চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

সেই উচ্চকিত কণ্ঠস্বরটি যেন পুরুষেরই হয়

আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বিশ্বে নারীদের অবস্থান বিষয়ে ফেসবুকে লিখেছেন জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ সেলিম জাহান। বৈষম্যের শিকার নারীদের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে তিনি বলেছেন, নারীর প্রকৃত অগ্রগতি চাইলে সেজন্য উচ্চকিত কণ্ঠস্বরটি পুরুষেরই হতে হবে।

ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন: “আজ ৮ই মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এ বছর অর্থাৎ ২০১৮তে এ দিবসের মূল বাণী হচ্ছে- ‘অগ্রগতির জন্য চাপ দিন’। জোরালো বক্তব্য, সন্দেহ নেই। মূল বাণীতে অবশ্য দু’টো শব্দ লক্ষ্যনীয়- ‘অগ্রগতি’ ও ‘চাপ’।

নারীর সক্ষমতা ও সুযোগের ক্ষেত্রে বৈশ্বিকভাবে এবং বিভিন্ন দেশে অনেক ‘অগ্রগতি’ হয়েছে নি:সন্দেহে, কিন্তু সমতা এবং ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বহু মৌলিক জায়গায় নারীর বঞ্চনা এখনও বিদ্যমান। তেমনিভাবে বহুবিধ রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দেলনের ফলে নানান পরিবর্তন এসেছে মানি, কিন্তু সে সব অর্জন সংহত করা এবং মৌলিক পরিবর্তনের জন্য ‘চাপ’ অব্যাহত রাখতে হবে।

এ সবই সত্যি। কিন্তু তবু আমি সবসময়েই বলি যে, ‘নারীর জীবনের বহু বাস্তবতা পুরুষের কর্মকাণ্ড দ্বারা নির্ণীত হয়’। নারীর ‘অগ্রগতি’ ও ‘চাপের’ ক্ষেত্রে এ সাধারন কথাটির দ্যোতনা এবং ব্যঞ্জনা ব্যাপক।

শিশুকাল থেকেই শুরু করা যাক না। শুধুমাত্র মেয়ে বলে পুত্রের চেয়ে পড়াশোনায় ভালো কন্যাটিকে বিদ্যালয় থেকে ছাড়িয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন যে মানুষটি, তিনি একজন পুরুষ- কন্যাটির পিতা। আজ সারা বিশ্বে যে ১৩ কোটি বালিকা বিদ্যালয়ে যায় না, তার পেছনে পুরুষের কর্মকাণ্ড একটি বড় কারণ।

আবার প্রতিবছর সারা বিশ্বে আঠারো বছরের অনূর্ধ্ব যে ১ কোটি ৫০ লক্ষ মেয়ে বালিকা বধূতে পরিণত হচ্ছে। বর্তমানে পৃথিবীতে ২০ কোটি নারী মধ্যযুগীয় বর্বর ‘যৌনাঙ্গ বৈকল্যকরন’ প্রথার শিকার হয়ে বেঁচে আছেন। প্রতি বছর ৫ হাজার নারী তথাকথিত ‘সম্মান হত্যার’ কারণে তাদের অতি প্রিয় পিতা বা ভ্রাতার হাতে জীবন দিচ্ছেন। বৈশ্বিকভাবে, প্রতি ৩ জন নারীর ১ জন ‘গৃহাভ্যন্তরীন সহিংসতার’ শিকার। এসবই তো এক বা একাধিক পুরুষ – পিতা, ভ্রাতা বা জীবনসঙ্গীর সিদ্ধান্ত বা কর্মকাণ্ডের ফলশ্রুতি।

পুরুষের এ সব সিদ্ধান্ত এবং কর্মকাণ্ডের ফলে নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, তার সক্ষমতা বিঘ্নিত হচ্ছে, তার সম্ভাবনা সীমিত হচ্ছে এহং তার মানব উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।

পুরুষ প্রণীত আইনের চোখেও তো নারী ভিন্নতর ব্যবহার পাচ্ছে। এই একবিংশ শতাব্দীতেও জগতের ১৮টি দেশে স্বামীর অনুমতি ভিন্ন মহিলারা কাজ করতে পারেন না। বত্রিশটি দেশে পাসপোর্টের মতে সাধারণ একটি প্রমানপত্র পেতে নারীদের একটি অধিকতর জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বিশ্বের একাধিক দেশে মহিলাদের গাড়ী চালানোর মতো সাধারন কাজটি করার অধিকার নেই এবং কোন পুরুষ সঙ্গী ব্যতীত তাদের ঘরের বাইরে বেরুনোর অনুমতি নেই। পুরুষ নিয়ন্ত্রিত এ জাতীয় সমাজ কাঠামোতে তাঁরা ‘দ্বিতীয় শ্রেনীর’ নাগরিক মাত্র।

বহু দেশে তাদের ভোটাধিকার নেই, নির্বাচনে দাঁড়ানোতো দূরের কথা। আজও বিশ্বের নির্বাচিত সাংসদদের প্রতি ৪ জনের মধ্যে ১জন মাত্র মহিলা, যদিও বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী।

অর্থনৈতিক অঙ্গনেও পুরুষ নারীর সুযোগকে সীমিত করে দিয়েছে। উন্নয়নশীল বিশ্বে নারী যদিও কৃষিখাতের ৮০ শতাংশ কাজই করে, তবুও ১০ শতাংশের কম কৃষিজমির মালিক তারা। গৃহস্হালী বা সেবামূলক কাজের তিন-চতুর্থাংশই তাদের দ্বারা সম্পাদিত হয়। অর্থনীতিতে নারীর মজুরি অপ্রদেয় কাজের যদি যথার্থ মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে দক্ষিন আফ্রিকার জাতীয় আয় ১৫ শতাংশ বেড়ে যাবে। ভারতের ক্ষেত্রে তা বাড়বে ৩৯ শতাংশের মতো।

নারীর নেতৃত্ব যোগ্যতা স্বীকৃত ও প্রমানিত হলেও, ব্যবসার জগতে সর্বোচ্চ পদগুলোর মাত্র ৩২ শতাংশ নারীর দখলে। নারীদের মাথার ওপরে শুধু অচ্ছেদ্য শার্সির ছাদ নেই, তাদের চারপাশে আছে অপ্রতিরোধ্য শার্সির দেয়াল। সন্দেহ নেই যে এ ছাদ আর দেয়ালে কিছু ফাটল ধরেছে, কিন্তু তা এখনো ভেঙ্গে পড়েনি।

সত্যিকার অর্থে পুরুষের সিদ্ধান্ত এ কার্যকলাপ নারীকে একটি জীবনব্যাপী বঞ্চনার দিকে ঠেলে দেয়। এ বঞ্চনা শুরু হয় মেয়েদের জন্মেরও আগে এবং চলে আমৃত্যু। সব সমাজেই এ জীবনব্যাপী বঞ্চনা নারীজীবনের ধ্রুব সত্য – হেরফের শুধু মাত্রার। ভাবা যায়, বর্তমান ধারা যদি চলতে থাকে, তাহলে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক অঙ্গনেই নারী-পুরুষ সমতা নিশ্চয়তা বিধান করতে পূর্ব এশিয়ায় লাগবে ১১১ বছর, মধ্যপ্রাচ্যে ৩৫৬ বছর। আর দক্ষিন এশিয়ায়? সে লজ্জার কথা না বলাই ভালো।

সুতরাং আগামী কাল ‘অগ্রগতির জন্য চাপ দিন’ বলে যখন পৃথিবী সরব হবে, তখন সেই উচ্চকিত কণ্ঠস্বরটি যেন পুরুষেরই হয়, এবং সে চাপটা যেন পুরুষেরই ওপরেই পড়ে। কারন ঐ যে বলছিলাম, ‘নারীর জীবনের বহু বাস্তবতা পুরুষের কার্যকলাপই নির্ধারণ করে দেয়’। চূড়ান্ত বিচারে, নারীর অন্য কোন পরিচয় নয়, তার ‘মানুষ’ পরিচয়ই অগ্রগন্য।”