেদ বেড়ে যায়। পাশাপাশি রক্ত চাপ বাড়তে থাকে। অন্যান্য ভেজাল ও বিষাক্ত খাদ্যসামগ্রী নিয়মিত খাওয়ার কারণেও ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
দুধে মেলামাইন, তরল দুধ ও ফরমালিন মেশানো মাছ, পোড়া মবিল দিয়ে ভাজা হয় চানাচুর, ইউরিয়া সার ব্যবহৃত বেকারির খাবার, বস্ত্রকল ও ট্যানারির বিষাক্ত রংয়ের সংমিশ্রণে তৈরি হরেক রকম খাদ্যসামগ্রীও ডায়াবেটিস সৃষ্টির অন্যতম চিহ্নিত কারণ।
এক পরিসংখ্যান মতে, শতকরা ৯০ ভাগ ডায়াবেটিস রোগীই ইনস্যুলিন অনির্ভরশীল। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের জটিলতায় হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনীর অক্ষমতা প্রভৃতি রোগের ঝুঁকি বেশি থাকে। বাংলাদেশে বারডেমের কেন্দ্রীয় গবেষণা ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান এক পরিসংখ্যানে দেখিয়েছে যে, ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশে মোট ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ছিল ১০ লাখ। ১৯৯৫ সালে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ২৫ লাখে দাঁড়ায়। অর্থাৎ এই হিসাব অনুযায়ী প্রতিদিন-ই ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
গত এক যুগ ধরে নবজাতক থেকে শুরু করে ২০ বছরের কম বয়সী ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ডায়াবেটিসের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। বিষাক্ত খাদ্যসামগ্রীর কারণে ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ অভিমত পোষণ করছেন। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি এবং ডায়াবেটিস হাসপাতালের পরিসংখ্যানে জানা যায়, চাহিদার তুলনায় ডায়াবেটিস হাসপাতাল এবং ডায়াবেটিক সমিতির অধিভুক্ত ৫৬টি কেন্দ্রে ও ন্যাশনাল হেলথ নেটওয়ার্কের মাত্র ২০ ভাগ রোগীর চিকিৎসা দেয়া সম্ভব। এই হিসাব অনুযায়ী শতকরা ৮০ ভাগ রোগী-ই চিকিৎসার বাইরে থাকছে।
গবেষকদের ধারণা অনুযায়ী একজন ডায়েবেটিস রোগীর বিষন্নতায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা সুস্থ ব্যক্তির চেয়ে অনেক বেশি। ডায়েবেটিস সর্ম্পকে সুষ্ঠু জ্ঞান না থাকায় এ ধরণের অবস্থার সৃষ্টি হয়। ২০০২ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বিষন্নতায় একজন ডায়াবেটিস রোগীর চিকিৎসা খরচ একজন সাধারণ ডায়াবেটিস রোগীর চিকিৎসা খরচের প্রায় পাঁচ গুণ।
ডায়াবেটিস গ্রীক শব্দ। প্রাচীন গ্রীক চিকিৎসক এরিটিউস এই নামকরণ করেন। অতিরিক্ত পিপাসা ও অতিরিক্ত মূত্রত্যাগ এই রোগের বৈশিষ্ট্য। ডায়াবেটিস মেলিটাস রোগের মূল কারণ ইনসুলিনের অভাব। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ, পরিশ্রমহীন বা নিয়ন্ত্রণহীন জীবনযাপন বিপাক ক্রিয়াকে আরো দুর্বল করে দেয়। এ অবস্থায় ইনসুলিন নামে শরীরের একটি প্রয়োজনীয় হরমোন প্রয়োজন মতো উৎপন্ন হতে পারে না। ফলে খাবারের সঙ্গে গ্রহণ করা কার্বোহাইড্রেট ঠিকমতো বিপাক হয় না। ওই কার্বোহাইড্রেট বা শর্করাই প্রস্রাবের সঙ্গে বার বার বের হয়ে আসে। যদিও সব বহুমূত্রই শর্করাযুক্ত নয়। শর্করাবিহীন বহুমূত্রও আছে, যাকে বলা হয় ডায়াবেটিস টাইপ-২।
২০১৪ সালের হিসাব অনুযায়ী পৃথিবীতে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ৩৯ কোটি। ২০০৩ সালেও যা ছিল ১৯.৪ কোটি। আর এভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ পৃথিবীতে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৪৩.৯ কোটি। ২০১০ হতে ২০৩০ এই দু দশকে উন্নয়নশীল দেশে ডায়াবেটিস রোগী বাড়বে ৬৯% আর উন্নত দেশে বাড়বে ২০%। অর্থাৎ উন্নয়নশীল দেশসমূহকে বহন করতে হবে ক্রমবর্ধমান রোগীদের বোঝা, যা উক্ত দেশসমূহের সরকারের জন্য বহন করা কঠিন হবে। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের হিসাব মতে, প্রতি ১০ সেকেন্ডে দুজন নতুন করে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় এবং প্রতি ১০ সেকেন্ডে একজন মৃত্যুবরণ করে ডায়াবেটিস ও তার দ্বারা সৃষ্ট জটিলতার কারণে।
যে কারও পক্ষেই ডায়াবেটিসের ভয়াবহতা আঁচ করা সম্ভব। আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়বে ৫৪ শতাংশ, প্রতি বছরে ২.২ শতাংশ হারে। ৩৬ শতাংশ বৃদ্ধি শুধুমাত্র ভারত ও চীন দেশে। ২০২০ সাল নাগাদ অর্ধেকের বেশী মার্কিনী নাগরিক ডায়াবেটিকস-এ আক্রান্ত হবে কিংবা ডায়াবেটিসসজনিত কারণে ভুগবে। এর ফলে এক দশকে স্বাস্থ্যসেবা খাতে ব্যয় বাড়বে ৩ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যবীমা ইউনাইটেড হেলথ গ্রুপ কর্পোরেশন এর প্রকাশিত প্রতিবেদনে একথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশও পূর্ণবয়স্ক ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির দিক থেকে সারা পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ডায়াবেটিস এসোসিয়েশন এর হিসাব মতে প্রায় ৮৪ লাখ ডায়াবেটিস রোগী থাকলেও আগামী ২০৩০ সালে বাংলাদেশ হবে পৃথিবীর ৭ম বৃহত্তম পূর্ণবয়স্ক ডায়াবেটিস রোগী বসবাসকারী দেশ, যেখানে বসবাস করবে ১ কোটি ১১ লক্ষ পূর্ণবয়স্ক রোগী।
তাছাড়া শিশু রোগীর সংখ্যা বর্তমানে ১৫ হাজারের বেশী, যা ক্রমবর্ধমানশীল। উন্নত বিশ্বে যেখানে বেশীর ভাগ ডায়াবেটিস রোগীর বয়স ৬০ বছরের উর্ধ্বে, সেখানে উন্নয়নশীল বিশ্বে সবচেয়ে বেশী রোগীর বয়স ৪০ থেকে ৬০।
সংসারের উপার্জনক্ষম ও কর্মক্ষম জনশক্তিরাই মূলত: এ রোগে আক্রান্ত। শহুরে আধুনিক জীবনযাপন পদ্ধতি এর জন্য আংশিক দায়ী। কায়িক পরিশ্রমহীন জীবনযাপন পদ্ধতি ও শরীরের ওজন বৃদ্ধি না থামাতে পারলে ভবিষ্যতে এ রোগ আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধে শুধু নিজে সচেতন হলেই চলবে না, অন্যকেও সচেতন করতে হবে। এছাড়া ফাস্ট ফুড ও কোমল পানীয় জাতীয় খাবার পরিহার করলে এবং শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে ‘টাইপ-২’ জাতীয় ডায়াবেটিস অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব।