জ্ঞান অর্জনের বিষয়ে আলোকপাত করতে গেলে সর্বপ্রথম সর্বগুরুত্বপূর্ণ ও অত্যধিক জনপ্রিয় যে হাদিসের কথা সকলের মননে ভেসে আসে তা হলো, নবী করিম (দ.) বলেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জ্ঞান অর্জন করা ফরজ’ (ইবনে মাজাহ ২২৪)।
জ্ঞানী লোকদের আল্লাহ তায়া’লা উচ্চ মর্যাদা দান করবেন বলেও ঘোষণা দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তায়া’লা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার এবং যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদের সুউচ্চ মর্যাদা দান করবেন’ (সূরা মুজাদালাহ-১১)।
জ্ঞানার্জনে যেমন রয়েছে দুনিয়াবি কল্যাণ ও ফযিলত, তেমনি সে জ্ঞান সমাজের কল্যাণে এবং বাস্তব জীবনে বাস্তবায়নের মাধ্যমে পরকালে রয়েছে কল্যান। মৃত্যুর পর মানুষের সকল আমল বন্ধ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও জ্ঞানের দ্বারা কৃত এমন কাজ, যা সমাজের উপকারে আসে, তা থেকে প্রাপ্ত সওয়াব কখনোই সমাপ্ত হবে না। জ্ঞানার্জনের গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র বলেন, ‘যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান?’ (সূরা আয-যুমার- ৯)।
আল্লাহ তায়া’লা জ্ঞানার্জনের প্রতি অনুপ্রেরিত করে ইরশাদ করেন: ‘তুমি পড়ো তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’ (সূরা আল-আলাক-১)।
আমরা কেউই সব বিষয়ে পারদর্শী নই। আমাদের সবার কোনো একটা বিষয়ে জ্ঞানের স্বল্পতা থাকাটা স্বাভাবিক। যাদের কোনো বিষয়ে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে, তারা কোনো বিষয়ে কী করে জানবে?
এ প্রসঙ্গে কোরআন মাজিদে আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা পথ বাতলে দিয়ে বলেন, ‘জ্ঞানীদের জিজ্ঞাসা কর, যদি তোমরা না জেনে থাক’ (সূরা নাহল-৪৩)। জনৈক ব্যক্তির মাথায় আঘাত লাগা মর্মে বর্ণিত হাদীসে মহানবী (দ.) বলেন: তারা যেহেতু জানে না, সেহেতু তারা কেনো জিজ্ঞেস করল না? কেননা অজ্ঞতার ঔষধ হচ্ছে প্রশ্ন করা (সুনানে আবু দাউদ- ৩৩৬)।
উপরোক্ত আলোচনায় জ্ঞানার্জন দ্বারা ইসলাম ধর্মে মানবকল্যাণে প্রয়োজনীয় সব ধরনের জ্ঞানের কথায় বলা হয়েছে। নিম্নে মানবজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে জ্ঞানের তাগিদ প্রদানে কোরআন হাদিসের অবস্থান কী, সে ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হলো। জ্ঞানার্জনের জন্য সর্বপ্রথম যে-বিষয়টি অধিক গুরুত্বপূর্ণ তা হলো আকিদার জ্ঞান। আকিদা হলো ঈমানের অপর নাম। উভয়ে একই অর্থবোধক। তবে মনে প্রশ্ন জাগবে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য কী?
আকিদা ও ঈমানের মধ্যে কিছু সুক্ষ্ম পার্থক্য নিহিত আছে। ঈমান সমগ্র দ্বীনকে অন্তর্ভুক্ত করলেও আকিদা দ্বীনের সর্বাধিক তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে। সুতরাং আকিদার তুলনায় ঈমান ব্যাপক। ঈমানের ধাপ তিনটি- অন্তরে ধারণ, মৌখিক স্বীকৃতি ও বাস্তব প্রতিফলন। পক্ষান্তরে আকিদা শুধুমাত্র অন্তরে লালিত দৃঢ় বিশ্বাস। ঈমানের দু’টি অংশ। একটি হলো আকিদা তথা বিশ্বাস। অন্যটি বাহ্যিক তৎপরতা। আকিদা ব্যতীত ঈমান অসম্পূর্ণ। আকিদার দৃঢ় ভিত্তির উপর নির্ভর করে ঈমানের তারতম্য দেখা দেয়। আকিদায় বিভ্রান্তি দেখা দিলে ঈমানও বিভ্রান্ত হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হয়। যুগে যুগে বহু সম্প্রদায় তাদের পর্যাপ্ত আকিদার জ্ঞানের অভাবে ঈমান হারা হয়ে যাবে। কেয়ামতের দিন ৭৩টি দল হবে তন্মধ্যে একটা দল জান্নাতি। রাসূলের (দ.) সুপ্রসিদ্ধ ও প্রতিষ্ঠিত এ-হাদিস তার প্রমাণ বহন করে।
আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভে ইবাদতের গুরুত্ব অপরিসীম। ইবাদতেরও বিভিন্ন শ্রেণীবিন্যাস রয়েছে। যেমন- ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, মুস্তাহাব। তন্মধ্যে ফরজ ইবাদত হলো যা কোরআন-হাদিস দ্বারা নির্ণীত। অত্যাবশ্যক এ ইবাদত পালনের ক্ষেত্রে যেমন সওয়াব পাওয়া যায়, তেমনই তা পরিত্যাগকারী শাস্তির হকদার। রাসূল (দ.) বলেন, আমার বান্দা যে সমস্ত জিনিস দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করে, তার মধ্যে আমার নিকট প্রিয়তম জিনিস হল তা, যা আমি তার উপর ফরজ করেছি (বুখারি- ৬৫০২)।
ফরজ ইবাদতের নাম বললে সর্বপ্রথম নাম আসে নামাজের। এ ফরজ ইবাদত পালনের জন্য ওজু থেকে শুরু করে নামাজের শেষ অবধি সকল কিছু পূর্ণাঙ্গভাবে সম্পন্নকরণে জানা এবং মানার বিকল্প নেই; পাশাপাশি অনেকসময় জ্ঞানের স্বল্পতার দরুন আমলে তারতম্য ঘটলে নামাজ বাতিল হয়ে যায়। নামাজের ভেতরে ও বাহিরে তেরটি ফরজ আছে, যা পালন ব্যতীত নামাজ হবে না। সে বিষয়ে অবশ্যই জ্ঞান রাখতে হবে। পাশাপাশি বিশেষ ক্ষেত্র যেমন- মুসাফির অবস্থায় নামাজে কসর কিংবা নারীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নামাজ মওকুফ ইত্যাদির জ্ঞান নর-নারী উভয়ের জন্য ফরজ। বালেগ হওয়ার পূর্বেই নামাজের জ্ঞান, পদ্ধতি, দোয়া ও মাসআলা সম্পর্কে অবগত হতে হবে যাতে পরবর্তীতে তা অনাদায়ে গুনাহের অংশীদার না হতে হয়। হাদিসে এসেছে- নামাজী ব্যক্তির গুনাহ পাতা ঝরে যাবার ন্যায় ঝরে পড়ে। পক্ষান্তরে, উদাসীন ব্যক্তির জন্য কেয়ামতের দিন নামাজ নূর ও দলিল হবে না। তাই এ ব্যাপারে উদাসীনতা মোটেই কাম্য নয়।
জ্ঞানের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ মহাগ্রন্থ আল-কোরআন শিক্ষা করা। কোরআনের জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উপর ফরজ। জীবন পরিচালনার জন্য কুরআন হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত একটি সিলেবাস। যেখানে একজন বান্দার জীবনযাপনের পরিপূর্ণ পথ বাতলে দেয়া রয়েছে। এছাড়াও আল্লাহর সাথে কথা বলার অনন্য এক উপায় হচ্ছে কোরআন তেলওয়াত করা। যার এক হরফ উচ্চারণে দশ নেকি। নিয়মিত কোরআন তেলওয়াতে কবরের আজাব মাফ পাওয়া যায় এবং এর পাঠক কেয়ামতের দিন সুপারিশ প্রাপ্ত হয়। দারিদ্রতা দূর করতে এবং রোগের শিফার জন্য কোরআন তেলওয়াতের গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি যাতে রয়েছে নিরাময় ও মুমিনদের প্রতি রহমত’ (আল-ইসরা- ৮২)।
কোরআন পাঠের তাৎপর্য বোঝাতে আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন, ‘আর যখন কোরআন পড়া হয় তখন তা মনোযোগ দিয়ে শোনো এবং চুপ থাকো, যাতে তোমাদের প্রতি দয়া করা হয়’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ২০৪)
এছাড়াও এটা বলা বাহুল্য যে, জ্ঞান ও আমলের মিশেলে থাকার কারণে আলেমদের আল্লাহ তায়ালা বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন। আল্লাহ তাআলার প্রিয় বান্দা নবীগণের উত্তরসূরি হিসেবে আলেমদের মর্যাদা প্রদর্শন করা হয়েছে। যেমন রাসুল (দ.) ইরশাদ করেন, ‘আলেমরা নবীদের উত্তরাধিকারী, আর নবীরা উত্তরাধিকার হিসেবে দিনার ও দিরহাম রেখে যাননি। তারা উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে গেছেন ইলম। অতএব যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করেছে, সে বিপুল অংশ লাভ করেছে’ (সুনানু আবী দাউদ, হাদিস: ৩৬৪৩)।
এমনকি মৃত্যুর পরও আলেমদের নেক আমল জারি থাকে। আলেমের প্রতি আল্লাহ তায়ালার অনুকম্পা বুঝাতে রাসূল (দ.) ইরশাদ করেন: ‘ইলমের অধিকারী ব্যক্তির জন্য সব কিছুই ক্ষমা প্রার্থনা করে। এমনকি সমুদ্রের মাছও’ (মুসনাদু আবী ইআ’লা: ২/২৬০)।
জ্ঞানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো রিজিক অন্বেষণের পদ্ধতি সম্পর্কে জানা। যেমন, জীবনধারণের জন্য ইসলাম সবচেয়ে বেশি উৎসাহিত করেছে ব্যবসাকে। রিজিক অন্বেষণের সর্বোত্তম মাধ্যম হচ্ছে ব্যবসা। সকল নবী-রাসূল জীবনে ব্যবসা করেছেন কিংবা সংশ্লিষ্ট ছিলেন ব্যবসার সাথে। হালালভাবে ব্যবসা করার ক্ষেত্রেও ব্যবসা সম্পর্কে পূর্ব জ্ঞান রয়েছে। ব্যবসা করার প্রথম শর্ত হচ্ছে তা সুদ মুক্ত হওয়া। যেমন- আল্লাহ তায়া’লা বলেন, ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল এবং সুদকে হারাম করেছেন’ (সুরা বাকারা : ২৭৫)। পাশাপাশি রাসূল (দ.) ব্যবসায়ীদেরকে সৎ হতে বলেছেন এবং পরিমাপে সঠিক দিতে বলেছেন এবং তাদের জন্য দিয়েছেন সুসংবাদও। যেমন- রাসূল (দ.) ইরশাদ করেন, ‘সত্যবাদী আমানতদার ও বিশ্বাসী ব্যক্তি কিয়ামতের দিনে নবীগণ সিদ্দিকগণ এবং শহীদগণের দলে থাকবেন।’ (জামে তিরমিজি, হাদিস : ১২০৯)।
যারা সিন্ডিকেটসহ নানাবিধ অসৎ ব্যবসা এবং ব্যবসায় প্রতারণা করেন তাদের ব্যাপারে কঠিন হুঁশিয়ারি দিয়ে রাসূল (দ.) ইরশাদ করেন, ‘যারা ধোঁকা দেয় ও প্রতারণা করে তারা আমার দলভুক্ত নয়’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)।
সবকিছুর পাশাপাশি সম্পদের জ্ঞানার্জন সম্পর্কেও সূরা নিসার (১১-১৪) নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা সুস্পষ্ট ফারায়েয বা সম্পত্তি বণ্টনের নিয়মাবলি প্রদান করেছেন। যার উপর ভিত্তি করে সম্পদ বণ্টন করা হয়ে থাকে। দুনিয়াতে অধিকাংশ সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো সম্পত্তির অসম বণ্টন। তাই সম্পত্তি বণ্টনের পদ্ধতি জানা সকলের জরুরি। এ-ব্যাপারে রাসূল (দ.) বলেছেন- “তোমরা সম্পত্তি ভাগ পদ্ধতি বা ফারায়েযের জ্ঞান আহরণ করো কেননা তা জ্ঞানের অর্ধেক”(ইবনে মাজাহ) এভাবে মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব।
আর প্রতিটি বিষয়ে পর্যাপ্ত ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন না করলে হালাল-হারাম, বৈধ-অবৈধ এসব বিষয় অজানাই থেকে যায়। ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতও বরবাদ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সুতরাং যে বিষয়টির এত বেশি গুরুত্ব ও মর্যাদা সে বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বের সাথে আলোচনা, পর্যালোচনা ও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। এ-ব্যাপারে জ্ঞানার্জন করা সকলের কর্তব্য। কারণ এর উপরই মানব জাতির দুনিয়া ও আখিরাতের সৌভাগ্য ও সাফল্য নির্ভর করছে। যেমন, কেউ যদি শিরকি আকিদা পোষণ করে তবে তার সকল আমল নিষ্ফল হয়ে যাবে। আল্লাহ তায়া’লা বলেন, ‘যদি শিরক করো তবে তোমার সকল আমল নিষ্ফল হবে এবং তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে গণ্য হবে।’ (সূরা যুমার: ৬৫)।