চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Nagod

টুঙ্গিপাড়ার খোকা থেকে শেখ মুজিব, বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা

শেষ পর্ব

KSRM

পূর্ব প্রকাশের পর

১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর বঙ্গবন্ধু ৬ দফার পক্ষে দেশব্যাপী ব্যাপক প্রচারণা শুরু করেন। নির্বাচনকে সামনে রেখে ঢাকার ইডেন হোটেল প্রাঙ্গণে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকা। 

Bkash July

বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী ভাষণে বলেন, “প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে দিয়েই আওয়ামী লীগের জন্ম। আর সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েই আওয়ামী লীগের বিকাশ।” ১৯৬৬ সালে তিনি দেশবাসীর কাছে ছয় দফা পেশ করেন। বাংলার মানুষের মুক্তির সনদ বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা পাঠকদের স্মৃতিচারণের জন্য উল্লেখ করা হলো-

১। শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি:

Reneta June

লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেল রাষ্ট্রে পরিণত করা, যেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত আইন পরিষদ হবে সার্বভৌম।

২। কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা:

কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা কেবল মাত্র দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। অন্যান্য সকল ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের হাতে ন্যাস্ত থাকবে।

৩। মুদ্রা ও অর্থ:

মুদ্রার বিষয়ে দু’টি প্রস্তাবের ১টি গ্রহণ করা যাবে।

(ক) সমগ্র দেশের জন্য দু’টি পৃথক, অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে। অথবা;

(খ) সমগ্র দেশের জন্য কেবল মাত্র একটি মুদ্রাই চালু থাকতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে শাসনতন্ত্রে উপযুক্ত ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচারের পথ বন্ধ হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভ এবং পৃথক রাজস্ব ও মুদ্রানীতি গ্রহণ করা।

৪। রাজস্ব, কর বা শুল্ক:

ফেডারেশনের অঙ্গরাজ্যগুলোর কর বা শুল্ক ধার্যের ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। প্রাদেশিক সরকারের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের কোনরূপ কর ধার্যের ক্ষমতা থাকবে না। প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রাদেশিক সরকারের রাজস্বের একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকার প্রাপ্ত হবে। প্রাদেশিক সরকারের কর থেকে একই হারে আদায়কৃত অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল গঠন হবে।

৫। বৈদেশিক বাণিজ্য:

(ক) ফেডারেশনভুক্ত প্রতিটি রাজ্যের বহির্বাণিজ্যের পৃথক হিসাব রক্ষা করতে হবে।

(খ) বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা প্রাদেশিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

(গ) কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে অথবা সর্বসম্মত হারে প্রাদেশিক সরকার বহন করবে।

(ঘ) প্রদেশের মধ্যে দেশজ দ্রব্য চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা কর জাতীয় কোন রকম বাধানিষেধ থাকবে না।

(ঙ) শাসনতন্ত্রে প্রদেশ বা অঙ্গরাষ্ট্রগুলিকে বিদেশে নিজ নিজ বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণ এবং নিজ স্বার্থে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা থাকবে।

৬। আঞ্চলিক বাহিনী গঠন:

আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্রে প্রদেশগুলোকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীন আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও পরিচালনার ক্ষমতা থাকবে।

উল্লেখিত ৬ দফা এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের যৌক্তিক দাবীতে এদেশের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ সমর্থন দেয়ায় আওয়ামী লীগ জাতীয় নির্বাচনে যাওয়ার সম্মতি গ্রহণ করে।

১২ নভেম্বর ১৯৭০ সালে পূর্ব বাংলায় ভয়াবহ টর্নেডো এবং জলোচ্ছাসে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় ৫ (পাঁচ) লাখ মানুষ মারা যায়। বঙ্গবন্ধু তার নির্বাচনী প্রচারণা স্থগিত করে ত্রাণ নিয়ে দুর্গতদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। তিনি পূর্ববাংলার জনগণের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য ও চরম উদাসীনতা গণমানুষের সামনে তুলে ধরেন।

৭ ডিসেম্বর ১৯৭০ সালে জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে বিজয়ী হয় এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্বপাকিস্তানে ২৯৮টি আসন লাভ করে। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিতে এ দেশের কৃষক-শ্রমিক, কুলি-মজুর, ছাত্র-জনতা এক নবজাগরনে উজ্জীবিত হয়েছিল।

তীব্র গনআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতনের পর ছাত্র-জনতার উত্তাল সংগ্রাম ও গণদাবির মধ্য দিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়ার অধীনে ৬ দফার ভিত্তিতে ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুষ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে।

পাকিস্তানী স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া/ভুট্টোর ষড়যন্ত্রে নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে শান্তিপূর্নভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর না করলে তারা সমগ্র বাঙালি জাতির ওপর নির্যাতন করার পথ বেছে নেয়। উল্লেখ করা যায় যে, ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি অনন্য ঘটনা হিসাবে বিবেচিত হয়। নির্বাচনটি ছিল বাঙালি জাতির সুদীর্ঘ আন্দোলনের ফসল।বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ক্ষেত্রে এই নির্বাচনের প্রভাব অসামান্য।

এই নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বাঙালি জাতি প্রথমবারের মতো নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের ক্ষমতা অর্জন করতে সামর্থ্য হয়। তবে হঠাৎ করে ১৯৭০ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে, দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল হিসেবে ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া খানের শাসনামলে অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন। যার পিছনে মূখ্য ভূমিকা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে বাঙালির জাতীয়তাবাদী, রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের ফলে বাঙালিদের মধ্যে রাজনৈতিক সংহতি ও আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির পথ দেখায়।

১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যগণ ৬ দফার ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের শপথ গ্রহণ করেন। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ রবীন্দ্রনাথের লেখা সংগীতের মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করা হয়। পরবর্তীতে এটা আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। বঙ্গবন্ধু ওই অনুষ্ঠানে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে বাঙালি জাতির মুক্তির সংকল্প ব্যক্ত করেন। শপথ অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী সংগীতের পর ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গান পরিবেশিত হয়।

এর কয়েক দিন পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ৩ দফা বৈঠক করে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যান। বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন বিষয়টি পশ্চিম পাকিস্তানের স্বৈরশাসক গোষ্ঠি সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। শুরু হয় নতুন ষড়যন্ত্র, জুলফিকার আলী ভূট্টো ঢাকা আসেন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে কয়েক দফা বৈঠকে ভূট্টোর সঙ্গে আলোচনা ব্যর্থ হয়। জাতীয় পরিষদের অধিবেশনকে সামনে রেখে ঢাকার হোটেল পূর্বানীতে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক শুরু হয়। ইয়াহিয়া খান আকস্মিকভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন।

সারা বাংলার মানুষ ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং রাজপথ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। বঙ্গবন্ধু বলেন, এটা পশ্চিমা শাষক গোষ্ঠির চক্রান্ত। তিনি ২ মার্চ ঢাকায় ও ৩ মার্চ সারা পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল আহবান করেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে ঢাকাসহ সমগ্র বাংলায় স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে হরতাল পালিত হয়। উত্তাল জনস্রোতে ঢাকা পরিণত হয় এক বিক্ষোভের নগরীতে। পাকিস্তানের সামরিক সরকার ঢাকা শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করেন। বিক্ষুব্ধ জনতা কারফিউ উপেক্ষা করে রাজপথে নেমে আসে। বিক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষের ওপর সামরিক বাহিনী গুলি চালিয়ে ৩ জনকে হত্যা করে এবং কমপক্ষে ৬০ জন মানুষ আহত হয়। এ সময় পুরো দেশ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পরিচালিত হতে থাকে।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারা বাংলায় শুরু হয় এক অভূতপূর্ব অসহযোগ আন্দোলন। ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ হেয়ার রোডে প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, “বাংলার জনগণকে আমি ভালোবাসি, জনগণই আমার জীবন।” ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি ভবনে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নেন এবং সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন। ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগের পর রাত সাড়ে ১১টায় শুরু হয় ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা যা অপারেশন সার্চ লাইট নামে পরিচিত।

২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে ধানমন্ডির ৩২নং রোডের বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ইপিআরের জোয়ানরা সঙ্গে সঙ্গে ওয়ারলেসযোগে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার বার্তা দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দেয়। ওই রাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচীতে নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ এবং ২৬ মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণার পর বীর বাঙালি যার যা আছে তাই নিয়ে পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের এক গৌরবজ্জল অধ্যায়।

আইনানুগভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য নির্বাচিত জাতীয় সংসদ ও প্রাদেশিক সদস্যদের ম্যান্ডেটে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদনাথ তলার (মুজিবনগর) আম্রকাননে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ ও অনুমোদনের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করেন এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আইনানুগ রূপ লাভের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিমনণ্ডলে বৈধতা পায়।

পাকিস্তানের কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধুর বিচার সামরিক আদালতে শুরু হবে জানার পর মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী জনমত গঠনের মাধ্যমে প্রতিবাদ এবং উদ্বেগের ঝড় উঠে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের পক্ষে ব্যাপক জনমত তৈরী হয় এবং ক্রমান্বয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবে স্পর্শ করতে থাকে। বিশ্বব্যাপী উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধুকে ইয়াহিয়া খানের সামনে হাজির করা হয় এবং ইয়াহিয়া খান করমর্দনের জন্য হাত বাড়ালে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘দুঃখিত, ওই হাতে বাঙালির রক্ত লেগে আছে, ওই হাত আমি স্পর্শ করবো না।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের মুক্তির সংগ্রাম যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে তখন ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সমঝোতার প্রস্তাব দিলে বঙ্গবন্ধু ঘৃনাভরে ইয়াহিয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন।

দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ ও ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নেয়ার মাধ্যমে পরাধীনতার শৃংখল থেকে বাঙালি জাতি মুক্তি পায়।

মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়টি মাস বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের স্বৈরশাসকরা পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আটকে রেখেছিল। বঙ্গবন্ধু তার সমগ্র রাজনৈতিক জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কারাগারে কাটিয়েছেন। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানে আটক থাকার পর পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে মুক্তি পেয়ে ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলার মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন।

এর আগে ৩ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচার হলো বিশ্বনেতাদের অব্যাহত চাপে এবং মিত্র বাহিনীর কাছে পাক-হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের কারণে পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয়ে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে কারাপ্রকোষ্ঠ থেকে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সদ্য প্রসূত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের আবাল বৃদ্ধ-বনিতাসহ এদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের দীর্ঘ প্রতিক্ষার পরিসমাপ্তি হয়েও যেন শেষ হয়না।

৭ জানুয়ারি ভোর রাতে অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি আমরা জানতে পারলাম জাতির পিতা মুক্তি পেয়ে পাকিস্তান থেকে উড়োজাহাজে করে সকাল সাড়ে ৬টায় ইংল্যান্ডের রাজধানী শহর লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছান। একইদিন রয়টার্স শিরোনাম করেছিল ‘লন্ডনে শেখ মুজিব। ৮ তারিখ বিকেল ৫টায় ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী স্যার এডওয়ার্ড হিথ এর আমন্ত্রণে এক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। লন্ডনে পৌঁছার পর বঙ্গবন্ধু সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেন, ‘আমি আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই।

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে তৎকালীন ব্রিটেনের রাজকীয় বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে বঙ্গবন্ধু নয়া দিল্লী পৌঁছালে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি এবং প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরাগান্ধী, মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ, তিন বাহিনীর প্রধান এবং অন্যান্য অতিথিবৃন্দ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে স্বাগত জানান। ভারতের জনগণ উষ্ণ সংবর্ধনা দেন স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বঙ্গবন্ধু ভারতের নেতৃবৃন্দ এবং ভারতের জনগণের প্রতি তাদের অকৃপন সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাতে ভোলেননি। একই সাথে তিনি টুঙ্গিপাড়ার খোকা বাঙালি জাতির পিতা হিসাবে স্বীকৃতি পেল সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের কাছে।

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বেলা ১ টা ৪১ মিনিটে ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের লালিত স্বপ্নের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। লাখো মানুষের জনস্রোত, বাঁধভাঙ্গা আবেগে অশ্রুসিক্ত নয়নে বঙ্গবন্ধুকে বরণ করে নেন এবং জাতির পিতা আবেগ তাড়িত কণ্ঠে বলেন, “যে মাটিকে আমি এত ভালোবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালোবাসি, যে জাতিকে আমি এত ভালোবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি ফিরে যেতে পারবো কিনা, আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি। বাংলার ভাইদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।” সবাইকে দেশ গড়ার কাজে আহব্বান করে তিনি বলেন, “আজ থেকে আমার অনুরোধ, আমার আদেশ, আমার হুকুম ভাই হিসেবে, নেতা বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়, যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়, এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এ দেশের যুবকরা চাকরি না পায়, মুক্তি বাহিনী, ছাত্রসমাজ তোমাদের মোবারকবাদ জানাই তোমরা গেরিলা হয়েছো, তোমরা রক্ত দিয়েছো, রক্ত বৃথা যাবে না, রক্ত বৃথা যায় না।

বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমাকে আপনারা পেয়েছেন, আমি এসেছি। জানতাম না আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছে, আমার সেলের পাশে আমার কবর খোড়া হয়েছিল। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম, বলেছিলাম আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, মুসলমান একবার মরে দুইবার মরে না। আমি বলেছিলাম আমার মৃত্যু আসে যদি আমি হাসতে হাসতে যাবো। আমার বাঙালী জাতিকে অপমান করে যাব না। তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইবো না। যাবার সময় বলে যাবো জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাঙালি আমার জাতি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান।” ১০ জানুয়ারি জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস সমগ্র জাতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

I Screen Ami k Tumi
Labaid
Bellow Post-Green View