প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ শেষ না হওয়া পর্যন্ত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা পেছানোর দাবিতে সোমবার নির্বাচন কমিশনে যায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের একটি প্রতিনিধি দল। বৈঠকে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনার এক পর্যায়ে নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেন বলেন, আপনাদের ওপর ত জনগণের আস্থা নেই।
ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময় পেছানো, ইভিএম বাতিল, বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েনের মাধ্যমে ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশের দাবি জানানো হয়।
বৈঠকে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার দাবি জানানো হলে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে জাতীয় ঐক্য ফ্রন্টের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয় বলে চ্যানেল আই অনলাইনকে জানিয়েছেন নাগরিক ঐক্যর আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না।
তিনি বলেন, ইভিএম নিয়ে নির্বাচন কমিশন একটু বাড়াবাড়ি করেছিল। জাতীয় ঐক্য ফ্রণ্টের পক্ষ থেকে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশনার শাহাদত হোসেন বলেন, ইভিএম মেশিন না দেখেই মন্তব্য করা হচ্ছে। ইভিএমে কারচুপি করা সম্ভব নয়। তিনি ঐক্যফ্রন্টকে উদ্দেশ্য করে বলেন, প্রয়োজনে আপনারা টেকনিক্যাল লোক দিয়ে যাচাই করেন।
এ পর্যায়ে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আমি নিশ্চিত করে বলছি ইভিএমে ম্যানুপুলেট (কারসাজি) করা সম্ভব। তিনি বলেন, আমরা এখনে নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থা জানাতে আসিনি। যদিও আপনাদের ওপর জনগণের আস্থা নেই।
এ সময় কমিশনার শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিও ত জনগণের আস্থা নেই।’
মান্নার বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা বলেন, আপনারা বড় বড় কথা বলেন..। সিইসির বক্তব্য শেষ না করতেই মান্না বলেন, মাইন্ড ইয়োর ল্যাঙ্গুয়েজ।
কোন রাজনৈতিক দলকে ইসি অমন কথা বলতে পারে কি না? এমন এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘এ ধরণের কোন মন্তব্য অামি নিজ কানে এখনো শুনিনি। আমি রব মান্নার বৈঠক পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনের কথা শুনেছি। ওনারাতো এ ধরণের কোন অভিযোগ করেনি সেখানে। নিজ কানে যেহেতু এই ধরণের মন্তব্যর কথা শুনিনি সুতরাং এ মুহূর্তে এসব বিষয়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না।’
এ বিষয়ে চ্যানেল আই অনলাইনের পক্ষ থেকে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এ টি এম শামসুল হুদাকে ফোন করা হলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বৈঠক শেষে গণমাধ্যমকে দেয়া এক ব্রিফিংয়ে আ স ম রব বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আমাদের আন্তরিক পরিবেশে আলোচনা হয়েছে। আমাদের দাবিগুলোর মধ্যে কিছু বিষয়ে তারা কথা দিয়েছেন যে, এগুলো তারা রক্ষা করবেন। আর কয়েকটি বিষয়ে আমাদের কোনো সিদ্ধান্ত জানাতে পারেননি, তবে পরে জানাবেন বলেছেন।’
দাবিগুলোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রথম দাবি ছিল সংলাপ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তফসিল ঘোষণা না করা। আমরা তাদের বলেছি, অতীতের বহু নির্বাচন হয়েছে বহুবার তফসিল পিছিয়েছে কিন্তু কোন সমস্যা হয়নি। অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা না করে নির্বাচন হলে তা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সংসদের মেয়াদ আছে। সুতরাং তফসিল পেছালে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।’
ঐক্যফ্রন্ট নেতারা একযোগে না এসে বিচ্ছিন্নভাবে আসায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের বৈঠক শুরু হবার কথা ছিল বেলা ৩টায়। কিন্তু বৈঠক শুরু হয় ৪৩ মিনিট পর।
বৈঠকে যোগ দিতে সবার আগে আসেন মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি এসে বাকিদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে এক পর্যায়ে ইসির ক্যান্টিনে বসে চা পান করেন।
বিকেল ৩টা ৪৩ মিনিটে বৈঠক শুরু হবার বেশ কিছু পর যোগ দেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ। ঐক্যফ্রন্টের ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদলের জন্য অপেক্ষায় থাকা সিইসি নেতাদের দেরি করে আসা নিয়ে বেশ বিরক্তিও প্রকাশ করেন।
এর আগে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংলাপ শেষ হওয়ার পর একাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল পেছানোর দাবিতে ৩ নভেম্বর ইসিকে ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেনের পক্ষ থেকে চিঠি দেয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।
ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘৮ নভেম্বরের পরে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাথে প্রধানমন্ত্রীর আবারো সংলাপের বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আবারো প্রধানমন্ত্রীর সাথে সংলাপে বসার ব্যপারে ইচ্ছুক।’
এর পরও নির্বাচন কমিশন ৮ নভেম্বর তফসিল ঘোষণা তারিখ নির্ধারণ করার প্রেক্ষিতে সোমবার বিকেলে নির্বাচন কমিশনের কাছে দ্বিতীয় দফায় তারিখ পেছানোর দাবি নিয়ে যায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।
আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ওই প্রতিনিধিদলে আরও ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা বরকতউল্লা, গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ ও সুলতান মনসুর।
এ দাবির প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত ৭ তারিখের ছোট পরিসরের সংলাপে নজর রাখবে ইসি।
তবে ইভিএমর ব্যবহারের বিষয়ে এর আগে নির্বাচন কমিশনের এক বৈঠক শেষে বলা হয়, সীমিত আকারে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। সারা দেশে ৪০২০০ ভোট কেন্দ্র রয়েছে, তার মধ্যে শুধু মাত্র শহরকেন্দ্রিক ভোটকেন্দ্রগুলোতে ইভিএম ব্যবহার করে ভোট গ্রহণ করা হবে।
সংবিধান মেনে নিরপেক্ষতার সঙ্গে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, বিএনপিসহ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো ইতিমধ্যে সংলাপ শেষে কমিশনের কাছে তাদের দাবি দাওয়া উত্থাপন করেছে। তবে ইসির সঙ্গে সংলাপের শুরু থেকেই ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মত পার্থক্য থেকে যায়। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার ইভিএম ইস্যু ছারাও নির্বাচন কমিশনের সভায় বেশ কিছু বিষয়ে একমত হতে না পারা এবং কথা বলার স্বাধীনতা না পাওয়ার অভিযোগে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে সভা বর্জন করলে বেশ সমালোচনায় পড়ে নির্বাচন কমিশন।