চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

সুবিচার পায় না নির্যাতিত নারী বরং শোনে ‘মন্দ মেয়ে’ শব্দটি

পরিবার সমাজ সবার সম্মান রক্ষার সব দায় যেন  নারীর। কারণ তার সম্ভ্রমই একটি পরিবার ও সমাজের সম্মানের প্রতীক বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু নারী  ঘরে বাইরে কোথাও নিরাপত্তা পায় না কোনদিন। প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতায় খুললেই দেখা যায় নারীর ধর্ষণ, নির্যাতন, হত্যা খবর। পারিবারিক সংঘাত কিংবা পুরুষের লালসার শিকার হয়ে নারীর জীবনে কিছু না কিছু ঘটেই যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আইন বা বিচারের কোনো তোয়াক্কা করে না বলে কোন না কোন মেয়ে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে নানাভাবে। নির্মম হলেও এটাই সত্য যে প্রতিনিয়ত আমাদের সমাজে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা আমরা জানতে পারি না।

কোন নারী নির্যাতনের ঘটনা আলোচিত হলে তা নিয়ে সমাজের নানা শ্রেণির মানুষরা প্রতিবাদ, মানববন্ধন করে বিচারের জন্য। তবে এসব  নির্যাতন, হত্যার অন্তরালে কোন সত্য লুকিয়ে আছে তা জানা হয়ে যায় সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। কারণ  আইনের বিধি বিধান আর পুলিশের তদন্ত  প্রতিবেদনের ধীর গতির  কারণে মানুষ ভুলে যায় আলোচিত ঘটনা। তাই প্রতিবাদ, সভা কিংবা সমাবেশে নারী নির্যাতনের সমাধান যদি হত তাহলে হয়ত নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত হবার প্রশ্ন আসত না এ সমাজে।

রূপা, তনু, সূর্বনাসহ সাম্প্রতিক সময়ের আরো অনেক নাম ভুলে গেছে এ সমাজের মানুষ। কিন্তু ভুলে নাই তাদের স্বজনরা। কারণ বিচারের আশায় তাদের রয়েছে প্রতীক্ষা। আবার আশে পাশের মানুষ তাদের কোন না কোনভাবে মনে করিয়ে দেয় তাদের মেয়ের নির্যাতিত জীবনের কথা। আর সে কথা ধরনের থাকে, ‘মেয়েই ভালো ছিল না।’

সমতল পাহাড় সবখানেই ধর্ষণ  ও নারী নির্যাতন নিত্যদিনের ঘটনা। সমতলে যদিও সাময়িক প্রতিবাদের ঝড়ে উঠে নারীটির জন্য। কিন্তু পাহাড়ের কন্যাদের পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়াবার তেমন কেউ থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে সেখানে রক্ষক ভক্ষকের ভূমিকা পালন করে।

খুব বেশী দিন আগের কথা নয় কুমিল্লার তনু হত্যাকান্ড নিয়ে তোলপাড় হয়েছে সারা দেশ। কিন্তু বিচার হয়নি আজও। টাংগাইলের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী সূর্বনার গণধর্ষনের কথা কারো মনে নেই। সোনাগাজীর নুসরাত বিচার পেয়েও আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। বলা হচ্ছে, তদন্ত প্রতিবেদন সঠিক হয়নি। আইনের নানা জটিলতার কারণে ও দেশে ধর্ষণের  মত বর্বর আচরণ করতে এতটুকু ভয় পায় না পুরুষ নামের নরপশুরা।

এ দেশে কথায় কথায় নারীদের অধিকার দাবি বিচারের জন্য প্রতিবাদ মুখর হয়ে যারা, সে তথাকথিত সুশীলরা বলতে পারেন না রেপ বা হত্যার কেসগুলো থানা আদালতে যাবার পরে কী অবস্থায় হয়। বিচারিক কাজের ঢিমেতালে কত অপরাধী বের হয়ে যায় আইনের মারপ্যাচে। আর না হয় কালক্ষেপন করে মামলার গতি নষ্ট করে দেয় অপরাধীরা প্রভাব খাটিয়ে। তৎক্ষণিক বিচার বা সাজা হয়েছে ধর্ষকের এমন উদাহরণ নেই বলে নারী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে প্রতিনিয়ত এখনও। যার ফলে একজন নারী যখন সম্ভ্রম হারায় কিংবা পুরুষের লালসার শিকার হয়ে জীবন দেয়- সে হয়ে যায় পরিবারের কাছে কলংকিত। পরিচয় হয় ‘ধর্ষিতা’ হিসাবে।

এখানেই ক্ষ্যান্ত হয় না সমাজ। শুধু মেয়েটিকে নয় তার গোটা পরিবারকে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে বলে ‘এ ঘরের মেয়েকে মানুষ নষ্ট  করছে।’ এ পরিস্থিতিতে সে পরিবার তখন প্রতিবাদের বদলে লজ্জাবনত হয়ে পথ চলে। অন্যায়ের বিচার পাওয়ার লড়াইয়ের সাহস রাখতে পারে না। নারীর ধর্ষণ, নির্যাতন  হত্যা পত্রিকার খবর হয়,ফেইসবুকে  তুলে পোষ্টের ঝড়। তবে কেউ বলতে পারে না কতটা হেয় হয় ধর্ষিতা, নির্যাতিত বা অকালে প্রান দেয়া সে নারী আর তার পরিবার। তাদের জীবনটা হয় বেঁচে থেকে ও মৃত্যুসম।

প্রকাশিত ধর্ষণ বা নির্যাতনের ঘটনা যে  নারীর জীবনকে বিষময় করে শেষ হয় তা কিন্তু নয়। সংসার নামের ঘরের অনেক নারীর রয়েছে অলিখিত আরেক নির্যাতন।সহবাসের নামে একজন স্ত্রীর উপর স্বামী যে  শারীরিক মানসিক অত্যাচার করে তার প্রতিকার নেই। আছে শুধু চোখের জল। প্রতিকার চাইতে হলে লোকলজ্জার ভয়ে বলতে পারে না স্বামী- স্ত্রীর একান্ত বিষয়টি। বাঙালী সমাজে সহবাসের বিষয়ে নারী কথা বলার  এখনো সে পরিবেশ গড়ে উঠেনি। আর এক কারণে যদি প্রতিবাদ হয় তখন মেয়েদের শুনতে হয়,‘বাপের বাড়ি নয় স্বামীর বাড়িই সব’—এমন যুক্তিহীন প্রলাপ। মেয়ে যতই কর্মক্ষম হোক স্বামীর ঘর ছাড়া যাবে না। কারণ মেয়ের দায় পরিবারের সম্মান রক্ষা করা। সে সংসার না করলে পরিবারের সম্মান থাকবে না।’ যেন পরিবারের আত্মসম্মানের দায় কেবল নারীর।

নারীর নিরাপত্তাহীনতা রয়েছে তার কর্মক্ষেত্রে। যা অনেকভাবে অপ্রকাশিত। যদিও অবস্থার পরির্বতন হচ্ছে ক্রমশ। তথাপি জীবনের প্রয়োজনে কত নারীর জীবনের না বলা কথা চোখের জলে ভাসে তার খবর কেউ রাখে না। কিছু সময় আগে ভারতের রাম রহিমের ঘটনা দেখে এ দেশে অনেক নারী এক সময় শিকল ভাঙতে চেয়েছ। কিন্তু সমাজ আর লোক নিন্দা ভয়ে আজও পারেনি ভালো মানুষের ছদ্মবেশী বেশী পুরুষদের  মুখোশ খুলে দিতে।

একজন মানুষ কাজের প্রয়োজনে সময়ের হিসাব করে জীবনের পথে চলতে পারে না। জীবনের তাগিদে পুরুষের মত নারীকে বের হত হয় ঘর থেকে। কিন্তু পুরুষটি তার সম্ভ্রম নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে না। তাই পথ চলতে গিয়ে যে নারী  সম্ভ্রম হারিয়েছে তাকে প্রমাণ করতে হচ্ছে সে মানুষরূপী হায়েনাকে দিয়ে সম্ভ্রম হারিয়েছে। তবুও তথাকথিত মানুষের কাছে পুরুষের লালসার শিকার ধর্ষিত নারীটি সম্ভ্রমহীন হিসাবে হয় পরিচিত। তার অপরাধ মানুষ নয় নারী হিসাবে সে পুরুষের মত জীবনের পথে চলতে পারে না। কিন্তু প্রতিনিয়ত ঘটে যাও এসব ঘটনা থেকে আর এক নারী নিজে যে এমন অবস্থা শিকার হবে না তার নিশ্চয়তা দিতে পারে না রাষ্ট্র। কারণ দেশের আইনী প্রক্রিয়ায় এ বিষয়ে  রয়েছে যথেষ্ট দূর্বলতা। আবার নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলতে গেলে তকমা হিসাবে সীল দেয় ‘নারীবাদী।’ আসলে আধুনিক এ বিশ্বে নারী মেধা মননে এগিয়ে গেলে ও তার ছুটে চলা জীবনের পথেই বারবার মনে করিয়ে দেয়, ‘এ সমাজে নারী হিসাবে জন্ম নেবার সকল দায় কেবল  নারীর। তার নিজের জীবনের আগে ভাবতে হবে পরিবার ও সমাজের কথা। কারণ পাশবিকতার কাছে নিজের সম্ভ্রম হারিয়ে গেলেও তার ঘাড়েই দোষ চাপে। নিন্দাসূচক বিশেষণ ব্যবহার  হয় একটাই শব্দ ‘মন্দ মেয়ে।’

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)