ভাদ্র ও আশ্বিন এই দুই মাসকে আমরা শরৎকাল বলে থাকি। শরৎ মানে ঋতুর রানী, রূপের সমারোহ, সোনা রঙের সূর্যালোকে মুগ্ধ করা মোহ। দূর নীলিমায় সাদা মেঘের উদ্ভাসিত মেলা, মাঠে-ঘাটে কাশফুলেরা দোলে সারাবেলা। শাপলা, পদ্মা, শিউলী আর কামিনী, জুঁই ফুলে বাংলার রূপ অপরূপ হয়ে উঠে মায়াবী তুলতুলে। এই শরৎকালের ভাদ্র মাসে সমতলের আদিবাসীরা মেতে উঠে কারাম উৎসবে।
সারা মাস ধরে চলে নাচ গান। ভাদ্র মাসের একাদশী ও ভরা পূর্নিমায় কারাম উৎসব পালিত হয়, যদিও নির্দিষ্ট কোন তারিখ নির্ধারণ করা নেই এই উৎসবকে ঘিরে। তারিখ নির্ধারণ হয় চাঁদের উপরে এবং এভাবেই আদিবাসীরা কারাম উৎসব পালন করে থাকে। উৎসবটি ভাদ্র একাদশীতে ও পূর্নিমায় হয় বলে “ভাদই” কারাম পরব ও একাদশী কারাম পরব নামে অভিহিত করা হয়।
কারাম উৎসব মানেই বৃক্ষ পূজা। অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে বৃক্ষকে রক্ষা-কর্তা হিসেবে কারাম উৎসব পালন করা হয়ে থাকে। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে আদিবাসী সমাজের কিশোর কিশোরী, যুবক-যুবতী ও নারী-পুরুষ হয়ে উঠে নৃত্যচঞ্চল ও সঙ্গীতমুখর।
আগে উত্তরবঙ্গের প্রায় সকল আদিবাসী গ্রামেই কারাম পরব পালন করা হত। তবে দিন দিন নানা কারণে কারাম পরব তার নিজস্ব সত্ত্বা হারিয়ে ফেলছে। উত্তরবঙ্গের আদিবাসীরা নানান আয়োজনে কারাম উৎসবটি পালন করে থাকেন। গ্রামের দশজন মিলে যখন ভাদ্রের একাদশীতে কারাম করা হয় তখন তাকে “দশওয়ালী” কারাম বলে। পারিবারিক ও ব্যক্তিগতভাবে আয়োজিত কারাম “আপন” কারাম নামে অভিহিত ও পরিচিত। ভাদ্র মাসের একাদশী থেকে পূর্নিমা পর্যন্ত আয়োজিত কারামই হলো “ভাদই” কারাম। এটি দশে মিলে করা হয় বলে দাশ (দশ) কারাম নামেও পরিচিত। শারদীয় দূর্গাপূজার সময় আদিবাসীরা দশমীতে আয়োজন করেন “দশই” কারাম। ঢোল, মাদল, নাগরা (টামাক), ঝাঁঝর-জুড়ি এগুলো বাজিয়ে আদিবাসী নারী পুরুষেরা কারাম তথা ঝুমুর নাচের আয়োজন করেন। ভাদ্র মাসের অন্ধকারে (আমাবস্যা) তিথীতে “জিতিয়া” কারাম করা হয়।এতে সাতটি ঘীয়ের বাতি লাগে। তবে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ আদিবাসীরা কারাম করেন ভাদ্র মাসে।
কারাম গাছকে কেন্দ্র করে কারাম উৎসবের আয়োজন। প্রতিটি আদিবাসী গ্রামের এক বৈশিষ্ট্যময়ী দৃশ্য হলো কারাম বৃক্ষ। পবিত্র এই গাছকে কারাম পরবের মধ্য দিয়েই আদিবাসী নারী পুরুষেরা যুগ যুগ ধরে বাঁচিয়ে রাখেন। পূর্বে প্রায় সকল আদিবাসী গ্রামগুলোতেই বাড়ি বাড়ি কারাম গাছ ছিল। এখন অনেক গ্রামেই কারাম গাছ নেই। ভাদ্র মাসে এর গাছ ভর্তি কদমের মত রোয়া ওঠা এক ধরনের হলুদ রঙের ফুল থাকে। আদিবাসী গ্রাম ছাড়া প্রাকৃতিক বনে এই গাছ একেবারেই বিলুপ্ত।
কারাম পরব পালনের ক্ষেত্রে এলাকাভেদে কিছু মিল-অমিল দেখা যায়। কারাম উৎসবের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এর প্রকৃতি ও পরিবেশ ঘনিষ্ঠতা। কারাম পার্বনের জন্য কারাম গাছ, গাঁদা ফুল, যব-খান সরিষাসহ নানান শস্য, ফসলের বীজ, সাদা শাপলা ফুলের প্রয়োজন হয়। শসা, হলুদ, দূর্বাঘাস, আতব চাল, ধুপ দিয়ার প্রয়োজন হয়। একাদশী বা পূর্নিমার রাতে কারাম ডালটি মাটিতে পুঁতা হয়। এরপর শুরু হয় গীত-বাদ্য, নাচ, গান।
এ উৎসব বা পরবের একটি ঐতিহ্যের প্রতি সকল আদিবাসীদের সজাগ হতে হবে। তবে বিভিন্ন সংগঠন, এনজিও ও সরকারের সজাগ দৃষ্টি থাকলে আদিবাসীরা ও তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে সফল হবে।