যে কোন যুদ্ধ এবং দাঙ্গায়, হোক সে ধর্মবিস্তারের জন্য কিংবা পররাজ্যগ্রাসের লিপ্সায়, যৌনসন্ত্রাস বা ধর্ষণ একটি অঙ্গীভূত বিষয়। যুদ্ধে নারীকে ভোগ করা হয়, যুদ্ধের পরেও বিজিত দেশের নারী ‘গনিমতের মাল’। দেহের ক্ষত একদিন হয়তো সেরে যায়, কিন্তু বিক্ষত মন মৃত্যু অবধি ব্যারাম নিয়ে থাকে—আতঙ্ক, ট্রমা এবং সর্বোপরি ঘৃণা দগদগ করে, স্বঅস্তিত্ব নিজের কাছেই হয় অর্থহীন। ধর্ষণে নারী মা হলে, সমাজ মা ও সন্তানকে শত্রুপক্ষের ছায়া হিসেবে দেখে, অহোরাত্রি তারা হয় নির্মম বঞ্চনার শিকার। সন্তানটি অনাকাঙ্ক্ষিতই শুধু নয়, নির্মমভাবে পরিত্যাজ্য। পরিত্যাজ্য শিশুটি অবহেলায় বড় হয়—অদেখা পিতা তার কাছে শত্রু, এবং সমাজ তার ভেতর দেখে দেশের শত্রুর প্রতিবিম্ব। যুদ্ধশিশু আসলে জন্ম থেকেই ক্রুশবিদ্ধ, অন্য কারও পাপের শাস্তি তার স্কন্ধে। তার কোন দেশ থাকে না—সে চাইলেও সমাজ তাকে গ্রহন করে না; তার চোখে নিরন্তর শূন্যতা এবং শূন্যতার গহীন ভেতরে একাকীত্বের ক্লান্তি।
মিডশটে দেশের পতাকা, বাংলাদেশের; উড়ছে হাওয়ায় পতপত করে, লংশটে সংসদ ভবন—স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক; তৃতীয় শটে ক্লোজ আপে লো-এঙ্গেলে সংসদ ভবন যেন আমাদের প্রাণের উপর দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে ক্লোজআপে বাংলাদেশের পতাকা। হাওয়া এসে লাগে আমাদের চোখেমুখে, হৃদয় ফুঁড়ে বের হয় সুখের ফল্গুধারা। এভাবেই শুরু শবনম ফেরদৌসী’র ডকুমেন্টারি সিনেমা ‘জন্মসাথী’। কিন্তু সিনেমাটি শেষ হয় গোধূলিতে, মিডশটে সুধীর। সন্ধ্যার আবির মাখানো আকাশে উড়ছে মেঘ, ছায়াছায়া সুধীর দিগন্তের ভেতর বসে আছে, তাঁর চোখে আমরা তার আগে দেখেছি শূন্যতা। সহসাই নামবে রাত, আকাশের রঙ ফুরিয়ে যাবে, বেদনার বোধ ফ্রেম জুড়ে, সুধীরের চোখ থেকে সে বেদনা ঝরে পড়ে শিশির হয়ে যা তাকেই ভেজায়। ‘জন্মসাথী’ শেষ হলে আমরাও ভিজতে থাকি গ্লানি ও লজ্জায়, এই ভেবে যে আমাদের যুদ্ধ বিজয়ের স্মারক শিশুদের আমরা দিয়েছি একটি অভিশপ্ত জীবন।
‘জন্মসাথী’ শবনম ফেরদৌসী’র অন্বেষণের সিনেমা, তিনি নিজে জন্মেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই এবং বড় হয়ে জানতে পারেন সেসময় তার জন্ম নেয়া হাসপাতালের ওয়ার্ডে তাঁরই জন্মের দিনে জন্মেছিল ১৩ টি শিশু যার তিন বা চারজন মুক্তিযুদ্ধে যৌনসন্ত্রাসে অন্তঃসত্ত্বা মায়ের সন্তান। এরকম অনেক শিশুই জন্মেছিল, যার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও এর সংখ্যা ২৫,০০০ এর কম নয়। যৌনসন্ত্রাসে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিল আরও অনেক বেশি নারী, আনুমানিক ১৫০,০০০ থেকে ১৭৫,০০০, তাদের অনেকেই স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নেন এবং অন্যান্যরা গর্ভপাত করেন। মুক্তিযুদ্ধে যৌনসন্ত্রাসে জন্ম নেয়া শিশুদের আমরা চিনি যুদ্ধশিশু নামে।
যুদ্ধশিশুদের অন্তত তিনজন শবনমের প্রত্যক্ষ ‘জন্মসাথী’। তিনি তাড়িত হয়েছেন তাঁর জন্মসাথীদের খুঁজতে, যা আরও তীব্রতর হয় অভিজ্ঞতায় যখন দেখেছেন কী নির্মমভাবে আমাদের সমাজ তাঁদের পরিত্যাজ্য করেছে। কিছু যুদ্ধশিশুকে পাশ্চাত্যের অনেক পরিবার দত্তক নেয়, যার একজনকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি যিনি থাকেন নরওয়ে, আর অন্যান্যরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন, নিজের কাছ থেকেই তাঁরা নিজেরা লুকিয়ে থাকেন—জীবন তাঁদের কাছে একটি ক্রুশ যেখানে তাঁরা বিদ্ধ জন্মের সূত্রে যাতে নিজেদের কোন হাত নেই। অস্ট্রেলিয়ান চিকিৎসক ডেভিস, যিনি ১৯৭২ সনে প্রায় ৫০০০ নারীর গর্ভপাত করেছেন, তাঁর জবানিতে শুনি, “These mothers of raped children were treated in the worst possible way by many of their husbands or family members.”
শবনমের অন্বেষণ ক্যামেরায়, তাঁর লেন্স দুজন যুদ্ধশিশু, যারা এখন প্রায় মধ্যবয়সের, দিনাজপুরের সুধীর এবং হবিগঞ্জের শামসুন্নাহারের জীবনের ধূসর চিত্র উন্মোচন করে, কানাডাপ্রবাসী আরেক যুদ্ধশিশু মনোয়ারা ক্লার্কের সঙ্গেও হয় আলাপচারিতা। শবনম এদের বিজয়-শিশু হিসেবে অভিহিত করতে চান, এরকমই তিনি বলেছেন ‘জন্মসাথী’ নির্মাণের পরের সাক্ষাৎকারে। প্রকৃতপক্ষে ওরাই তো আমাদের বিজয়ের স্মারক। সিনেমাকার হিসেবে শবনমের একটি দায়বোধ আছে—তিনি পঙ্কিলতার ভেতর থেকে আমাদের সামাজিক মনোভাবের উত্তরণ এবং সঙ্কীর্ণতা থেকে মানুষের মুক্তির প্রয়াসি। ‘জন্মসাথী’ আমাদের চোখ খুলতে সাহায্য করে, আমরা দেখি তাঁদের যারা আমাদের অবহেলায় চোখের সামনে শুধু ফাঁকাফাঁকা দেখে, যেমনটি বলছে সুধীর।
শবনম জিজ্ঞেস করে, জানতে চায়—কেমন এ জীবনটা? সুধীর একবার ধান ক্ষেতে তাকায়, একবার শবনমের দিকে। বলে, মানুষের জীবন আর কেমন থাকে? আমার জীবন, কই, কিচ্ছুত দেখতে পাই না, সবই ফাঁকাফাঁকা। সুধীরের পেছনে ধান ক্ষেত, সবুজে ছেয়ে আছে, দূরে গাছ গাছালিতে গ্রাম। দৃশ্যত প্রশান্তির পাটাতনে সুধীরের জীবন শূন্য। এ শূন্যতার অনেকটাই আমাদের কারণে। আমরা তাঁদের গ্রহণ করিনি, সমাজে তাঁরা অচ্ছুৎ। সুধীরের কাছে জীবন একটি যন্ত্র মাত্র; সে বলে, মাঝেমধ্যে কাম করি, আর ভাত খাই। তার চেয়ে বেশি কিছু হতে হলে জীবনে প্রয়োজন সমাজের সাথে বন্ধন, জন্মসূত্রেই যা তাঁর থেকেও নেই। কিন্তু চেতনার গভীরে এ দেশটিতে সে শেকড় ছড়িয়ে আছে, যদিও দেশ তাঁকে বুকে তুলে নেয়নি। তাঁর মোবাইলের রিংটোনে বাজে, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে, বাঙলার স্বাধীনতা আনলো যারা।
নারীর কষ্ট আরও তীব্র। সুধীর বিয়ে করে সংসার করেছে, তাঁর সন্তান এখন কিশোরী, সে ভ্যান চালিয়ে রোজগার করে। কিন্তু শামসুন্নাহারের বাস পুরোই একটি কুয়োয়। তাঁকে লুকিয়ে শবনমের সাথে দেখা করতে হয়। থাকার জায়গা নেই, সে অসুস্থ। অন্যায় ও অবিচারে বিপর্যস্ত শামসুন্নাহার কার কাছে বিচার চাইবে? দেশের কাছে কী চাও? শবনমের প্রশ্নের উত্তরে সে বলে, কিছুই চাই না। তাঁর মুখের বিষণ্ণতা রাগকে লুকিয়ে রাখে। পর্দা জুড়ে ঝিলে বাংলাদেশের জাতীয় ফুল, যে বাংলাদেশ তাঁকে কোন অধিকার দেয়নি। সে বলে, বিচার চাইতে গেলে আমার মৃত্যু, আমার কেউ আছে? মাটির দিকে তাকিয়ে শামসুন্নাহার, মাটিও জানে তাঁর কেউ নেই। তাঁর দীর্ঘশ্বাসে ধানক্ষেতে হাওয়া বয়, হাওয়া নয় হাহাকার।
কানাডায় দত্তক হয়ে বেড়ে ওঠা মনোয়ারার প্রশ্ন, আমার দেশ কেন আমাকে ভিনদেশে পাঠিয়ে দিলো? দেশ কি সন্তানকে নিজের কাছে পারতো না রাখতে? এখনও তাঁর হাতে বেয়োনেটের দাগ, মায়ের শরীরে বেয়োনেট চার্জ করলে গর্ভাবস্থাতে জন্মের আগেই মনোয়ারার শরীরে সারা জীবনের জন্য জখমের দাগ বসে যায়। শরীরের দাগ দেখা যায়, কিন্তু মনের জখম দেখার ও বোঝার চোখ ও মন কি আমাদের আছে?
অনুসন্ধানি ডকুমেন্টারি ‘জন্মসাথী’ অনেকগুলো লেভেলে মৌলিক কিছু বিষয় আমাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। আমাদের সঙ্কীর্ণতার আয়না যেন ‘জন্মসাথী’। সঙ্কীর্ণতায় মানুষের আবেগ দানবের রূপ নেয়, আমরা অতিসাধারনিকরণ করি। তাই যুদ্ধের স্মারক মানব সন্তানকে তাঁর অজানা পিতার প্রতিনিধি ভেবে দাবিয়ে রাখি, পারলে হত্যা করি। আমরা এও দেখি বিপদে, মৃত্যু যখন কানের নিচে নিঃশ্বাস ফেলছে, তখন আপনজনকে শত্রুর হাতে তুলে দেয় মানুষ নিজেরা বাঁচবে বলে। সুধীরের মা টেপারিকে তাঁর পরিবারই শত্রুসেনার ক্যাম্পে তুলে দিয়েছিল বিনিময়ে নিজেরা বাঁচবে বলে। মানুষের স্নেহ ভালবাসার চাইতেও তার বেঁচে থাকার সম্বলটিই অনেক বেশি দরকার। সুধীরের নানা টেপারিকে বলেছিল, সুধীরকে রাখ, মারিস না, এটাই দেবে ভাত। ক্ষুন্নিবৃত্তি আর বেঁচে থাকার কাছে ভালবাসা ও স্নেহ সব ফিকে হয়ে যায়। প্রয়োজনের কাছে মানুষ হেরে যায়, মানবিক গুণ জায়গা করে নিতে পারে না।
শবনমের ক্যামেরায় লো-এঙ্গেলে উঠোন থেকে দেখা যায় ঘরের ভেতর টেপারি—পৃথিবী থেকে লুকিয়ে আছে। সুধীর ভ্যান চালিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ সড়ক দিয়ে, লো-এঙ্গেলে তাঁর একাকীত্ব ছলাৎ করে ওঠে। টেপারির ভাই বলছে, জান বাঁচানোর জন্য টেপারিকে ক্যাম্পে তুলে দেই; সাথেসাথেই ক্যামেরা টিল্টআপ—উঠোনে টেপারির পা থেকে শরীর বেয়েবেয়ে ক্যামেরা উপরে ওঠে, টেপারির বিহ্বল দৃষ্টি। তাঁর দৃষ্টি কোন কিছু জানান দেয় না, যেমন সে জানতো না কীসের যুদ্ধ? কার সাথে? কেন? কিন্তু এ যুদ্ধ তাঁর শরীরকে খাবলে দিয়েছে, যুদ্ধ থেমে গেলে সন্তানের জন্ম হয়, মাতৃস্নেহে টেপারি খুশি হয়েছিল, কিন্তু সেই থেকে শুরু হয়েছে আরেক যুদ্ধ, ন’মাস নয়, বছরের পর বছর এ যুদ্ধ তাদের সাথে যারা তাঁর আপন।
টেপারি বুঝতে পারে না এ জীবনের মানে কী? সুধীরের শূন্য দৃষ্টি কী খোঁজে, খুঁজতে খুঁজতে এখন হয়তো সে নিজেও তা জানে না। সে মাঝেমধ্যে কাজ করে, আর ভাত খায়।
জন্মসাথী:
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)