‘যারা ৭১ এ শিশু ছিলো তারাই তরুণ হয়ে ঘাতকদের ঘৃণা জানালো ১৯৯২ সালে আবার যারা ৯২’তে শিশু ছিলো তারাই ২০১৩ সালে পরিণত দেশপ্রেমে তারুণ্যের দুর্বার শক্তিতে জেগে উঠলো শাহবাগে। আসলে গোটা বিষয়টা রিলে রেসের মতো। দেশপ্রেম এবং চেতনার-অস্তিত্বের এই রিলে রেসটা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চালিয়ে নেয়ার পেছনে মূল প্রেরণা শহীদ জননী জাহানারা ইমাম’।
শহীদ জননীর জন্মদিনে সাম্প্রতিক সময়ের প্রেক্ষিতে এভাবেই তাঁকে স্মরণ করেন জননীর স্নেহসান্নিধ্য-ধন্য সাংবাদিক জুলফিকার আলি মাণিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি নৃশংসতার জীবন্ত সাক্ষী ‘অ্যানি ফ্রাঙ্কের ডায়েরি’র মতোই ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে সংগ্রাম-ত্যাগের সাক্ষ্য দেয় জননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’। বই প্রকাশ করেই দায়িত্ব শেষ মনে না করে ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চে নজীরবিহীন গণ-আদালতে যুদ্ধাপরাধী-শিরোমণি গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার করে দেশব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পুনর্জাগরণ ঘটান জাহানারা ইমাম। এর কয়েকদিন পরই তাঁর সঙ্গে কাজ করার ডাক পান দেশাত্মবোধে উজ্জীবিত তৎকালীন জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ‘প্রিয়প্রজন্ম’ পত্রিকার তরুণ সাংবাদিক মাণিক। খুব কাছ থেকে শহীদ জননীকে দেখা সেই তরুণ সাংবাদিকের আজকের অভিজ্ঞ চোখে তাই ৭১, ৯২ এবং ২০১৩ একটি ‘রিলে রেস’ কিংবা মশাল দৌড়।
শহীদ জননীর ৮৮ তম জন্মদিনে চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে সেই সময়ে দেখা শহীদ জননীর ব্যক্তি জীবন, সাংগঠনিক সক্ষমতা এবং শহীদ রুমীর জননী থেকে মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী পুরো প্রজন্মের জননী হয়ে যাওয়াসহ নানাদিক তুলে ধরেছেন সাংবাদিক জুলফিকার আলি মাণিক। তার জন্মদাত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসার জন্মও একইদিনে। কেমন দেখেছেন শহীদ জননীকে? এমন প্রশ্নের জবাবে মাণিকের এক কথায় উত্তর: ‘নিজের মায়ের মতো’। লেখালেখির কাজে জাহানারা ইমামের বাড়ি ‘কণিকা’য় তখন সবেমাত্র গিয়েছেন মাণিক। সে বাড়িতে ইতোমধ্যে ‘মানিক’ নামের আরেকজন থাকায় তরুণ সাংবাদিক জুলফিকার আলি মাণিককে তাই ‘জুলফি’ নামে ডাকতেন শহীদ জননী।
সবার প্রতিই তাঁর মাতৃস্নেহের মায়া ছিলো জানিয়ে মাণিক বলেন,‘ তিনি তো শহীদ মুক্তিযোদ্ধার প্রতীকী জননী, সবাই তাঁকে ‘আম্মা’ বলে ডাকেন। গর্ভধারিণীকেই কেবল ‘আম্মা’ বলে ডাকি আমি, সেখানে উনাকে কী করে ডাকব? তবে, ইতস্তত ভাবটা মোটেই স্থায়ী হলো না, জাহানারা ইমাম গর্ভধারিণী মায়ের মতোই আমাকে স্নেহ, মমতা, শাসন, আদেশ, উপদেশ দিয়ে আপন করে নিলেন এমনভাবে, যেন আমিও তাঁর সন্তান। আমি অবলীলায় জাহানারা ইমামকে আম্মা বলে ডাকতে শুরু করে দিলাম। আমি আজ পর্যন্ত দুজন মানুষকেই ‘আম্মা’ হিসেবে সম্বোধন করেছি, একজন আমার গর্ভধারিণী মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা, আরেকজন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। আর কাকতালীয়ভাবে তাঁদের দুজনেরই জন্মদিন একই দিনে, অর্থাৎ ৩ মে’। মায়ের নরম মন অথচ ৭১’এ আদরের রুমীকে হারিয়ে যেনো কোমল-কঠোরের মিশ্র মানুষে পরিণত হয়েছিলেন জাহানারা ইমাম।
শহীদ জননীর এই দ্বিমূর্তি নিয়ে জুলফিকার আলি মাণিক বলেন,‘ ৭১’এ ছেলে হারানো,স্বামী হারানো মানুষটির শরীরে বাসা বাঁধে মরণব্যাধী ক্যান্সার। অথচ কী আশ্চর্য প্রাণ শক্তি নিয়ে লড়াই করেছেন শরীরের ক্যান্সার আর বাংলাদেশের ‘ক্যান্সার’ যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে। কোনোদিন তাঁর মধ্যে ক্লান্তি দেখিনি, হতাশ হতেও দেখিনি তাকে। তৎকালীন প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তিনি কোনোরকম অতীত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছাড়াই ঠাণ্ডা মাথায় বিষবৃক্ষের বীজ উপড়ানোর আন্দোলন চালিয়ে নিয়েছেন’।
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সাংগঠনিক সক্ষমতার বিষয়টি তুলে ধরে মাণিক আরও বলেন,‘ ব্যক্তিগত রাগ-ক্ষোভ তাকে আন্দোলন থেকে এতোটুকু বিচ্যুত করেনি।
তখনও এমন একটা সময় ছিলো যখন সাধারণ মানুষতো বটেই এমনকি আন্দোলনে সম্পৃক্ত অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেনি যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা সম্ভব হবে। এরপরও দমে যাননি শহীদ জননী, আত্মবিশ্বাসে তাঁর এতোটুকুও ফাটল দেখিনি। বরং তাঁর অটল বিশ্বাস ছিলো যে বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই’।
১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের আমির ঘোষণা করলে বাংলাদেশে জনবিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভের অংশ হিসেবে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয় জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে। তিনি হন এর আহ্বায়ক। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী প্রতিরোধ মঞ্চ, ১৪টি ছাত্র সংগঠন, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক জোট, শ্রমিক-কৃষক-নারী এবং সাংস্কৃতিক জোটসহ ৭০টি সংগঠনের সমন্বয়ে পরবর্তী সময় ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠিত হয়।
সর্বসম্মতিক্রমে এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। শহীদ জননী, কথাসাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ এবং একাত্তরের ঘাতক দালালবিরোধী আন্দোলনের অগ্রদূত জাহানারা ইমাম প্রাণঘাতী ক্যানসার নিয়ে লড়ে গেছেন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিপক্ষে।
অবশেষে ২৬ জুন ১৯৯৪ সালে ৬৫ বছর বয়সে মরণব্যাধি ক্যানসারের কাছে পরাজয় স্বীকার করেন লাখো বাঙালির মা জাহানারা ইমাম। আজ জননী নেই কিন্তু তাঁর শুরু করে যাওয়া লড়াই আজও চলছে।