চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

আদর্শবাদী স্বাপ্নিকের জীবনাবসানে স্বজন হারানোর সুর

‘প্রতিটি সমাজেই কিছু গূঢ় আদর্শিক, গণমুখী, মানবতাবাদী অথচ নিভৃতচারী মানুষ থাকেন। এই মানুষগুলো নশ্বর জীবনের বিলাসিতা, অহমিকা এবং চাওয়া-পাওয়ার উর্ধ্বে থেকে সমাজ পরিবর্তনে আজীবন ত্যাগ শিকার করে যান। এমনই একজন উদার মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব ছিলেন কমরেড জসিম উদ্দীন মণ্ডল। জীবনের শুরু থেকে নিজ আদর্শ থেকে কখনো বিচ্যুত হননি। যা ইতিহাসে বিরল। তাকে হারিয়ে আজ আমরা স্বজন হারানোর ব্যথা অনুভব করছি। প্রত্যাশা করি, তার আদর্শ অনুসরণ করে দেশের রাজনীতিতে মূল্যবোধের অবক্ষয়রোধ করতে পারবে তরুণ প্রজন্ম’।

মঙ্গলবার সকালে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে কমরেড জসিম উদ্দীন মণ্ডলকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসে এভাবেই মূল্যায়ন করলেন দেশের বিভিন্ন স্তরের রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দ ও বিশিষ্ট নাগরিকগন। রাজনীতির এই কিংবদন্তিকে শেষ বিদায় জানাতে সকাল ১১টা থেকে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে জড়ো হয় দেশের রাজনীতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব ও শিক্ষাবিদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। এসময় তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অনুভূতি ব্যক্ত করেন তারা।

শ্রমিক-কৃষক শ্রেণির অধিকার আদায়ের সংগ্রামী এই নেতাকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে গলা ধরে এলো অগ্নিকন্যা খ্যাত, বাংলাদেশ সরকারের কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর। বলছিলেন, “জসিম ভাইকে হারিয়ে ফেলাটা আমাদের জন্য অনেক বড় ক্ষতি।  সুনির্দিষ্ট আদর্শের জায়গায় তিনি কখনো আস্থাহীন হননি। আস্থার জায়গাটি তিনি সবসময় অক্ষত রেখেছিলে। তিনি একটা লক্ষ্য নিয়েই এগিয়ে গেছেন সারাজীবন, সেটি হলো-মানুষের মুক্তি। সেই লক্ষ্যটা, সেই আগুনটা তার বুকের ভেতরে ছিলো। সেই লক্ষ্য নিয়েই তিনি আজকে চিরবিদায় নিয়েছেন। জসিম ভাইয়ের আত্মা শান্তি লাভ করুক। শ্রমিজীবী মানুষ যেন একটা সুন্দর জীবন পায়, ন্যায্য পাওনা পায় এটাই আজকের দিনে কামনা’।

সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আরেকজন নেতা ও বর্তমানে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু জসিম উদ্দীন মণ্ডলকে শ্রদ্ধা জানাতে আসার যৌক্তিকতা তুলে ধরে বলেন, “জসিম উদ্দীন মণ্ডলকে এই জন্য আমি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা জানাচ্ছি কেননা, তিনি আজীবন কৃষক, শ্রমিক, গরীব এবং নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। স্বাধীনতা অর্জন হয়, গণতন্ত্র হয় কিন্তু শ্রমিক, গরীব, নারীদের মুক্তির বিষয়টি অবহেলিত থেকে যায়। স্বাধীনতা বা গণতন্ত্র তখনই অর্থবহ হয় যখন শ্রমিকের, নারীর ও গরীবের মুক্তি হয়। এদিক থেকে জসিম উদ্দীন মণ্ডলের অবদান তাৎপর্যপূর্ণ। আমি মনে করি আগামীর লড়াইটা হচ্ছে জঙ্গিবাদের পরাজয়ের পরে শ্রমিকের, কৃষকের ও নারীর মুক্তি। সেই বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হলে জসিম  উদ্দীন মণ্ডলের মতো নেতার অনেক বেশি প্রয়োজন আমাদের”।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এই নেতাকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল। ভিন্ন আদর্শের হওয়া সত্ত্বেও ফখরুলের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হলো বিশাল কিছু হারানোর সুর।

যেমনটা তিনি বলছিলেন, “এই উপমহাদেশে শোষিতের পক্ষে, শোষণের নির্যাতনের বিরুদ্ধে, বৈষম্যকে দূর করা ও সমাজকে পরিবর্তন করার জন্য একজন নিবেদিত প্রাণ মানুষ ছিলেন, কর্মী ছিলেন জসিম উদ্দীন মণ্ডল। সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে তিনি সমগ্র জীবন ব্যয় করেছেন। তিনি নিঃস্বার্থ ত্যাগী মানুষ। একদিকে শ্রমিক আন্দোলন, কমিউনিস্ট আন্দোলন, ভারত বর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তিনি সবসময় সক্রিয় ছিলেন। তিনি শ্রমিক আন্দোলনের জন্য অনবদ্য ভুমিকা পালন করেছিলেন। আমরা আজকে তাকে গভীরভাবে স্মরণ করছি। এই মৃত্যুর মধ্যদিয়ে আমরা মনে করি একজন কিংবদন্তি, একজন সত্যিকার অর্থে মানুষের জন্য সংগ্রাম করার নেতা চলে গেলেন আমাদের মাঝ থেকে। এই অভাব সহজে পূরণ হবার নয়।”

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানও একজন শ্রমিক নেতা। তিনিও জসিম উদ্দীন মণ্ডলের সঙ্গে একসময় অনেক শ্রমিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। সেই স্মৃতি স্মরণ করে তিনি বলছিলেন, “জসিম উদ্দীন মণ্ডল শুধু একজন শ্রমিক নেতা বা রাজনীতিবিদ ছিলেন না। তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের একজন অসাধারণ নেতা। তার মৃত্যুতে একটা যুগের অবসান ঘটলো। একজন নিপীড়িত মানুষের নেতা, শ্রমিক নেতা যার সঙ্গে শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের আন্দোলনে আমরা একসাথে অনেক সভা করেছি। উত্তরাঞ্চলে শ্রমিকদের সংগঠিত করার জন্য আমরা কাজ করেছি। তার এই মৃত্যু শুধু তার দলের জন্য ক্ষতির নয়, আমি মনে করি সারা দেশের নিপীড়িত মানুষের জন্য ক্ষতির কারণ। আমি দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে বেহশত নসিব করেন।”

বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম একসময় অনেক জনসভায় জসিম উদ্দীন মণ্ডলের সঙ্গে বক্তব্য রেখেছেন। সেই কথা স্মরণ করে তিনিও বিমর্ষ হয়ে পড়েন যেন! হাসান ইমাম অভিব্যক্তি প্রকাশে বলেন, “জাহানারা আপার পরে জসিম ভাইয়ের সঙ্গে বেশ কিছু জনসভায় বক্তব্য রেখেছিলাম আমি। তখন দেখেছি তার কথায় মানুষ কিভাবে প্রভাবিত হতো। শ্রমিক শ্রেণির এই নেতার দ্বিতীয় উদাহরণ আর বাংলাদেশে নেই। তিনি সত্যি অনুপ্রেরণার মানুষ।রাজনীতিকে তিনি কখনো পেশা হিসেবে নেননি, সেবা হিসেবে নিয়েছিলেন। আমাদের রাজনীতিতে বেশিরভাগই পেশাজীবী রাজনীতিবিদ এসে গেছেন। সেখানে তিনি একেবারেই সাধারণ মানুষ ছিলেন এবং অসাধারণ বক্তা ছিলেন। তিনি সাধারণ মানুষের ভাষায় কথা বলতেন, সেই জন্য সাধারণ মানুষ তার কথা শুনতেন। সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত ও সমাজতন্ত্র কায়েমে তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। তাকে হারানোয় একটি স্বজন হারানোর ব্যথা অনুভব করছি”

আরেকজন বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশিদ বলছিলেন জসিম উদ্দীন মণ্ডলের আদর্শিক দৃঢ়তার কথা। “তিনি তার দীর্ঘ জীবনটাকে ব্যয় করেছেন শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণির জন্য। তিনি শ্রমিক, কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। মার্কসবাদ, লেনিন বাদে ছিলেন অকুতোভয়। কোন বিচ্যুতি ছিলো না তার মধ্যে। তিনি যে পথে শুরু করেছিলেন সেই পথেই আজীবন থেকেছেন। একেবারে নিরলসভাবে জীবনের শেষ পর্যন্ত একটি আদর্শকে আকড়ে ধরে থাকা এটি একেবারেই বিরল ঘটনা। বাঙালির মধ্যে সুদীর্ঘকাল ধরে তিনি লড়াই করে গেছেন। তিনি আমাদের জন্য একজন বড় অনুপ্রেরণা”-বলছিলেন এই নাট্য ব্যক্তিত্ব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো: আখতারুজ্জামান  জসিম উদ্দীন মণ্ডলকে শ্রদ্ধা জানাতে এসে বলেন, “আমরা গভীরভাবে স্মরণ করছি তার অসাধারণ ত্যাগের জন্য। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য পথিকৃৎ তিনি। মাটি এবং মানুষের নেতা ছিলেন। সবসময় পেছনে থেকেছেন। নিজেকে কখনো জাহির করেননি। সমাজে এমন মানুষের বড় অভাব। জসিম উদ্দীন মণ্ডলের মতো মানুষেরই রাজনীতিবিদ হওয়া খুবই আবশ্যক। সমাজের প্রতি আজকে আমাদের সেই  আহ্বান থাকবে। নতুন প্রজন্মের জন্য নিঃসন্দেহে জসিম উদ্দীন মণ্ডল একজন আদর্শ ও অনুপ্রেরণার উৎসব। কেননা, তিনি ছিলেন সবসময় গণমুখী মানুষ। সবসময় সমাজ পরিবর্তনের জন্য ভেবেছেন। কিভাবে মানুষের কল্যাণ করা যায় সেই ভাবনায় মগ্ন ছিলেন। একজন সত্যিকার মানবতাবাদী মানুষ ছিলেন তিনি। সব যুগের জন্যই তার আদর্শ অনুপ্রেরণার”।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক জসিম উদ্দীন মণ্ডলকে একজন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির ও ভিন্ন চিন্তার মানুষ মনে করেন। তার তাঁর মতে, “জসিম উদ্দীন মণ্ডলের মতো নিভৃতচারী মানুষ বিরল। আজীবন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণ করতে চেয়েছেন তিনি। তাত্ত্বিকভাবে চিন্তা করলে তিনি সত্যিকার অর্থে একজন উদার মানুষ। শ্রমজীবী হিসেবে যেভাবে পৃথিবী বদলে দেয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন, চিন্তা করেছিলেন, কাজ করে গেছেন, আজীবন স্বপ্ন দেখে তিনি যেভাবে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। আমাদের দায়িত্ব হলো তার এই অবদান স্মরণ করা এবং তার চিন্তা-চেতনা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করা।”

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান মনে করেন, বাংলাদেশে যে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের রাজনীতি চলমান, জসিম উদ্দীন মণ্ডলের অনুসৃত পথ ধরে একদিন তার পরিসমাপ্তি ঘটবে। কমরেড জসিম উদ্দীন মণ্ডল ছিলেন একজন বিপ্লবী নেতা। জীবন ত্যাগ করেছেন একটি বিপ্লবী আদর্শের সমাজ গঠনের জন্য। তিন যে জীবনের রেল গাড়িতে চড়েছিলেন, সেই জীবন এখন স্তুব্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু তার আদর্শ স্তব্ধ হয়নি। তার এই আদর্শে যারা আলোকিত তারা আগামীদিনে বাংলাদেশে একটি সুখী-সমৃদ্ধ স্বাধীন সমাজ গঠন করতে ভূমিকা রাখবে সেই প্রত্যাশা করি।”

ঢাকসুর সাবেক ভিপি ও খেলাঘরের চেয়ারপার্সন অধ্যাপক মাহফুজা খানম জসিম উদ্দীন মণ্ডল সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্মৃতির পাতায় বিচরণ করলেন।

বলেন, “জসিম ভাইয়ের বাবার কর্মস্থল  রেলের সঙ্গে যুক্ত ছিলো। তিনিও পরে আসেন এই পেশায়। কিন্তু তিনি শুধু পেশা হিসেবে গ্রহণ করেননি। সেটাকে জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তখন থেকে তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনে যুক্ত হন। তারই ধারাবাহিকতায় তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, পরে পাকিস্তান আন্দোলন এবং বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ সবকিছুর সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন। আজকে অবশ্য আমি বলবো বামপন্থীদের সেরকম অবস্থা নেই। কিন্তু ষাট দশকে যে দর্শনটি আমরা তার কাছ থেকে পেয়েছিলাম, আজকে দিনের তরুণ প্রজন্মকে বলবো, নতুন করে ভাববার জন্য। মানবমুক্তির জন্য তার যে সংগ্রাম ছিলো সেটি যেন তরুণরা লালন করে। মহান মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে যে বাংলাদেশ আমরা পাইনি জসিম ভাইয়ের পথ ধরে যেন আমরা সেই বাংলাদেশ অর্জন করতে পারি তার তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে।”

প্রসঙ্গত, জসিম উদ্দীন মণ্ডল ছিলেন বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের পুরোধা। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির উপেদেষ্টা মণ্ডলীর অন্যতম সদস্য। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, পরে পাকিস্তান আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে গরীব-মেহনতি কৃষক-শ্রমিক সহ সর্বস্তরের নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন তিনি।

সোমবার সকাল ৬টায় রাজধানীর হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে বার্ধক্যজনিত রোগে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মঙ্গলবার সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সর্বস্তরের মানুষ। এরপর বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে তার নামাজে জানাজা সম্পন্ন হয়।

বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মজাহিদুল ইসলাম সেলিম জানান, বুধবার তার মরদেহ গ্রামের বাড়ি ঈশ্বরদিতে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে সকাল ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।