সড়কে নিত্য দুর্ঘটনা, প্রাণহানি-যাকে অনেকে ‘হত্যা’ বলতে চান; এসব কমিয়ে আনা, বন্ধ করা কি খুবই কঠিন? সম্ভব নয়? তাহলে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়ক চাই, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বলে বার বার রাজপথে নামছে কেনো? নিরাপদ সড়কের দাবিতে কেনো অবরোধ হচ্ছে সড়ক-মহাসড়ক?
এক সপ্তাহ সময় দিয়ে রাজপথ থেকে ঘরে ফিরে গিয়েছে শিক্ষার্থীরা। কর্তৃপক্ষের কাছে রেখে গেছে কতগুলো দাবি। সড়ক দুর্ঘটনা, প্রাণহানি নিয়ে ভাবছে ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষ’।
পুলিশের এক বড় কর্মকর্তা বলেছেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এখনি ব্যর্থতার দায় নিতে নারাজ। তিনি বলেছেন, ব্যর্থ নন, তবে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এতো গেলো কথার ফুলঝুরি। কাজের কাজ হবে কি?
যেহেতু চার দশক ধরে এই শহরে থাকি, এই শহরে ঘুরি ফিরি, বাসে চড়ি, কথা বলি বাসের চালক, হেলপার, কন্ডাক্টদের সঙ্গে। কথা বলি রিকশা, স্কুটার চালকদের সঙ্গে। ঝগড়া-বিবাদ করি মাঝে মাঝে। আর বুঝে নিতে চাই এই শহরের যানজট, দুর্ঘটনা, পুলিশি হয়রানি নিয়ে তাদেরও ভাবনা কম নয়।
রাজপথে দায়িত্ব পালনকরা পুলিশদের প্রতি বাস চালক-সহকারীদের সমীহটা কেমন তা বোঝা যায় হেলপারের সাবধানবাণিতে-‘ওস্তাদ সামনে ছারপোকা।’
পুলিশ সার্জেন্টকে ‘ছারপোকা’ নাম দিয়েছে ওরা। আর পাইভেটকারকে ওরা বিবেচনা করে ‘প্লাস্টিক’ হিসেবে। অধিকাংশ পরিবহণ শ্রমিক নেশা করে। বাসের ভেতর ধূমপানে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তারা মানে না। পুলিশের দৃষ্টিসীমার ভেতরেই অহরহ আইন ভাঙে তারা।
জ্যাম-জটের শহরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিতি বিরক্তিভাব নিয়ে গাড়ি চালায়, আর সুযোগ পেলেই বেপরোয়া হয়।
তো সেই বাস চালকই যখন নতুন কথা বলেন, তখন মনে হয় কত সহজে কত জটিল সমস্যার সমাধান সম্ভব। আমি তার নাম, ধাম মনে রাখিনি। তিনি উত্তরা থেকে মহাখালী পর্যন্ত পাশের সিটের যাত্রী ছিলেন। ঢাকা শহরে ৩০ বছর বাস চালান। তিনি বলছিলেন, এতো আইন, এতো কথা বলে লাভ নেই। মহাসড়কের কথা বলতে পারবো না। ঢাকা শহরের ভেতরের দুর্ঘটনা পুলিশ চাইলে একদিনে বন্ধ হয়ে যাবে। যানজটও থাকবে না। তার কথায় আমি রীতিমত নড়েনড়ে বসি। শতভাগ মনোযোগ দিয়ে তাকাই তার দিকে। তিনি দৃঢ়ভাবে বললেন। কেবল একটা ঘোষণা লাগবে। আর সে অনুযায়ী কাজ। পুলিশ বলবে, ‘কাল থেকে সড়কে ঘষা খাওয়া কোনো গাড়ি দেখলেই মামলা’!
তারপর তিনি ব্যাখ্যা দিলেন, আমার কাছে জানতে চাইলেন অনেক কিছু। বললেন, তিনি কখনো দেশের বাইরে যাননি। যারা গেছেন, তাদের কাছে গল্প শুনেছেন সেসব দেশে রাস্তায় ঘষাখাওয়া, ছালবাকল উঠে যাওয়া গাড়ি সড়কে চলতে পারে না। আর গাড়ির সামনে পেছনে বাম্পার লাগানোর প্রয়োজন পড়ে না। সেখানে ইচ্ছে করে কেউ কারো গাড়িতে ঘষা দেয় না।
ধাক্কা দেয় না। চলতে চলতে যদি ধাক্কা লাগে, যার দোষ সে শাস্তি পায়। তিনি বললেন, আমাদের চালকরা শিক্ষিত না। ‘ওস্তাদ’-এর হাত ধরে সহকারী থেকে চালক হয়। বেশির ভাগ চালকের সংসারের অভাব অনটন। বাস চালানোর সময় বাসযাত্রী থেকে শুরু করে পুলিশ, চাঁদাবাজ, বাসমালিক, শ্রমিক নেতাদের কাছ থেকে পদে পদে তাদের বাজে ব্যবহার হজম করতে হয়। আর যেহেতু শহরে বেশিরভাগ বাস চলে চুক্তিতে। তাই দিন শেষে ভাড়া আর সংসার চালানোর টাকা তোলার জন্য থাকে তীব্র তাড়া। এসব ভেবেই সড়কে বেপরোয়া হয় চালক। মাঝে মাঝে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সেই চালক, নেমে যাওয়ার সময় হাসতে হাসতে আরো একটা কথা বলে গেলেন, ‘এদেশের পুলিশ ভালো হলে আশি ভাগ সমস্যা থাকবে না।’
তারপর থেকে প্রতিদিন আমি এই শহরে, সারা দেশে সড়কে প্রাণহানির খবর পাই। দিনে-দুপুরে জেব্রা ক্রসিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রকে চাপা দেয়ার ঘটনায় আবার রাজপথ উত্তাল হয়। ঢাকার বাইরে বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে চাকায় পিষ্ট করা হয় আরেক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রকে।
এসব নিয়ে দেশ উত্তাল হয়। কিন্তু সড়কে মৃত্যু কমে না। কোনো প্রতিশ্রুতিই কাজে লাগে না। সভা হয়, সেমিনার হয়, অনেক পরিকল্পনা হয়। খবর পাই, ঢাকা শহরকে দুর্ঘটনা ও যানজটমুক্ত করতে পুলিশ কতগুলো সুপারিশ করেছে। সমন্বিত উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে সবখানে। তারপরও কাজ হচ্ছে না কেনো?
এ দফায়, বিশ্ববদ্যালয় ছাত্র আবরারের মৃত্যুও পর শিক্ষার্থীদের উত্তাল আন্দোলনের মুখে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র, পুলিশ কমিশনার কথা দিয়েছেন সব দাবি তারা মেনে নিয়েছেন।
একটু একটু করে পূরণ করা হবে সেসব। ২৮ মার্চ পর্যন্ত সময় বেধে দিয়েছিলো শিক্ষার্থীরা।
আজ সে দিন। এরপর কী হবে? ঢাকা শহরের সড়কে আর একটিও প্রাণ যাবে না গাড়ির আঘাতে? আর চলবে না একটিও ফিটনেস ছাড়া গাড়ি?
দুই বাস আর প্রতিযোগিতা করবে না বেপরোয়া ভাবে? ধাক্কা দেবে না, ঘষা দেবে না অন্য গাড়িকে? এবং আমরা এই শহরে আর রঙ উঠে যাওয়া, ধাক্কা, ঘষা খেতে খেতে এবড়ো-খেবড়ো হয়ে যাওয়া একটি বাসও দেখবো না!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)