সরকার জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতস্বরূপ ১৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠানকে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’-২০১৭ প্রদানের জন্য চূড়ান্তভাবে মনোনীত করেছে। এর মধ্যে সাহিত্যে রাবেয়া খাতুন ও মরহুম গোলাম সামদানী কোরায়শীকে মনোনীত করা হয়েছে। মরহুম গোলাম সামদানী মৃত্যুর প্রায় ২৬ বছর পর এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হলেন। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাস্টাস দিয়েছেন লেখক ও গবেষক চিররঞ্জন সরকার।
স্ট্যাটাসে তিনি সরকার ও সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ দিয়েছেন। তিনি মনে করছেন এই স্বীকৃতির মাধ্যমে স্বাধীনতা পুরস্কারকেই যেন নতুনভাবে সম্মানিত করা হলো।
চিররঞ্জন সরকার স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘সংকীর্ণ ধর্মবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, কূপমণ্ডুকতা যখন সমাজকে ভীষণভাবে খাবলে ধরেছে, তখন গোলাম সামদানী কোরায়শীর মতো প্রকৃত একজন মুক্তচিন্তার মানুষকে এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত করাকে আমার কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে। এ জন্য সংশ্লিষ্টদের জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ।
অধ্যাপক গোলাম সামদানী কোরায়শী বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ইতিহাসবিদ, গবেষক, অনুবাদক এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। আমৃত্যু ময়ময়মনসিংহে বাস করা এই ব্যক্তিটি ছিলেন মুক্তচিন্তাজগতের এক অসামান্য ব্যক্তিত্ব। নীতি-নৈতিকতার পাশাপাশি একটি আদর্শ মানব দর্শনের অধিকারী ছিলেন গোলাম সামদানী কোরায়শী। চাকরিসূত্রে দুই বছর ময়মনসিংহে থাকার কারণে যে দুই জন আদর্শ ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পারি, তাঁদের একজন গোলাম সামদানী কোরায়শী। অপরজন অধ্যাপক যতীন সরকার। দুজনেই ছিলেন একই আদর্শের অনুসারী এবং হরিহর আত্মা। তাঁরা দুজনেই ‘সপ্তগুরু’র অনুসারী ছিলেন। এই গুরুগণ হলেন যথাক্রমে সক্রেটিস, শ্রীকৃষ্ণ, গৌতম বুদ্ধ, যিশুখ্রিস্ট, হজরত মুহাম্মদ (সা.), কার্ল মার্কস এবং নিজের পিতা।
কর্মময় জীবন ছিল অধ্যাপক গোলাম সামদানী কোরায়শীর। রেখে গেছেন বিশাল সাহিত্য সম্ভার। মৌলিক রচনার পাশাপাশি অনুবাদ ও সম্পাদনার পরিমাণও বিশাল।
১৯৬১ সালে ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লার আহ্বানে সাড়া দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান প্রকল্পে বাংলা একাডেমির ড. শহীদুল্লার সহযোগী হন। অভিধান প্রকল্পের পাশাপাশি তিনি অনুবাদকর্মেও মনোনিবেশ করেন। ১৯৬৫ সাল থেকে আরবি, ফারসি, উর্দু, ইংরেজি বিভিন্ন ভাষার বহু মৌলিক গ্রন্থ অনুবাদ করেন তিনি।
তাঁর অনূদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে কালিলা ও দিমনা, আইন-আদালতের ভাষা আরবি-ফার্সি শব্দ (মূল ইংরেজি), অশাস্ত্রীয় পুরাণ (মূল সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়), শব্দাদর্শ অধ্যয়ন (মূল মুহম্মদ ওবায়দুল্লাহ), তারিখ-ই-ফিরোজশাহী, তোহফা (মূল ফার্সি) প্রভৃতি।
এ ছাড়া বহু অনুবাদ এবং মৌলিক সৃজনশীল সাহিত্যকর্মের নিদর্শন রেখে যান তিনি। ১৯৮১-৮২ সালে বিখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ইবনে খলদুনের আল মোকাদ্দিমা বাংলা একাডেমি থেকে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হওয়ার পর সাড়া পড়ে। তিনি ইবনে খলদুনের জীবনীগ্রন্থসহ ২৪টি গ্রন্থের অনুবাদক।
তাঁর লেখা উপন্যাস গুলো হলো: স্বর্গীয় অশ্রু, পুত্রোৎসর্গ, মহাপ্লাবন, চন্দ্রাতপ (এগুলো তাঁর সেমেটিক মিথলজিভিত্তিক রচনা)।
গল্প ও গল্প সংকলন: শ্রী গোলের আত্মকাহিনী, লেখার দোকান, কালকেতু উপাখ্যান, কারূণের উট, শাদ্দাদের বেহেস্ত, কাল নাগিনী, কোরবাণী, দুর্ভিক্ষ, কল্পনা ও বাস্তব, এক যে ছিল কুল গাছ, একুশের কড়চা, কান্না, শয়তানের দোকান, জ্ঞানের ঘাট, বাঁশী, জায়দার বাপের বেহেস্ত, হজ্জ্ব, অভিনেত্রী, ভাগ্যরেখা, রক্ত চোষার ফরিয়াদ, থার্ড ক্লাশ, বিসমিল্লাহ, বিশ্বাসঘাতকতা, সাধু, দাদা, আদি, অভিসার, নরম গরম, দুই ভাই, দুই বোন, দুই মা, দুই বন্ধু, গল্প শুনো, মেঘলা রাতের কাব্য, বুড়া ঘুমালো পাড়া জুড়ালো, তিন দিন তিন রাত প্রভৃতি।
নাটক: টুপিচোর, আমাদের দেশ (নাটিকা), গাধার কলজে, সাতটি নকশা, সাপের ছোবল, উটের মাংস।
কবিতা ও কবিতা সংকলন: খেয়ালের ঝুলি, দুর্ঘটনা, উটকোর জিভ, বাদশাজাদা ও গল্পিকা (কিশোর কবিতা সংকলন), মানুষ (১২টি সনেটের সংকলন)।
তাঁর অনেক রচনাই রয়েছে অসম্পূর্ণ ও অপ্রকাশিত। এগুলো প্রকাশিত হলে নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডার আরও সমৃদ্ধ হবে। বাংলা একাডেমি এই দায়িত্বটি পালন করতে পারে। আপাদমস্তক মানবাতবাদী ও মুক্তচিন্তার অধিকারী এই মানুষটি জীবনের শেষ পর্বে এসে কমিউনিস্ট পার্টির কাজের সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। অসাম্প্রদায়িক চেতনার মহান ব্যক্তিত্ব গোলাম সামদানী কোরায়শী ১৯৯১ সালের ১১ অক্টোবর ময়মনসিংহেই মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর এত বছর পর তাঁকে পুরস্কৃত করে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ যেন নতুনভাবে সম্মানিত হলো!