২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজান হামলায় নির্মমভাবে খুন হয়েছিলেন বাংলাদেশের অবিন্তা কবিরসহ কয়েকটি দেশের নাগরিক। সম্প্রতি সেই ঘটনা নিয়ে হংসল মেহতা পরিচালিত বলিউড সিনেমা ‘ফারাজ’ মুক্তি পেতে যাচ্ছে। একই ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশে মুক্তির অনুমতি পেয়েছে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত সিনেমা ‘শনিবার বিকেল’। শনিবার বিকেল নিয়ে কোনো আপত্তি না জানালেও ’ফারাজ’ সিনেমার মুক্তি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন অবিন্তার মা রুবা আহমেদ।

সম্প্রতি রিলিজ হওয়া ট্রেলার দেখে তিনি এটাকে আপত্তিকর, অসম্মানজনক এবং তার পরিবারের গোপনীয়তার লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করেছেন। অশ্রুসিক্ত নয়নে দাবি করেছেন, যেন তার মেয়েসহ নৃশংসভাবে খুন হওয়ার ওই ঘটনা দর্শকদের জন্য কেবল নিছক বিনোদন উপভোগের এবং প্রযোজকদের জন্য আর্থিক লাভের কোনো পণ্যে পরিণত না হয়।
রুবা আহমেদ তার মেয়ের স্মৃতি ও মর্যাদা রক্ষা করতে চান। নিজের মেয়ের জীবন কেড়ে নেওয়া মর্মান্তিক ঘটনার ’অ্যাকশান-থ্রিলার’ ধাঁচের পুনর্নির্মাণ, রূপালী পর্দায় সেই সিনেমার প্রদর্শন আর তা দেখে দর্শকের বিনোদন’ এই দৃশ্য পৃথিবীর যে কোনো মায়ের জন্য মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক।
রুবা আহমেদ আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, বাস্তব ঘটনাকে অবলম্বন করে বাণিজ্যিক সিনেমা নির্মাণে আমাদের আরও সচেতন ও সংবেদনশীল হওয়া প্রয়োজন। কারণ এ ঘরানার অধিকাংশ সিনেমাতেই গল্পকে নাটকীয়তা দিতে, দর্শককে হলে টানতে নির্মাতাদের প্রায়ই মূল ঘটনাকে চাঞ্চল্যকরভাবে উপস্থাপন করতে দেখা যায়। বিশেষ করে “ভিকটিম-নির্ভর” সিনেমায় কোনো অর্থপূর্ণ প্রেক্ষাপট না দেখিয়ে, সমস্যার সমাধান কী হতে পারে তা উঠিয়ে না এনে বরং ঘটে যাওয়া ঘটনাকে সহজীকরণ করে এবং ক্ষেত্র বিশেষে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে। কেবল তাই নয়, অনেক সময় এ সিনেমাগুলো ভিকটিমদের কষ্ট, ঘটনার ভয়াবহতা ইত্যাদিকে স্বাভাবিকতা দেয়।
অতীতে বাস্তব ঘটনা অবলম্বন করে নির্মিত অনেক সিনেমার বিরুদ্ধেই মানবীয় কষ্টকে পণ্যে রূপান্তরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। উদাহরণ হিসেবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশে নির্মিত সিনেমাগুলোর কথা বলা যায়। চলচ্চিত্র বিশ্লেষক, গবেষক ও সমালোচকরা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমায় ইতিহাস বিকৃতি, মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকাকে খাটো করে দেখানোর অভিযোগ তুলেছেন। ‘মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে নারী নির্মাণ’ বইয়ে কাবেরী গায়েন দেখিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমায় কীভাবে নারীকে কেবল যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি ও ধর্ষণবাণিজ্যের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
আরেক ধরনের সিনেমা আছে যেগুলোকে বলা হয় Poverty Porn যা অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির দরিদ্র মানুষের অসহায় জীবনকে ঘিরে নির্মিত হয়। এগুলো হতে পারে তথ্যচিত্র বা পূর্ণদৈর্ঘ ফিচার ফিল্ম। এসব সিনেমায় দারিদ্রের প্রকৃত কারণ উদঘাটন না করে, দারিদ্রের অবস্থা বজায় থাকার জন্য দায়ী সিস্টেম বা ব্যক্তিবর্গকে চিহ্নিত না করে এবং এর থেকে উৎরানোর উপায় না খুঁজে কেবল দারিদ্রের ভয়াবহ চিত্র উপস্থাপন করা হয় যা অনেক সময়ই দর্শককে উপস্থাপিত বিষয়গুলো সম্পর্কে ভুল ধারণা দেয়, নাটকীয়তা দিয়ে, চাঞ্চল্যকর উপাদান যোগ করে ভয়ারিস্টিক (অন্যের গোপন বিষয় লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার প্রবণতাকে বোঝাতে ভয়ারিজম শব্দটি ব্যবহৃত হয়) হিসেবে দেখানো হয়। সাধারণত সিনেমা হলে আলো নিভিয়ে দর্শকদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে ভয়ারিস্টিক প্লেজার নেয়ার আয়োজন করা হয় যা বিনোদনের খোরাক যোগায়। হলিউডে নির্মিত স্লামডগ মিলিয়নিয়ার, দ্য হোয়াইট টাইগার, দ্য অ্যাক্ট অব কিলিং এরকমই কিছু সিনেমা। সমালোচকদের অভিযোগ, পরিচালকরা এগুলোতে দারিদ্র, পতিতাবৃত্তি, সহিংসতা, অপরাধ ইত্যাদির বিষয়গুলোকে অতিরঞ্জিত করে বিনোদনযোগ্য পণ্যে পরিণত করেছে যা খুবই অসংবেদনশীল এবং শোষণমূলক।
প্রশ্ন উঠতে পারে, প্রকৃত ঘটনাভিত্তিক সিনেমায় নির্মাতারা মানবীয় কষ্টের ভয়াবহতাকে না দেখালে মানুষ ওই বিষয় সম্পর্কে সচেতন হবে কীভাবে। উত্তর হচ্ছে, সিনেমা অবশ্যই বানাতে হবে সচেতনতার জন্য। কিন্তু প্রকৃত ঘটনাকে বিকৃত না করে, ঘটনার ভিকটিম ও তাদের পরিবারের গোপনীয়তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, সমব্যাথী হয়ে, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা বজায় রেখে। কেবল অন্যের কষ্ট-বেদনা-দুর্ভোগকে পণ্যে পরিণত করে মুনাফা অর্জন আর বিনোদন দেয়ার জন্য নয়।
সত্যজিত, ঋত্বিক, মৃণালসহ অনেক পরিচালকই তাদের চলচ্চিত্রে মানুষের দুঃখ, কষ্ট, দারিদ্র, জীবনের নির্মমতার বিষয়গুলো দেখিয়েছেন। কিন্তু সেগুলোকে উপভোগের বিষয় হিসেবে তারা দেখাননি বরং মানুষকে ভাবিয়েছেন, মানুষের সামনে চিন্তার জন্য প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন। বিশ্ব চলচ্চিত্র জগতে এক ধরণের সিনেমা আছে যেটাকে বলা হয় থার্ড সিনেমা। আর্জেন্টিনার দুই খ্যাতিমান চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক ফার্নান্দো সোলানাস ও অক্টাভিও গেটিনো এ ধরনের সিনেমার কথা বলেছেন যেখাানে পরিচালকরা সমাজের বাস্তব সমস্যাগুলো নিয়ে আসেন এবং ইচ্ছাকৃতভাবে সিনেমায় এমন ধরণের ফর্ম ব্যবহার করেন যা দর্শককে বিনোদন নেয়া থেকে বিরত রাখে। ফলে সিনেমাগুলো হয়ে ওঠে সমাজ পরিবর্তনের রাজনৈতিক হাতিয়ার।
বাস্তব ঘটনা নিয়ে সিনেমা নির্মাণের আগে আমাদের অনুসন্ধান করা উচিত তা ঘটনার ভুক্তভোগীদের উপর কী ধরণের প্রভাব বয়ে আনতে পারে সে বিষয়ে। প্রকৃত জীবনে কারো ট্রাজেডি যেন অন্যের বিনোদনের খোরাক যোগানো পণ্যে পরিণত না হয় সেই নৈতিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখা উচিত। আমরা জানি আমাদের জীবনে মিডিয়া তথা সিনেমার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। একটা শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কেবল ব্যক্তি পর্যায় নয়, সিনেমার পুরো সংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে রূপ দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। ফলে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যেন নির্মাতারা এই মাধ্যমকে দায়িত্বের সাথে ব্যবহার করে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)