চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

প্রত্যেক প্রবাসীই নিজ দেশের একজন এম্বাস্যাডর

প্রবাসে এসে নতুন বাসায় উঠেছি আমরা। একদিন সকাল বেলা পাশের বাসার অজি (অস্ট্রেলিয়ানরা নিজেদের অজি ডাকে) প্রতিবেশীজন এসে হাজির। আমরা বললাম, ভিতরে আসো। আমাদের দেশের নিয়ম হচ্ছে প্রতিবেশীকে না খেয়ে যেতে দিতে বারণ বিশেষ করে প্রথমবার। সে একটু ইতঃস্তত করে বাসার ভেতরে আসলো। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি খেতে চাও। উত্তরে সে বলল, চা হলেই চলবে। আমরা চা বানিয়ে তাকে দিয়ে বসলাম গল্প করতে। জন কয়েক প্রজন্ম ধরেই অস্ট্রেলিয়ান। শুরুতেই জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কোন দেশ থেকে এসেছো। আমরা বললাম, বাংলাদেশ। এরপর সে যে প্রশ্ন করলো। আমরা মোটেও তার জন্য তৈরি ছিলামনা।

জন বলল, তোমরা কি এসাইলাম হিসাবে এসেছো? তার প্রশ্ন শুনে আমরা খুবই অবাক হলাম। আমরা পাল্টা প্রশ্ন করলাম, তোমার এমন মনে হবার কারণ কি? উত্তরে সে বলল, তার অভিজ্ঞতা থেকে সে এটা বলেছে। এরপর আমরা খুবই ঠান্ডা মাথায় তাকে বুঝিয়ে দিলাম, দিন বদলেছে। আমরা বললাম, আগে হয়তোবা এভাবে মানুষজন আসতো। কিন্তু তুমি জানো এখন ডিজিটাল যুগ।তুমি শুনে অবাক হবে আমরা দেশ থেকেই পিআর নিয়ে এসেছি। তোমার অবগতির জন্য আরও জানাচ্ছি এখন অনেকেই এভাবে আসছে। অবশ্য ছাত্র হিসেবেও অনেকেই আসছেন এবং নিজের যোগ্যতায় এখানে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছেন। তোমার অবগতির জন্য আরো জানাচ্ছি, আমরা দুজনেই আমাদের পড়াশোনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ চাকরিও করছি। এরপর থেকে জন আমাদের সমীহ করে কথা বলে।

আরেকদিনের কথা। রোজার মাস চলছে। আমাদের বাসার বিপরীতে রাস্তার অপর পাশের দ্বিতীয় বাসাটা এক বাংলাদেশি ভাইয়ের।উনি রমজান মাসকে সামনে রেখে বাসায় আলোকসজ্জা করেছেন। আর তার মধ্যেআলো দিয়ে আরবীতে ঈদ মোবারক লিখছেন। এটা দেখে আমাদের ঠিক বিপরীত পাশের বাসার মাইকেল আমাকে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, এগুলো কিসের সজ্জা?  আমি বললাম, তোমরা যেমন বড়দিনকে সামনে রেখে বাড়িঘর সাজাও আমরাও তেমনি এভাবে বাড়ি সাজাই। উত্তরে সে বলল, কিন্তু তোমরা তো বাসা সাজাওনি। আমি বললাম, তোমাদের মধ্যে কি সবাই তাদের বাড়ি সাজায়। এরপর প্রশ্ন করলো, তাহলে ঐ লেখাটা কিসের। আমি বললাম তোমরা সজ্জার মধ্যে বড় বড় করে ক্রিসমাস কথাটা লিখোনা, এটাও ঠিক তেমন ঈদ মোবারক। সে বুঝতে পেরেছে এমন ভাবে মাথা দোলাতে শুরু করলো।

অজিরা বেশিরভাগই বিশেষ করে প্রৌঢ়রা বাড়িতে কুকুর-বিড়াল পুষেন এবং নিয়ম করে সেগুলোকে রাস্তায় পার্কে হাটতে নিয়ে যান। এখানে কুকুরের জন্য আলাদা পার্কও আছে, আছে চিকিৎসা ব্যবস্থা। আসলে জীবকে এরা একটা জীব হিসাবেই চিন্তা করে এবং গুরুত্বও দেয়। আমরা যখন বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে পার্কে খেলতে বা হাটতে যাই তখন তাদের সাথে দেখা হয়। আমরা বরাবরই সময় বুঝে একটা সম্বোধন করি যেমন, সকালবেলা হলে গুডমর্নিং, বিকালবেলা হলে গুডইভিনিং। প্রতি উত্তরে তারাও হাসিমুখে সম্বোধন করেন। এরপর তাদের সাথে থাকা কুকুর কে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করি, হি অর শি। শুরুতে এভাবে জিজ্ঞেস করার ব্যাপারটা আমরা জানতামনা। আমরা সরাসরি কুকুরের নাম জানতে চাইতাম। পরে একদিন জানতে পারলাম আগে হি অর শি জিজ্ঞেস করে নিতে হয়। এরপর নাম জিজ্ঞেস করতে হয়। কুকুর আমাদের ছেলেমেয়ে দুজনেরই ভীষণ পছন্দের প্রাণী। তারা কুকুর দেখলেই সেগুলোকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে ঠিক যেভাবে আমরা আমাদের বাসার পোষাকুকুরকে আদর করতাম। এরপর আমরা সেই কুকুরের নাম মনে রাখার চেষ্টা করি এবং পরেরবার তার নাম ধরে জিজ্ঞেস করি সে কেমন আছে। এভাবেই আমাদের অনেক বন্ধু তৈরি হয়ে গেছে। এরপর দেশের প্রসঙ্গ আসতেই বলি আমি বাংলাদেশের মানুষ।

ছোট্ট রায়ান আদর করছে প্রতিবেশীর কুকুরকে।

 

অজিরা রাস্তাঘাটে চলারপথে অপরিচিত মানুষের সাথেও শুভেচ্ছা বিনিময় করে। সেটা দেখে আমিও তাদেরকে শুভেচ্ছা জানাই। এভাবে শুভেচ্ছা জানাতে যেয়ে টুকরোটুকরো কথাও হয়। যেমন সবচেয়ে বেশি কথা হয় আবহাওয়া নিয়ে। দিনটা কি রৌদ্রজ্জ্বল নাকি ম্যাড়ম্যাড়ে, গরম না ঠান্ডা, তারমাত্রা কেমন? এছাড়াও কেমন আছেন খুবই সাধারণ একটা প্রশ্ন। এর উত্তরে আমি কখনওই অজিদেরকে কোন নেগেটিভ উত্তর দিতে শুনিনি। তারা বলে, এক্সেলেন্ট, ভেরিগুড আর যদি অবস্থা একটু বেগতিক হয় তাহলে নট টু ব্যাড, নো কমপ্লেইন এমন সব শব্দে উত্তর দেয়। এভাবে কত অপরিচিত মানুষ যে কি অকৃত্রিম হাসি উপহার দেয় তার হিসাব নেই।

আমাদের স্টেশনে যতজন স্টেশনমাস্টার কাজ করেন আমি তাদের প্রত্যেককেই চিনি এবং ট্রেনে আসাযাওয়ার পথে তাদের সাথে কুশল বিনিময় করি। একই ভাবে বাসের ড্রাইভারের সাথেও কুশল বিনিময় করা হয়। একদিন নতুন একজন মহিলা স্টেশনমাস্টারকে দেখে যথারীতি আমি গুড মর্নিং বলে সম্বোধন করলাম। উনি খুবই অবাক হয়ে, আমাকে বললেন লোকে সাধারণত আমাদের খোঁজ নেয়না। উত্তরে আমি বললাম, এখানকার সব স্টেশনমাস্টারকে আমি চিনি। একজন আছেন হেনরি, সম্প্রতি দাদা হয়েছেন বলে আমি তাকে দাদা বলে ডাকি। শুনে উনি হেসে কুটিকুটি। বললেন, এরপরের বার দেখা হলে তুমি ওকে পপস বলে সম্বোধন করবে। উত্তরে আমি বললাম নিশ্চয়ই। এরপর দেশের প্রসঙ্গ আসতেই আমি বললাম আমি বাংলাদেশের মানুষ।

ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুলের বাইরের দেয়ালচিত্র।

 

আমাদের অফিসে আমিই একমাত্র এশিয়ার। বাকিরা সবাই অজি এবং পৈতৃকসূত্রে আয়ারল্যান্ডের। চাকরির শুরুতে আয়ারল্যান্ডের মানুষদের নিয়ে তেমন ভালো কথা শুনিনি। কিন্তু এখানে যোগদানের পর আমার সেই ভুল ভেঙে গেছে। তবে তাদের কাছে বাংলাদেশের মনে হয় তেমন একটা ভালো ভাবমূর্তি ছিলনা। তবে বিগত সাত বছরে আমি সেখানে একটা বড় ধাক্কা দিতে সক্ষম হয়েছি। আমার বস বয়সে আমার বাবার বয়সী, একেবারে লালটুকটুকে ফর্সা এক ভদ্রলোক। তাই আমাদের কোম্পানির মালিক দুই ভাইয়ের একজন আমাকে তার ছেলে বলে সম্বোধন করেন। একদিন আমাকে ফটোকপিয়ারের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমার বসের নাম নিয়ে আমাকে বললেন তোমার এই হাল কেন? মানে উনিতো ফর্সা কিন্তু আমি তো কালো। উত্তরে আমি বললাম, উনি আসলে ফোটোকপিয়ারের অন্যদিক দিয়ে ঢুকেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সাদাকালো মুড অন থাকাতে এদিক দিয়ে আমি বেরিয়ে এসেছি। এরপর উনি যত জন নতুন মানুষ আমাদের অফিসে যোগ দিয়েছেন সবাইকে নিয়ে এসে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় এই গল্পটা বলেন। এই হলো বাংলাদেশের আলী, দাড়াও ওকে নিয়ে একটা গল্প বলি।

সহকর্মীদের সাথে দুপুরের খাবারে লেখক।

 

এই অফিসেই পরিচয় হলো আয়ারল্যান্ডের একজন তরুণের সাথে। তার নাম মাইকেল মিকেলপ। বয়সে আমার ছোট কিন্তু উচ্চতায় আমার অনেক বড়। তার উচ্চতা ছয় ফুট নয় ইঞ্চি। তার পাশে দাঁড়ালে পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির এই আমাকেও লিলিপুট মনে হয়। সময়ের সাথে সাথে তার সাথে ঘনিষ্টতা তৈরি হলো। এরপর দেখি আমার এবং তার মানসিকতা খুবই কাছাকাছি। আমরা দুজনেই একটা শ্রেণীবৈষম্যহীন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি। আমরা একসাথে দুপুরের খাবার খেতে যাই। কোনদিন আমি খাবার কিনি কোনদিন সে খাবার কিনে। ঠিক যেভাবে আমরা ছোটবেলায় স্কুলে টিফিন ভাগ করে খেতাম তেমন। একদিন দেখি সে চে গুয়েভারার ভক্ত এবং তার চাবির রিং চে গুয়েভারার। এরপর একসময় সে দেশে ফিরে গেলো এবং যাবার সময় অনেক কিছুর সাথে চাবির রিংটা আমাকে দিয়ে গেলো। ওরা ইচ্ছে করলেই যে কোন সময় দেশে ফিরে যেতে পারে কিন্তু আমরা পারিনা পাছে লোকে কি বলবে সেই ভয়ে।

লেখকের সহকর্মী মাইকেলের হাতে বাংলা বই।

 

অপেরাহাউস, পৃথিবীবিখ্যাত এক আশ্চর্যের নাম। সিডনির সার্কুলার কিয়েস্টেশনে নামলেই যার দেখা মেলে। আর একটু পায়ে হেটে গেলেই চোখের সামনে সরাসরি দেখা যায়। এখানে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক আসেন বেড়াতে। তাই সার্কুলার কিয়েস্টেশনের আশেপাশে বেশ কিছু মানুষ ভ্রাম্যমাণ কাজের মাধ্যমে তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন। একজন আছেন এক একদিন এক একরকম সেজে মানুষের সাথে ছবি তুলেন। এরপর মানুষ খুশি হয়ে যা দেন তাই নেন। একদল উপজাতি আছে তাদের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে চলেন। তাদের বাজনা শুনে খুশি হয়ে যে যা দেন তাই নেন। এর বাইরে অনেকেই আছেন। কেউ গিটার বাজিয়ে, কেউ বেহালা বাজিয়ে কেউ বা কিবোর্ড বাজিয়ে দর্শনার্থীদের বিনোদন দেন। তার বিনিময়ে তারা যা দেন খুশি হয়ে নেন। এখানে আমার সাথে পরিচয় হয়েছিল আর্জন্টিনার গ্যাব্রিয়েল গঞ্জালেজ’র। সে কিবোর্ড বজায়। তার বাজনা শুনে খুশি হয়ে বললাম, আমি কফি নেব, তুমিও কি এক কাপ কফি চাও। উত্তরে সে বলল, তাহলে তো ভালোই হয়। কফি এনে আমরা গল্প জুড়ে দিলাম। এরপর সে আমার দেশ বাংলাদেশ শুনে বলল, তুমি আমাকে বাংলাদেশের কোন একটা মিউজিক ইউটিউবে খুঁজে দাও যেটা আমি বাজাতে পারি। আমি সাথে সাথে তাকে মাহমুদুজ্জামানের ‘আমি বাংলার গান গায়’ খুঁজে বের করে দিলাম।

গত ২৬শে নভেম্বর ২০২২ শনিবারের কথা। ক্যামডেন সাবার্বে গিয়েছিলাম সেখানকার জ্যাকারান্ডা ফুল দেখতে। বসন্তকালে সারা অস্ট্রেলিয়া জুড়ে ফুটে থাকে এই বেগুনি জ্যাকারান্ডা ফুল। ঠিক যেমন বাংলাদেশে বসন্তকালে ফুটে কৃষ্ণচূড়াফুল। তাই প্রবাসী বাংলাদেশিরা এটাকে অজি চূড়া নামে ডাকেন অনেক সময়। ক্যামডেনে ঐদিন প্রস্তুতি চলছিল রাতের ক্রিসমাস উৎসবের। বেশ গরম পড়েছিল সেদিন। রাস্তা বন্ধ করে স্টল নির্মাণের কাজ করছেন সবাই। আমি ঘুরে ঘুরে জ্যাকারান্ডা ফুলের ছবি তুলছি। হঠাৎ কানে এলো ব্যাগপাইপের সুর। খুঁজে দেখি এককোণায় এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক ব্যাগপাইপ বাজিয়ে চলেছেন। দুপুর হয়ে গেছে। আমি কফি হাতে নিয়ে উনার কাছে গেলাম। পকেটে যা খুচরা পয়সা ছিল উনার সামনে রাখা ব্যাগপাইপের কভারের মধ্যে রাখলাম। হঠাৎ মনে হলো উনাকে এক কাপ কফি কিনে দিই।

অস্ট্রেলিয়ার বসন্তের প্রতীক জ্যাকারান্ডা ফুল।

 

আমি হাতের ইশারায় উনাকে থামিয়ে বললাম, তুমি যদি কিছু মনে না করো আমি তোমাকে এক কাপ কফি কিনে দিতে চাই। শুনে সে বলল, তাহলে তো খুবই ভালো হয়। আমি বললাম তুমি অপেক্ষা করো, আমি কফি নিয়ে আসছি। এরপর আমি ফিরে এসে আমার পরিচিত কফির দোকান থেকে কফি নিয়ে উনার কাছে গেলাম। উনি আমাকে আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন। আমিও উনার নাম জিজ্ঞেস করে জানলাম হেনরি। আমি বললাম, হেনরি এইবার একটা ব্রেক নিয়ে নাও। উনি বললেন, ইয়েস ইয়াংম্যান আমি এইবার একটা ব্রেক নিবো। আমি বললাম ব্রেক নিয়ে শান্তিমতো কফিটা খেয়ে তারপর আবার শুরু করো। এরপর উনি ব্যাগপাইপস্ট্যান্ডে রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাকে আজ তাহলে একটা কথা বলি। আমি প্রায় চার বছর ধরে ব্যাগপাইপ বাজিয়ে জীবিকা নির্বাহ করি। তুমি দ্বিতীয় ব্যক্তি যে আমাকে কফি অফার করলে। আমি বললাম, আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে তুমি সেটা গ্রহণ করেছো।

এরপর কফিকাপটা হাতে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়াংম্যান তুমি কোন দেশের মানুষ।আমি বললাম আমার দেশের নাম বাংলাদেশ। উত্তরে উনি বললেন, ইয়াংম্যান ইউ ব্রট ইউর কান্ট্রি হেয়ার। মে গড ব্লেস ইউ এন্ড ইয়োর কান্ট্রি। আমি লাজুক হেসে ফেরার পথ ধরলাম।