চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

দেশের আর্থিক পরিস্থিতি সত্যই কি স্বাভাবিক?

সরকার কারও নাম উল্লেখ না করে বলে যাচ্ছেন, “দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উদ্বেগজনক”-এমন দাবী তথ্য ভিত্তিক নয় বরং উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রচারিত গুজব মাত্র। তাঁরা দাবী করেন-প্রকৃত সত্য ওই গুজবের সম্পূর্ণ বিপরীত। বাংলাদেশের অথনৈতিক পরিস্থিতি আদৌ উদ্বেগজনক নয়-বরং অত্যন্ত স্বাভাবিক।

আসলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুব্ধ, তার পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপি নানা সংকটে বহু দেশ জর্জরিত-এতো স্বীকৃত সত্য। আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে ভেতরে ভেতরে আমরা যে বছর বছর অধিকতর পরিমাণে বৈদেশিক ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছি তেমন কোন তথ্য অন্তত: আমার হাতে ছিল না। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন নিয়ে ব্যাপক প্রচার প্রোপাগণ্ডায় দেশ দিন কয়েকের জন্য সত্যই মেতে উঠেছিল এবং বাদ বাকী সব ভুলে অনেকেই প্রকৃত পরিস্থিতি পদ্মা সেতুর মতই উজ্জ্বল বলে ভেবে নিরুদ্বেগ থাকছিলেন। কিন্তু অকস্মাৎ বিদ্যুতের রেশনিং, এক ঘন্টার বদলে ১০ ঘন্টা করে প্রতিদিন বিদ্যুতের অনুপস্থিতি এই গরমে মানুষকে যে দুর্বিষহ পরিস্থিতির সম্মুখীন করেছে তাতে শুধু ঘরে বাস করাই নয়-কৃষদের কৃষি কাজে, কারখানাসমূহে এবং সর্বত্র বিদ্যুৎ অভাবে সামগ্রিক অর্থেই জনজীবন বিপর্য্যস্ত হয়ে পড়েছে। অপরদিকে মানুষের দৈনন্দিন সংসার যাত্রা নির্বাহ করার ক্ষেত্রেও সমস্যা সংকট হয়ে পড়েছে ব্যাপক। প্রতিদিন দ্রব্যমূল্য হু হু করে বেড়ে যাওয়ায় এই সংকট অসহনীয় হয়ে উঠেছে।

একই সাথে ডলারের মূল্য যেভাবে বেড়ে যাচ্ছে তার ফলে রফতানী আয়ে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে বাধ্য। অনুরূপভাবে ক্রমাগতভাবে ডলারের সরকারি-বেসরকারি মূল্যবৃদ্ধি বাজারে দ্রব্যমূলের ক্ষেত্রেও প্রতিকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চলেছে। এর সাথে দুর্নীতি, অর্থ পাচার তো বাধাহীনভাবে অব্যাহত থাকছেই।

এহেন পরিস্থিতিতে কোন মহল থেকে প্রচারিত ‘গুজব’ মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে-না কি প্রকৃত প্রস্তাবে বিদ্যমান সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিই মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে?

এই উৎকণ্ঠার মুখে ‘১বছরে সরকারের রেকর্ড পরিমাণ বিদেশী ঋণ’ শিরোনামে একটি জাতীয় দৈনিকে বিগত ২৮ জুলাই তারিখে প্রকাশিত তিন কলাম ব্যাপী প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত প্রতিবেদন আমাদেরকে এক উদ্বেগজনক সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছেঃ

এক বছরে সরকারের নেওয়া বিদেশী ঋণে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকার বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলারেরও বেীশ ঋণ নিয়েছে। টাকার অংকে যা প্রায় ৯৫ হাজার কোটি টাকা। (এক ডলার ৯৫ টাকা হিসেবে) এর আগে এক অর্থ বছরে কখনও বিদেশ থেকে এত পরিমাণে ঋণ নেয় নি বাংলাদেশ। দাতা সংস্থাগুলির মধ্যে সর্বাধিক ঋণ দিয়েছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) আড়াই বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

এ দিকে টাকার দরপতলে বিদেীশ ঋণের বোঝা অনেক বেড়ে গেছে। এই কারণে প্রায় আড়াই লীখ কোটি টাকা বেশি শোধ করতে হবে। মোট বিদেীশ ঋণের পরিমাণ ৯ হাজার ৫০০ কোটি (৯৫ বিলিলিন) ডলার। এর মধ্যে সরকারি ঋণ সাত হাজার কোটি (৭০ বিলয়ন) ডলার। আর বেসরকারি খাতে ঋণ ২ হাজার ৫০০ কোটি (২৫ বিলিয়ন) ডলার। ৫ বছরের ব্যবধানে বিদেশি ঋণ বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৫৮১ কোটি (৪৫.৮১ বিলিয়ন) ডলার। বিগত ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে সেই ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৫০০ কোটি ডলারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৪৫.৮১ বিলিয়ন ডলার বিদেীশ ঋণের মধ্যে ৩৬.৭৮ বিলিয়ন ডলার ছিল দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ। আর স্বল্প মেয়াদী ঋণ ছিল ৯.৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে সেই ঋণ হয় ৮১.৫৭ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থ বছর শেষে মোট বিদেশি ঋণ ৯৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

দেশে এখন সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও বাড়ছে বিদেশি ঋণ। ২০১৭ সালের শেষে দেশের বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ১২.২৮ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ২০২১-২২ অর্থবছরের শেষে তা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারে। বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে করোনা মহামারির সময়ে। তখন প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়া হয়েছে,যার ৭০ ভাগই স্বল্পমেয়াদী।

এদিকে ‘বাংলাদেশ এখন পর্য্যন্ত আই এম এফ এর কাছে কোন অর্থ সহায়তা চায় নি। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের এমেন মন্তব্যের তিনদিন পর গত রবিবার আই এম এফকে সরকারের পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানিয়েছে ওই মন্ত্রী। মূলত: অর্থ মন্ত্রী ব্যালান্স অব পেমেন্ট ও বাজেট সহায়তা হিসেবে এ অর্থ চেয়েছেন। এ ছাড়াও বাংলাদেশের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমানোর বিষয়টিকেও কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে নথিতে। রোববার আই এম এফ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিষ্টালিনা জর্জি তার কাছে চিঠি পাঠিয়ে ঋনের অনুরোধ জানানো হয়।

আই এম এফ এর কাছে সরকারের চিঠি পাঠানোর পর কবে মিলবে ওই ঋণ বা ঋণ পেতে কি কি করতে হবে এসব প্রশ্ন সামনে চলে আসছে। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, আবেদন দিলেও ঋণ পেতে অনেক অপেক্ষা করতে হবে বাংলাদেশকে। এ বিষয়ে আই এম এফ এর শীর্ষ কর্মকর্তাও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনষ্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এই মনসুর সাংবাদিকদেরকে বলেন, “প্রথমত: বিষয় হচ্ছে, সরকার আইএমএফ এর ঋণ নিতে অকেটাই লুকোচুরি করেছে। কারণ কয়েকদিন আগে যখন আইএমএফ প্রতিনিধিদল ঢাকা সফরে আসে, তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, আইএমএফ থেকে এখনই ঋণ নিতে চায় না বাংলাদেশ। অথচ ভেতরে ভেতের ঋণ চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে আইএমএফকে। আমার কথা হচ্ছে, ঋণ নিতে এত লুকোচুরি কেন? তিনি মুখে বললেন এক কথা, কাজ করলেন আর এক রকম। আমার মনে হয় সরকার ঋণ নেওয়র বিষয়টি ওপেন বলতে চাচ্ছে না কিন্তু এসব বিষয় তো চাপা থাকে না।”

আই.এম এফ এর ঋণ পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, সবে আবেদন পাঠানো হয়েছে, ঋণ পাওয়ার বিষয় অনেক পরে। আগে দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনা হবে। আলোচনার জন্য সরকার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সে ব্যাপারে আই এমএফকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আশা করা যায়, এমন খুব অল্প দিনের মধ্যে আই এম এফ এর একটি প্রতিনিধিদল বালাদেশে আসবে। হয়তো কয়েকদিন আগে যারা ঘুরে গেলেন তারাই আসবেন। তাদের সঙ্গে শর্তসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হবে। আলোচনা ফলপ্রসূ হলে ঋণের জন্য ফরমাল চিঠি দিতে হবে। এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তবেই মিলবে ঋণ।

এদিকে আই এম এফ এর কাছে ঋণ চেয়ে আবেদন করার বিষয়টি প্রকাশ পাওয়ার পর গতকাল বুধবার আবারও কথা বলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এদিন ক্রয় কমিটির বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আই এম এফ এর কাছে ঋণ চেয়েছি তার মানে এই নয় যে দেশের অর্থনীতি বড় সংকটে আছে। তিনি বলেন, আমরা আই এম এফ এর কাছে ঋণ চেয়েছি কিন্তু কোন এমাউন্ট উল্লেখ করি নি।”

অর্থমন্ত্রী বলেন, আমরা কোন এ্যামাউন্ট উল্লেখ করি নি।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছেত, আইএমএফকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ্যপণ্য, মূলধনী যন্ত্রপাতি এবং শিল্পের কাঁচামালেরও দাম বেড়েছে অনেক। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পরিবহন সহ অন্যান্য খরচও বেড়েছে ব্যাপক হারে। এ বছরের মে মাসে বাণ্যিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ২, ৮২৩ কোটি ডলারে।

এভাবে যে যে খাতে অর্থনীতি কম-বেশী সংকটে পড়েছে, বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, করোনা জনিত সংকট-সবই উল্লেখ করা হয়।

অর্থাৎ বিদেশীরা কিন্তকু নানাভাবেই দেশের সমস্যা-সংকট সম্পর্কে অবহিত। তদুপরি তাদেরা কাছে ও দাতা সংস্থা সমূহের কাছে যখন ঋণের তাগিদ দেওয়া হয়-তখন তো চিঠিপত্র এবং মেখিক আলাপ-আলোচোনার মাধ্যমেই তারা আমাদের অর্থনীতি সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবেই অবহিত হতে পারছে।

এই যেখানে পরিস্থিতি তখন এ ব্যাপারে কোন সমালোচনা হলে তৎক্ষণাৎ সরকারি নেতা-মন্ত্রী-এমপি বা তার বা তাঁদের উপর হামলে পড়ার কোনই যুক্তি সঙ্গত কারণ দেখি না। বস্তুত গণতন্ত্রে বিম্বাসী কোন মহলই তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখাবে এমন কোন কিছু আদৌ কাম্য নয়।

বরং সরকারের উচিত সকল রাজনৈতিক দল, অর্থনীতি সংক্রান্ত সংগঠন ও সুশীল সমাজ, বিশেষ করে সাংবাদিক সমাজকে ডেকে আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিকভাবে মত বিনিময় করে দেশের অর্থনীতির বিরাজমান সংকট মোকাবিলার পথ খুঁজে বের করা এবং সে অনুযায়ী সরকারি কার্যক্রম গ্রহণ করা।

এ প্রসঙ্গে আরও বলা যায়, দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রমাসনিক এবং সংশ্লিষ্ট অপরাপর বিষয়ে পুংখানুপুংখ সকল তথাদি জানতে বাংলাদেশের সকল নাগরিক সমভাবে অধিকারী। তাই কোন গুজব বা প্রচারণাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য না করে জনগণের সামনে নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে প্রকৃত পরিস্থিতির বিবরণী অত্যন্ত স্বচ্ছলতার সাথে গণমাধ্যম সমূহের মাধ্যমে তুলে ধরা উচিত। এই বা এ জাতীয় পদক্ষেপ অধিকতর বিশ্বাস যোগ্যতা অর্জন করে মানুষের মনে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করবে।

আপাতত: দেশের সর্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করলে হয়তো জনগণ সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক অবহিত হতে পারবেন এবং এভাবেই যে কোন সন্দেহভাজন মহলের অপপ্রচার বা গুজব ছাড়ানোর মাধ্যমে কোন হীন উদ্দেশ্য সফল করার উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)