ব্রেক্সিট ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ ভোটাভুটিতে মাতৃত্বকালীন ছুটিতে থাকা অবস্থায় প্রক্সি ভোট দিয়ে ইতিহাস গড়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিক।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ইতিহাসে মাতৃত্বকালীন ছুটিতে থাকা অবস্থায় এই প্রথম কোনও এমপি ভোট দিয়েছেন। অবশ্য এজন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে টিউলিপকে। দুই দিন পিছিয়ে দিতে হয়েছে তার দ্বিতীয় সন্তান রাফায়েলের জন্মের সময়।
কিন্তু টিউলিপের জন্য এই সিদ্ধান্ত নেয়া মোটেও সহজ ছিল না।কীভাবে তা সম্ভব হয়েছে সম্প্রতি সেই ঘটনা তুলে এনেছেন গ্রাজিয়া ডেইলির এক প্রতিবেদক।
এই প্রতিবেদক টিউলিপের বাসায় গিয়ে দেখেন, রোদ ঝলমলে রান্না ঘরে ছেলে রাফায়েলের যত্ন নিচ্ছেন হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবার্নের এমপি টিউলিপ। তিনি ছেলের যত্ন নিচ্ছেন, একই সঙ্গে আবার হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ব্রেক্সিট ইস্যুতে ভোটের খবর রাখছেন।
ব্রেক্সিটকে গুরুত্ব দিতে গিয়েই অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে তাকে। ব্রেক্সিট ভোট মিস করতে চাননি বলেই দীর্ঘদিন ধরে পার্লামেন্টে প্রক্সি ভোটের জন্য লড়াই করেছেন। এই লড়াইয়ে নিজ দল থেকেও নেতিবাচক সাড়া পেয়েছেন বলে জানান তিনি।
কিন্তু অবশেষে তিনি সফল হয়েছেন। নিজে উপস্থিত হয়ে ব্রেক্সিট ইস্যুতে সর্বশেষ যে ভোট দিয়েছেন, সেদিন তাকে হুইল চেয়ারে করে যেতে হয়েছিল। অনেক ঝুঁকি ছিল, তারপরও দমে যাননি তিনি। এজন্য রাফায়েলের সিজারের দিনক্ষণ পিছাতে হয়েছিল তাকে। হাসপাতাল থেকে ছুটে গেছেন পার্লামেন্টে।
কীভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? টিউলিপের জবাব ছিল, আমি স্বামী এবং মায়ের কাছ থেকে অনেক উৎসাহ পেয়েছি। আমি রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে, আমার মা বলেছেন, যখন তোমাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তখন ভাবতে হবে কোনটার প্রতি তোমার আগ্রহ বেশি এবং তোমাকেই সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
টিউলিপ বলেন, আমার স্বামী বলেছেন, তোমার শরীর, তোমাকেই সিদ্ধঅন্ত নিতে হবে। কিন্তু আমি ভীত ছিলাম, তবে সৌভাগ্য যে রাফায়েল ভালভাবে দুনিয়াতে এসেছে।
টিউলিপ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে’র প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। ওই রাতে মে আমার কাছে এসেছিলেন, আমাকে জিজ্ঞেস করেনে আমি রাতে কীভাবে ঘুমাবো। মে সেসময় তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভোটে হারতে বসেছেন, সেখানে আমি তার কাছে খুবই নগন্য বিষয়, এরপর তিনি আমার কাছে এসেছেন এবং দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, তোমাকে এভাবে দেখে আমি সত্যিই অনেক ব্যথিত।
তিনি বলেন, আমি কিলবার্নের কোন অফিসে অভ্যর্থনার কাজ করা কোন নারীর সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, অফিসে যেতে দেরি হলে তাদের কতটা মানসিক যন্ত্রনায় থাকতে হয়। যদি অফিসে যেতে পাঁচ মিনিট দেরি হয় তাহলে পাঁচ ইউরো কেটে নেন কর্তারা। কিংবা সেদিন তাদের দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় দেয়া হয় না। তখন আমি ভেবেছি, আমি কীভাবে সামলাবো?
টিউলিপ জানান, আমার সহকর্মীদের ৯০ শতাংশই খুব সহায়ক, কিন্তু ১০ শতাংশ আছেন যারা অনেক সময় বলে থাকেন ‘‘কেনই তাকে আবার সন্তান নিতে হবে?’’ এরকম একজন নারী আমাকে বলেছিলেন, ‘‘তুমি একই সঙ্গে মা এবং এমপি হতে পারবে না”।
এই ব্রিটিশ এমপি বলেন, আমি অনেক স্কুলে গিয়েছি এবং মেয়েরা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে, ‘‘তরুণ নারীদের ক্ষেত্রে রাজনীতি করা কি খুব কঠিন?’’
এ অবস্থায় আমি দ্বিধায় পড়ে যেতাম কী জবাব দিবো। এসব মেধাবিদের আমি অনুৎসাহিত করতে চাই না। আমি শুধু মানুষকে বোঝাতে চাই যে, ‘‘একজন এমপি হওয়া মানেই এই নয় যে তার কোন সন্তান থাকতে পারবে না”।
অনেক মেধাবি নারী এখন পার্লামেন্টে আসতে চান না, আমাদের তাদের প্রয়োজন, আমরা তাদের অভাববোধ করছি।
প্রক্সি ভোটের দাবিতে সোচ্চার থাকা টিউলিপের আন্দোলন অবশেষে আশার মুখ দেখে। হুইল চেয়ারে করে ভোট দেয়ার এক সপ্তাহ পরই সদ্য বাবা-মা হওয়া সংসদ সদস্যদের ক্ষেত্রে পরীক্ষামূলকভাবে এক বছরের জন্য প্রক্সি ভোটিং চালুর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে।
এই সিদ্ধান্তের ফলে এমন সংসদ সদস্যরা তাদের পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য অপর একজন সংসদ সদস্যকে মনোনীত করতে পারবেন।
নতুন বিধি অনুসারে, সন্তানসম্ভবা এমপিরা তাদের অনুপস্থিতির সময় নির্দিষ্ট করতে পারেন। মায়েদের ক্ষেত্রে এটা ছয় মাস এবং বাবাদের ক্ষেত্রে দুই মাস। এই অনুপস্থিতকালীন তাদের ভোট দেওয়ার জন্য অপর একজন এমপিকে দায়িত্ব দিতে পারেন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি টিউলিপ লেবার পার্টির এমপি ভিকি ফক্সক্রফটকে প্রক্সি ভোট দেওয়ার জন্য মনোনীত করেছেন। ব্রেক্সিট ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ সাতটি সংশোধনীতে টিউলিপের হয়ে ভোট দেন ভিকি।