পূর্ব-উপকূলের মেঘনা তীর ধরে হাঁটছিলাম। গ্রামের নাম জগবন্ধু। লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের একটি গ্রাম। ভর দুপুরে রাস্তাঘাট প্রায় জনশুন্য। মাঠের কাজ শেষে কিছু মানুষ বাড়ির পথে। গ্রামেরই একজন আমার সঙ্গী। হাঁটছি আর দেখছি বিপন্নতার চিত্র। হঠাৎ মেঘনার তীর ঘেঁষা এক বাড়ি থেকে ভেসে এলো কান্নার আহাজারি। মনে হলো, বাড়ির কেউ হয়তো মারা গেছেন! তাই এমন কান্না। এগিয়ে যাই বাড়ির দিকে। কথা বলি বাড়ির মানুষদের সঙ্গে। ধারণা ভুল। এ বাড়ির কেউ মারা যাননি। এ কান্না বাড়ি বদলের।
আলাপে জানতে পারি, সে এক হৃদয়বিদারক গল্প। বিচ্ছেদের কান্না। আর তার নেপথ্যে মেঘনা নদীর অব্যাহত ভাঙন। যে ঘরের নারী ও শিশুরা কাঁদছিলেন, সেই ঘরে বাবা-মাকে নিয়ে বসবাস করতো দুই ভাই। এক ভাইকে সেদিনই চলে যেতে হচ্ছিল পরিজনসহ। ভাঙন থেকে দূরে অন্য কোথাও একখণ্ড জমিতে ছোট্ট ঘর তুলেছেন। এই বিচ্ছেদের কান্নায় সেদিন দুপুরের আকাশ ভারি হয়েছিল। বাড়ির বয়সী ব্যক্তিরা জানালেন, এই বাড়িতে ৭ ভাই বসবাস করছিলেন বহু বছর। একে একে প্রায় সকলেই বিভিন্ন স্থানে চলে গেছেন। বর্ষা ঠিক পূর্ব মুহূর্তে নদীর তীর থেকে বাড়ি বদলায় বহু মানুষ।
এমন দৃশ্য শুধু কমলনগরের জগবন্ধু গ্রামে নয়; গোটা উপকূল জুড়েই এমন বহু গল্প আছে। মার্চ-এপ্রিলে দুর্যোগের মৌসুম এলে বাড়ি বদলের হিড়িক পড়ে যায় উপকূলে। এই সময়ে উপকূলের নদীতীর ধরে হাঁটলে চোখে পড়বে এমন অনেক দৃশ্য। ঘরের চালা-বেড়া নিয়ে মানুষজন ছুঁটেন এক স্থান থেকে আরেক স্থানে। যে বাড়ি সমৃদ্ধ হয়েছিল যুগে যুগে, সান বাঁধানো পুকুর ঘাট, ফলের বাগান, সুপারি বাগান, প্রিয় স্বজনদের কবরস্থান, সবকিছু ফেলে নতুন ঠিকানার সন্ধানে মানুষেরা। এক ধরণের নিরব আতংক। দুর্যোগ মৌসুম এলে উপকূলের মানুষেরা তাড়িত হয় বার বার। নিঃস্ব মানুষেরা আবার স্বপ্ন দেখে বাঁচার, ঘর বাঁধার।
ডেঞ্জার পিরিয়ডের এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা শুধু এই একটি বাড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। চোখে পড়ে বিভিন্ন স্থানের নানান দৃশ্য। কমলনগরের মেঘনাতীরের চর ফলকন, লুধুয়া বাজার, চরজগবন্ধু, কালকিনির মতিরহাটসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেল, সামনের বর্ষা আর ঝড়ের মৌসুম সামনে রেখে বহু মানুষ বাড়ি বদল করছেন। কেউ ঘরের চালা-বেড়া অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছেন। কেউবা পুরানো গাছপালা কেটে নিয়ে পানির দরে বিক্রি করে দিচ্ছেন। দীর্ঘ ছয় বছর ধরে কক্সবাজারের ক্ষয়ে যাওয়া দ্বীপ কুতুবদিয়ার ১৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ অরক্ষিত। এরফলে শত শত একর ফসল আর লবণ চাষের জমি অনাবাদি হয়ে পড়ে আছে। বেড়িবাঁধ না থাকায় জোয়ার-ভাটার কারণে কয়েকশ’ একর জমিতে লবণ উৎপাদন বন্ধ। ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার লোকজন উপার্জন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। বহু পরিবারের জীবিকার পথ বন্ধ। দ্বীপের মানুষের জীবন, সহায় সম্পত্তি রক্ষায় স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ খুবই জরুরি।
উপকূল অঞ্চলের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সম্পদ হারানো বহু মানুষের কান্না শুনেছি। কানে এসেছে অসহায় মানুষের আর্তনাদ। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাড়ি বদলের এই ঘটনা যে শুধু বিপুল পরিমাণ সম্পদহানি ঘটাচ্ছে তা নয়, এক একটি সম্পশালী পরিবারকে পথে বসিয়ে দিচ্ছে, পারিবারিক বন্ধন ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। কত কান্নার জল ভাঙন রোধ করতে পারবে, জানেন না ভাঙনতীরের মানুষেরা। দ্রুত সময়ের মধ্যে এলাকা বিলীন হওয়ার কথা ভাবতেও পারেন না বাসিন্দারা। জগবন্ধু গ্রামের লোকজন বলছিলেন, এক সময় এই বাড়ি থেকে মেঘনা নদীর দূরত্ব ছিল প্রায় দশ কিলোমিটার। নিজেদের জমিতে চাষাবাদ করেই জীবিকা নির্বাহ করেছেন তারা। এক বর্ষা আগেও ভাবেননি বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। কিন্তু নিয়তি বাড়ি বদলে বাধ্য করল।
প্রতিবছর বর্ষা ও ঝড়ের মৌসুম উপকূলের মানুষের কাছে চরম বিপর্যয় হয়ে আসে। এই মৌসুমকে ঘিরেই বেঁচে থাকার সব প্রস্তুতি চলে। বর্ষা এলেই এই অঞ্চলের মানুষের আতঙ্ক বাড়তে থাকে। যারা কোনভাবেই নিজের বাড়িটিতে থাকতে পারছেন না, তারা কেউ শহরে যায়, কেউবা অন্যের বাড়িতে ঠাঁই নেয়। খুব কম সংখ্যক ক্ষতিগ্রস্থ মানুষ ধারদেনা করে এক টুকরো জমি কিনে আবার ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে।
বিশ্বব্যাংকের ‘প্রিপেয়ারিং ফর ইন্টারনাল ক্লাইমেট মাইগ্রেশন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ১ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ জলবায়ু শরণার্থী হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। ২০৫০ সালের মধ্যে এ দেশের ১ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ স্থানীয়ভাবে জলবায়ু শরণার্থী হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপের সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা কয়েক ফুট বেড়ে গেলে প্রায় ২ কোটি মানুষ বাস্তুহারা হয়ে পড়বে। জলবায়ু শরণার্থী হিসেবে এ বাস্তুহারা মানুষগুলো মূলত ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনার মতো বড় শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড চাপ ফেলবে দেশের সরকার, এর বিভিন্ন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং সীমান্ত এলাকাগুলোতে। আমরা সকলে জানি, জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ, আর এই দেশের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে উপকূলীয় এলাকা।
১৫ মার্চ থেকে ১৫ অক্টোবর। উপকূলবাসীর জন্য সময়টা ‘ডেঞ্জার পিরিয়ড’। বহু মানুকে কাঁদিয়ে এ সময়টি বারবার আসে। এই সাত মাস বিভিন্ন ধরণের দুর্যোগের মুখোমুখি হয় উপকূলের মানুষ। খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, ঝুঁকির সময়ে আমরা কতটা প্রস্তত হতে পেরেছি? এই সময়ে বহু দ্বীপ-চর পানিতে ডুবে থাকে। জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নেয় বাড়িঘর। বহু মানুষ গৃহহারা হয়ে বাঁধের পাশে ঠাঁই নেই। ঘূর্ণিঝড়ের সিগন্যাল প্রচারে সরকার যেভাবে তৎপর, নদীভাঙন
ও জলোচ্ছ্বাসের ভয়াবহতা কমাতে সে ধরণের সরকারি উদ্যোগ চোখে পড়ে না। সংকটকাল আসার আগে আমরা আসলে সেভাবে প্রস্তুত হতে পারছি না; যেটা দুর্যোগের সিগন্যাল প্রচারের চেয়েও জরুরি। নদীভাঙনের নিরবে বহু মানুষ সর্বস্ব হারাচ্ছে। পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এই ভয়াবহতা আমরা সেভাবে চোখে দেখি না। বর্ষা মৌসুম সামনে রেখে সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। স্থানান্তরিত প্রতিটি মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
প্রতিটি মানুষের স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার সঙ্গে ঝুঁকি হ্রাসের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দুর্যোগে বারবার লণ্ডভণ্ড হলে স্বাভাবিকভাবে বাঁচার কোন সুযোগ থাকে না। তাছাড়া প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে দুর্যোগ ঝুঁকি কমিয়ে আনা জরুরি। দুর্যোগে যে শুধু ঘরবাড়ি কিংবা জমিজমা হারিয়ে যায় তা নয়, প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যপক ক্ষতি হয়। এই প্রাকৃতিক সম্পদও বহু মানুষের জীবিকার প্রধান মাধ্যম। উপকূলে এই ডেঞ্জার পিরিয়ডে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, জলাবদ্ধতা, ভাঙনসহ বিভিন্ন ধরণের দুর্যোগ আসে।
পরিসংখ্যান বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই দুর্যোগের মাত্রা আগের চেয়ে বেড়েছে। অন্যান্য মৌসুমে দুর্যোগের তেমন ভয় না থাকলেও ডেঞ্জার পিরিয়ডে উপকূলবাসীকে তাই আতঙ্কেই কাটাতে হয়। নানা ধরণের উদ্যোগ নিয়েও ক্ষতি কমিয়ে আনা কিংবা আতংক নিরসন করা সম্ভব হচ্ছে না। ঠিক দশ-কুড়ি বছর আগে উপকূলের মানুষ যেভাবে আতঙ্কগ্রস্থ ছিলেন এখনও সেভাবেই আছে। তাদের জীবন ততটা নিরাপদ হয়েছে বলে মনে হয় না।
দুর্যোগের ঝুঁকি কমানোর বিষয়ে উপকূল অঞ্চল নীতিমালার এই কয়েকটি বিষয়ের দিকে চোখ রাখলেই অনুধাবন করা যায়, কাগজে ঠিকঠাক মানুষের নিরাপদে বসবাসের কথা উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে রয়েছে এর সামান্যই। উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলোর মধ্যে অনেকগুলোই কার্যত নীতিতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে বাড়িঘর ভেসে যাওয়ার পর পূনরায় বাড়ি করতে সহায়তার খবর খুব কমই পাওয়া যায়। একইভাবে নদীভাঙনে বাড়িঘর হারানো মানুষের জন্য সহায়তার পরিমাণ সামান্যই। যে বেড়িবাঁধ উপকূলবাসীকে নিরাপত্তা দেয়, সে বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণে বরাদ্দ থাকে না। পক্ষান্তরে গ্রামের পর গ্রাম ভেঙে যাওয়ার পর আসে বরাদ্দ। আবার সে বরাদ্দের কাজ শুরু হতে হতে বিলীন হয় আরও কয়েকগ্রাম। এই হলো আমাদের উপকূলের দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস কার্যক্রমের চিত্র। সে ক্ষেত্রে প্রতিবছর দুর্যোগ মৌসুম উপকূলবাসীর জন্য আতঙ্ক নিয়ে আসবে, এটাই তো স্বাভাবিক।
প্রান্তিক মানুষের ঝুঁকি হ্রাসের বিষয়গুলো লিপিবদ্ধ আছে ২০০৫ সালে প্রণীত উপকূলীয় অঞ্চল নীতিমালায়। নীতির ৪.৩ ধারায় ঝুঁকি কমানোর বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এই ধারার কয়েকটি বিষয় এরকম- ক) দারিদ্র্য হ্রাসের জাতীয় কৌশলের অংশ হিসাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংক্রান্ত ঝুঁকি হ্রাসের ওপর গুরুত্ব দেয়া; খ) উপকূলীয় অঞ্চলকে বিবেচনায় এনে সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয় সাধন করা; গ) দুর্যোগকালে দরিদ্রদের দুর্যোগ মোকাবেলার ক্ষমতা বাড়ানোর কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা ও তাদের সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য বীমা পদ্ধতি চালু করা; ঘ) নদীভাঙন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং নদীভাঙা মানুষের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা; ঙ) দুর্যোগকালীন নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, বহুমূখী ব্যবহার উপযোগী বাঁধ, কিল্লা, রাস্তাঘাট ও দুর্যোগ সতর্কীকরণ ব্যবস্থার সমন্বয় করা; চ) জলোচ্ছ্বাস মোকাবেলায় প্রাথমিক কার্যক্রম হিসাবে বাঁধগুলোর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী বনায়ন করা ইত্যাদি।
আসুন, আমরা চোখ রাখি উপকূলে। নজর ফেরাই নীতিমালার দিকে। দুর্যোগ মৌসুম আসার আগেই উপকূলবাসীর নিরাপত্তায় গ্রহণ করি যথাযথ ব্যবস্থা। দুর্যোগকালে উপকূলের মানুষের কান্না আর শুনতে চাই না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)