২৭ জুলাই পাবলিক সার্ভিস দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণহারে টিকাদানের আহবান জানিয়েছেন। তার কথার নির্জাস; গ্রামেগঞ্জের সমস্ত ধরনের মানুষের দ্রুত টিকার আওতায় আনতে হবে। একইদিনে করোনা ভাইরাসের (কোভিড ১৯) সংক্রমণ পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং কোভিড-১৯ প্রতিষেধক টিকা দেওয়া জোরদার করা নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় ৭ আগস্ট থেকে সারাদেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকা দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হবে। বলা হয়েছে- গ্রামে টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন জরুরি নয়, নিবন্ধন না করা হলেও শুধু এনআইডি কার্ড নিয়ে গেলেই টিকা (যারা ৫০ বছরের উর্ধ্বে) প্রদান করা হবে।
সরকারের এই ঘোষণা নিঃসন্দেহে উদ্দীপণামূলক ও একই সাথে আশাব্যাঞ্জক। বর্তমানে যেভাবে গ্রামের মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে তাতে করে দ্রুততম সময়ে গ্রামের সাধারণ মানুষের টিকার আওতায় আনা হবে উত্তম এবং সঠিক পদক্ষেপ। কেননা টিকা নিশ্চিত করা না গেলে কোনোভাবেই মৃত্যুহার কমিয়ে আনা সম্ভব হবে না- সংক্রমণের প্রবণতাও সেটাই বলছে।
গত পাঁচ মাসে দেশে টিকার কাভারেজ সেভাবে বাড়েনি। এখন (২৮ জুলাই) এ পর্যন্ত মোট জনসংখ্যার মাত্র ২.৬১ শতাংশ মানুষ দুই ডোজ টিকা নেওয়া সম্পন্ন করেছে। এক ডোজ টিকা গ্রহণ করেছে মাত্র ১.৬০ শতাংশ। টিকা প্রদানের এই ধীরগরি কারণে স্বাস্থ্যবিভাগের সার্বিক পরিকল্পনা নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অনেকেই শুরু থেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছিলেন। বলা হচ্ছে প্রতিদিন বর্তমান সময় থেকে টিকা প্রদানের হার কয়েকগুণ বাড়ানো না হলে বেশিরভাগ মানুষকে দ্রুত টিকার আওতায় আনা সম্ভব হবে না। আর সেটা না হলে আমাদের জন্য বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। যতই লকডাউন দেওয়া হোক-টিকা প্রদান নিশ্চিত করতেই হবে।
শুরুতে টিকা নিয়ে সমাজে নানা ধরনের অপপ্রচার এবং ভীতি তৈরি হলেও সে অবস্থা এখন নেই। এখন টিকা নেওয়ার বিষয়ে সবার মাঝেই আগ্রহ লক্ষণীয়। টিকা কেন্দ্রগুলোতে ব্যাপক ভীড়ই বলে দিচ্ছে সবাই এখন টিকা নিতে আগ্রহী। করোনার ব্যাপক বিস্তরণের ফলে সবচেয়ে অবিশ্বাসী মানুষটিও বুঝতে পেরেছে টিকা না নেওয়ার বিকল্প কিছু নেই। প্রতিষেধক হিসেবে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত চার ধরনের টিকা ব্যবহার করা হচ্ছে। সর্বশেষ বিপুল পরিমাণ মর্ডানার টিকা এসেছে বাংলাদেশে।
করোনা এখন গ্রামেগঞ্জে হানা দিয়েছে। বাংলাদেশের এমন কোনো গ্রাম নাই যেখানে করোনাক্রান্ত নেই। করোনার সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার দুটোই এখন তাই উর্ধ্বগতি। শুরুতে মরণঘাতক করোনা আমাদের দেশে অনেকটাই রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরকেন্দ্রীক থাকলেও গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এই চিত্রটা পুরোই পাল্টে গেছে। বিশেষ করে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমিত হওয়ার পর সীমান্ত এলাকার জেলাগুলোতে করোনার দ্রুত এবং ব্যাপক বিস্তরণ ঘটে। এরকম পরিস্থিতিতে গ্রামে সরকারের টিকাদান পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে সবাইকে আশ্বস্ত করবে। স্বাস্থ্যবিভাগের তথ্য অনুযায়ী এ পর্যন্ত দেশে মোট টিকা এসেছে ২ কোটি ১৫ লাখ ৪৫ হাজার ডোজ। ২৫ জুলাই পর্যন্ত টিকার জন্য নিবন্ধিত হয়েছেন ১ কোটি ২১ লাখ ৩৭২ জন। এর মধ্যে টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছেন ৭৫ লাখ ৬০ হাজার ৩৭২জন, দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ৪৩ রাখ ৫ হাজার ৯৬৫ জন।
এ বছরের ২৭ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে টিকা দান শুরু হয়। এদিন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র নার্স রুনু ভেরোনিকাকে প্রথম টিকা দেওয়া হয়। এর আগে ২১ জানুয়ারি প্রথম ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকার ২০ লাখ টিকা উপহার হিসেবে ভারত থেকে আমাদের দেশে আসে। এরপরই টিকাদানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সরকার। এরপর ২৫ জানুয়ারি ভারতে সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তির প্রথম চালানের ৫০ লাখ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন দেশে আসে। ৭ ফেব্রয়ারি থেকে পর্যায়ক্রমে গণ টিকাদান শুরু হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টার পর ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কেনা আরও ২০ লাখ ডোজ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন ঢাকায় পৌঁছে। ২৬ মার্চ ঢাকায় পৌঁছে ভারতীয় উপহারের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ১২ লাখ ভ্যাকসিন। ৮ এপ্রিল ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মনোজ মুকুন্দ নরভানে ঢাকায় বাংলাদেশের (তৎকালীন) সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের কাছে ১ লাখ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন হস্তান্তর করেন।
১ মে চীন বাংলাদেশকে উপহার হিসেবে প্রথম দফায় ৫ লাখ সিনোফার্মের ভ্যাকসিন প্রদান করে। ৩১ মে দেশে এসে পৌঁছায় টিকার বৈশ্বিক উদ্যোগ কোভ্যাক্স প্রকল্পের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ফাইজারের টিকা ফাইজার বায়োএনটেক কোভিড-১৯ এর ১ লাখ ৬২০ ডোজ টিকা। ১৩ জুন চীন থেকে সিনোফার্মের ৬ লাখ উপহারের ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় চালান ঢাকায় আসে। ২ জুলাই টিকার বৈশ্বিক উদ্যোগ কোভ্যাক্সের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের উপহার মডার্নার ১৩ লাখ করোনার ভ্যাকসিন দেশে এসে পৌঁছায়। এরপর ৩ জুলাই চীনের সিনোফার্ম থেকে কেনা ১১ লাখ ডোজ করোনা ভ্যাকসিন ঢাকায় আসে। ৩ জুলাই দ্বিতীয় ধাপে চীনের সিনোফার্ম থেকে কেনা আরও ৯ লাখ ভ্যাকসিন আসে। একই দিনে টিকার কোভ্যাক্সের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের উপহার মডার্নার তৈরি প্রায় সাড়ে ১২ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন দেশে আসে। এদিকে ১৭ জুলাই চীন থেকে কেনা সিনোফার্মের ভ্যাকসিনের ১০ লাখ ডোজ ঢাকায় আসে। ১৮ জুলাই আরও ১০ লাখ ডোজ আসে। ১৯ জুলাই সোমবার আমেরিকা থেকে কোভাক্সের আওতায় পাঠানো মর্ডানার ৩০ লক্ষ টিকা গ্রহণ করে বাংলাদেশ। এই টিকার বড় অংশ সংরক্ষণের জন্য ইনসেপ্টার ধামরাইস্থ ফ্রিজারে রাখা হয়। বিশ্বজুড়ে টিকা সরবরাহের আন্তর্জাতিক প্লাটফর্ম কোভাক্সের আওতায় জাপান থেকে ২ লাখ ৪৫ হাজার ২০০ ডোজ অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকার টিকাও সম্প্রতি এসেছে বাংলাদেশে। সরকার বিভিন্ন দেশ থেকে অধিক সংখ্যক টিকা আনতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত বিষয়ক দাতব্য প্রতিষ্ঠান ‘গ্লোবাল চেঞ্জ ডাটা ল্যাব’ জানাচ্ছে (২৮ জুলাই পর্যন্ত) বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অন্তত ২৭.০৫ শতাংশ মানুষ এখন পর্যন্ত এক ডোজ করে টিকা পেয়েছেন। দুই ডোজ করে টিকা পেয়েছেন ১৩.৯ শতাংশ মানুষ। টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ৩১তম। এখন পর্যন্ত সর্বসাধারণের টিকা প্রদানে এগিয়ে রয়েছে কানাডা। এরপরেই রয়েছে যুক্তরাজ্য, স্পেন, ইতালি, জার্মান, ফ্রান্স, আমেরিকা, সৌদিআরব, আর্জেন্টিনা, তুর্কি, ব্রাজিল, মালয়েশিয়া, জাপান।
বাংলাদেশে এখন করোনার যে দ্রত সংক্রমণ বা বিস্তার তা ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট। এ বিষয়টি বেশ আগেই নিশ্চিত করেছে দেরে রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ। মূলত সীমান্তবর্তী জেলাগুলো থেকেই ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট প্রবেশ করে। প্রথমে দেখা যায় সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে মানুষ তুলনামূলক বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। সেই আক্রান্তের হার দ্রুতই বাড়তে থাকে বিধায় সরকার দেশব্যাপী কঠোর লকডাউন দিতে বাধ্য হয়। করোনাভাইরাসের ভারত ভ্যারিয়েন্ট-যেটার বৈজ্ঞানিক নাম দেওয়া হয়েছে বি.১.৬১৭- প্রথম ভারতে শনাক্ত হয় গত বছরের অক্টোবর মাসে। এই ধরণটিকেই ‘ডেল্টা’ বলা হচ্ছে। এর আগে সংক্রামক রোগের তথ্য সংগ্রহ ও আদান প্রদানে নিয়োজিত আর্ন্তজাতিক সংস্থা জিআইসএইড-এর ডাটাবেজ জানিয়েছিল ২০টিরও বেশি দেশে ভারতীয় ধরনের করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে।
বিশ্বের নামকরা বিজ্ঞানী এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন খুব সহসাই মরণঘাতক করোনা ভাইরাস যাচ্ছে না। বরং দিন যতই যাচ্ছে ততই করোনা ভাইরাস তার রুপ পাল্টিয়ে নতুন নতুন রুপে আবির্ভূত হচ্ছে। ফলে এই ভাইরাস সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ভ্যারিয়েন্টের কথা বলেছেন বিজ্ঞানীরা। এ পর্যন্ত যে সব ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে বিজ্ঞানীরা বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ইউকে ভ্যারিয়েন্ট, ব্রাজিল ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টসহ আরও কয়েকটি ভ্যারিয়েন্ট।
সরকারের পক্ষ থেকে ইউনিয়নভিত্তিক টিকা প্রদানের যে পরকিল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে সেটি সাধুবাদযোগ্য। টিকার আওতায় সবাইকে না আনতে পারলে সংক্রমণ কমিয়ে আনা অনেক কঠিন ব্যাপার। আমরা ইতিমধ্যেই দেখতে পেয়েছি ভারতে দ্রুত টিকা প্রদানের ইতিবাচক ফলাফল। কিছুদিন আগে ভারতের পশ্চিমবাংলাসহ কয়েকটি রাজ্যে করোনা মারাত্মক রুপ গ্রহণ করলেও টিকার কারণে মৃত্যু ও সংক্রমণ দুটোই কমে এসেছে। দুই ডোজ এবং এক ডোজ মিলিয়ে ভারতে ২৫ শতাংশেরও বেশি মানুষের টিকা প্রদান সম্পন্ন হয়েছে।
ইউনিয়ন এবং গ্রাম পর্যায়ে টিকা নিশ্চিতকরণে এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সু-ব্যবস্থাপনা। রেজিস্ট্রেশন এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করার জন্য অবশ্যই দক্ষ জনবল ও স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়োগ দিতে হবে। একই সাথে সতর্ক থাকতে হবে টিকা প্রদান নিয়ে যেনো কোনো ধরনের অপপ্রচার এবং বিশৃঙ্খলা তৈরি না হয়। গ্রামের বড় অংশ মানুষ এখনও নিরক্ষর। এই মানুষদের টিকা নিশ্চিতকরণের জন্য জনপ্রতিনিধিদেরও বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। পরিকল্পিতভাবে গ্রামে-গঞ্জের মানুষের দ্রুত টিকা আওতায় আনতে পারলে সর্বমহলে বিশ্বাস ও আস্থা তৈরি হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)