তিনি কখনও কবিতা লিখেননি অথবা লিখলেও জানা নেই। তবু তিনি ‘রাজনীতির কবি’ ছিলেন। রাজনীতি আর দেশ নিয়ে যার নিত্যভাবনা তাঁকে কবি স্বীকৃতি না দেয়ার শক্তি কারও নেই। পারেনি তাও। তাই স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করার পৃথিবীর পবিত্রতম উদ্যান রেসকোর্সে লিখিত হয়েছিল অমর অবিনশ্বর সে কাব্য যার মাধ্যমে পরাধীনতা আর শৃঙ্খলে ন্যুজ বাঙালি জেগে ওঠেছিল। ঘোষিত হয়েছিল পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে অমর বাক্য আর নির্দেশনা – ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।… রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো, এদেশের মাটিকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ’।
এই প্রজন্মের কেউ সে উত্তাপ, সে উত্তেজনা আর দিক নির্দেশনা ধারণ-অনুধাবন করতে পারবে না হয়ত। কিন্তু তার কিছু উত্তাপ, উপস্থাপনা বজ্রকন্ঠ ধারিত ভাষণ অনুধাবন করতে পারে নির্মলেন্দু গুণ’র কবিতার মাধ্যমে। যেখানে কবি বর্ণনা করেছিলেন রেসকোর্স, বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সে পরিবেশ।
কবিতায় নির্মলেন্দু গুণ লিখেন- “একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য কি দারুণ অপেক্ষা আর উত্তেজনা নিয়ে লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে ভোর থেকে, জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে: ‘কখন আসবে কবি’?…. শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মত দৃপ্ত পায়ে হেঁটে অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন…. কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী? গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।”
কবির সে কবিতা ইতিহাসের এক দলিল, এক জীবন্ত সাক্ষী হয়ে সাক্ষ্য দিয়ে যাচ্ছে অহর্নিশ। জনসমুদ্রের ব্যাকুলতায় কবি যখন লিখেন ‘কখন আসবে কবি’ তখন ভাষণের ৪৭তম বার্ষিকীতেও টের পাই এক ঠাণ্ডাস্রোত; যে স্রোতে নিজেকেও হাজির করি রেসকোর্সে। আর ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বাক্যের প্রতি শব্দে টের পাই উত্তেজনার বারুদ, এই সাড়ে চার দশকের বেশি সময় পরেও। ‘সেই থেকে স্বাধীনতা আমাদের’- বাক্যে যেন পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার এক ভবিষ্যৎ পাঠ।
৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘…এরপর যদি একটি গুলি চলে, এরপর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয় – তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। …আমি যদি তোমাদের হুকুম দেবার না-ও পারি তোমরা সব বন্ধ করে দেবে। …রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব। তবু এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’
স্বাধীনতার জন্য সারাদেশ থেকে ছুটে আসা ব্যাকুল মানুষ দিশে পায় ওই ভাষণে, চূড়ান্ত যুদ্ধের দিকে ধাবিত হওয়ার প্রেরণা পায় মাত্র ১৯ মিনিটের অমর কবিতায়, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণে। বিশ্বের ইতিহাসে রাজনৈতিক নেতার স্বাধীনতার ঘোষণা পূর্ব এই ধরনের ভাষণ দেয়ার নজির নেই।
যে দীর্ঘ মুক্তিসংগ্রামের পথ পরিক্রমায় বাংলাদেশ ক্রমে ধাবিত হচ্ছিল স্বাধীনতার দিকে, সে মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। উত্তাল মার্চের পুরোটা সময় স্বাধীনতার পথ দেখিয়ে গিয়েছিলেন; এমনকি ২৬ মার্চ রাতে গ্রেপ্তারের পূর্ব মুহূর্তেও দিয়ে যান স্বাধীনতার ঘোষণা। ৭ মার্চের ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দিক ইঙ্গিত করে দিয়ে ২৬ মার্চের ঘোষণা দিয়ে তিনি তাঁর দূরদর্শিতার যে নজির রেখেছেন সেটা অনন্য। তাই ৭ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস না হয়ে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস বাংলাদেশের।
বাংলাদেশের অতি-উৎসাহী অনেকেই স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত ভুল করে থাকেন, কিন্তু ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা দেননি। এই তারিখে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হলে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধকালীন বৈশ্বিক সমর্থন পেত না, এটাকে গৃহযুদ্ধ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে পাকিস্তানসহ তাদের মিত্র দেশগুলো প্রমাণ করে ছাড়ত। ভাষণের দিনের সকালেই পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ধানমণ্ডির বত্রিশ নম্বরে সাক্ষাত করেন। স্বল্প সময়ের ওই বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ওয়াশিংটনের সিদ্ধান্তের কথা বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে বলেন- ‘পূর্ববাংলায় স্বঘোষিত স্বাধীনতা হলে যুক্তরাষ্ট্র তা সমর্থন করবে না।’ শেখ মুজিব সেটা ভালভাবেই উপলব্ধি করতেন বলেই তাঁর অলিখিত ভাষণের প্রতি শব্দ-বাক্য উচ্চারণে ছিলেন সজাগ-সতর্ক। খানিক আবেগে বশ না হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় তাঁর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা জানিয়েছিলেন অকপটে। জাতির জনক কেবল বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্যেই আন্দোলন করেন নি, একই সঙ্গে করেছেন বিশ্বরাজনীতির অনুশীলন, যা তাঁর দেয়া ভাষণে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ এবং দিকনির্দেশনা একটি দেশকে নিয়ে গিয়েছিল মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি মুক্তিযুদ্ধের দিকে। একাত্তরের বাংলাদেশে সেই মহাকাব্য দিয়েছিল মুক্তির পথ। সে ভাষণের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও মিলেছে এবার। বিশ্ব ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে এ ভাষণ। লেখক ও ইতিহাসবিদ জ্যাকব এফ ফিল্ডের বিশ্বসেরা ভাষণ নিয়ে লেখা ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস: দ্য স্পিচ দ্যাট ইনস্পায়ার্ড হিস্টোরি’ গ্রন্থেও স্থান পেয়েছে এ ভাষণ।
৭ মার্চ দেশব্যাপী বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে প্রচার হয়ে থাকে এ ভাষণ। কেবল এ দিনটিই নয়, বিভিন্ন জাতীয় দিবসেও এ ভাষণ প্রচার হয়ে থাকে, এমনকি ২১ ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানেও ভাষণ প্রচার করেন অনেকেই। ফলে ধারণা করাই যায় প্রচারকদের অধিকাংশই ভাষণের মর্মার্থের দিকে খুব বেশি মনোযোগী নয়। এটা স্রেফ ভাষণের রেকর্ড প্রচার, বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণের ব্যাপারটা এখানে গৌণ।
বঙ্গবন্ধু সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে উঠেছিলেন তাঁর নেতৃত্বগুণ ও দেশের প্রতি ভালোবাসার কারণে। কিন্তু তাঁর দলের লোকজন ও অনুসারীদের অনেকেই যতটা বঙ্গবন্ধুর নাম-জপ করতে আগ্রহী ঠিক ততটা তাঁর আদর্শ প্রচার ও ধারণে নন। দেশের জন্যে জীবন-যৌবন ব্যয় করে দেয়া এ নেতা আজীবন দেশের প্রতি থেকেছেন একাত্ম। যুদ্ধাপরাধী ও তাদের সংগঠন জামায়াতের প্রতি ছিলেন পরিষ্কারভাবে কঠোর। দেশে ফিরেই রেসকোর্সে দেয়া বক্তৃতায় যুদ্ধবন্দি ও দালালদের বিচারের ঘোষণা দিয়েছিলেন বিজয়ের পর পরই। বাহাত্তরের ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের দিন এই ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন। এরপর খুলনায় এক জনসভায় বলেছিলেন- কেউ দালালদের জন্যে সুপারিশ করলে তাকেও দালাল সাব্যস্ত করা হবে। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানের পক্ষে বিবৃতিদাতা, পাকিস্তান সরকারে যোগদানকারী, আত্মসমর্পণকারী ২৩ জন গণপরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যকে দল থেকে বহিস্কারও করেছিলেন। আবার তিনি সোহরাওয়ার্দীতে ঘোষণাও করেছিলেন- এই মাটিতে গণহত্যার বিচার অবশ্যই হবে।
বঙ্গবন্ধু তাঁর কথা রাখতে শুরু করেছিলেন। ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ দালাল আইন (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশ ১৯৭২ জারি করা হয়। ১৯৭৩ সালের ২৪ জানুয়ারি জারি হয় ‘দি ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনাল) অ্যাক্ট-১৯৭৩’। বাহাত্তরের দালাল আইনে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগীদের বিচারের জন্য সর্বমোট ৭৩টি ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশ থেকে ৩৭,৪৭১ জনকে গ্রেপ্তার করে ২৮৪৮ মামলা নিষ্পত্তি হয়। ফাঁসির দণ্ড হয় ১৯ জনের এবং বিভিন্ন মেয়াদের দণ্ড পায় ৭৫২ জন।
বাংলাদেশে বর্তমানে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার চলছে। বিচারের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠলেও সেটা করছে না সরকার। উল্টো বিভিন্ন অজুহাতে দলটিকে নিষিদ্ধ করাসহ দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার করছে না। যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত এই দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে যোগাযোগ করে আওয়ামী লীগেও যোগ দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্যও হয়ে যাচ্ছেন জামায়াত নেতাদের কেউ কেউ। তাদের পরিবারের সদস্যরাও আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতৃত্বে আসছেন। সারাজীবন আওয়ামী লীগ করে আসা নেতাকর্মীদের চাইতে তারা আরও উচ্চকণ্ঠে বলছেন ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’; কিন্তু এই স্লোগান দিয়ে কি তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে গ্রহণ করছেন? করছেন না। এই দলবদল, স্লোগান প্রকৃতপক্ষে বাহ্যিক আবরণ, ভেতরে নেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সামান্য লেশ। ফলে যতলোক আওয়ামী লীগের বলে দৃশ্যমান ঠিক তত লোক বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করার অবস্থায় নেই।
বাঙালির জীবনের সবচেয়ে বড় আরাধনা, উপাসনা, আকাঙ্ক্ষার প্রতীক মুক্তি সংক্রান্ত বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যগুলো। ৭ মার্চ, ১৯৭১ আর বঙ্গবন্ধু তাই মিলেমিশে একাকার দেশপ্রেমিক বাংলাদেশি বাঙালির কাছে। ৭ মার্চ, ১৭ মার্চ, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর, ১০ জানুয়ারি আসে, আসবে, যাবে! বঙ্গবন্ধু কি থেকে যাবেন শুধু দিবসী আয়োজন আর উপলক্ষে? ভাষণ প্রচার আর দিবসী আয়োজন বাদ দিয়ে আসুন তাঁর আদর্শ আর চেতনা বাস্তবায়নের পথে এগোই।
রাজাকার আর জামায়াত-শিবিরযুক্ত বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাংলাদেশ নয়। কেবল ভাষণ প্রচার দিয়েই বঙ্গবন্ধুকে সম্মান জানানো যাবে না। নেতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন তখনই হবে যখন ভাষণ প্রচারের চাইতে তাঁর আদর্শই হবে মুখ্য।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)