অস্ট্রেলিয়ায় ২০১৬ সালের ২ জুলাই অনুষ্ঠিত ফেডারেল নির্বাচনে আগের দিন দেশটির বহুল প্রচারিত ইংরেজী দৈনিকহেডলাইন করে “Political deadlock set to last for weeks”. তাই রাজনৈতিক মহলের হতাশা ও অনিশ্চয়তার মেয়াদ যেন আরও বেড়ে গেল।
যদিও শেষ অবধি প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যাচ্ছে বিল সর্টেনেরনেতৃত্বাধীন অষ্ট্রেলিয়ান লেবর পার্টি এই নির্বাচনে ২০১৩ সালের নির্বাচনী ফলাফলের তুলনায় যথেষ্ট ভাল ফল করে অনেক বেশী আসনে (তুলনামূলকভাবে) বিজয় অর্জন করে সরকারী দল লিবারেল ন্যাশনাল এলায়েন্সের ঘরে যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। তাদের মধ্যে কোন্দল এখন তুঙ্গে।
নেতৃত্বের কোন্দল কর্মসূচীগত কোন্দল নির্বাচনী প্রচারণার ধরনজনিত কোন্দল সবাই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এই দিনের পত্রিকায় দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ৬৭ আসন বিশিষ্ট সিনেটের এ পর্য্যন্ত প্রাপ্ত ফলাফল জানানো হয়েছে। এতে ক্ষমতাশীন লিবারেল মারাত্মক খারাপ ফলাফল করেছে বলা চলে ম্যালকম টার্নবুল (প্রধানমন্ত্রী) অস্ট্রেলিয়ার জনগনের ৭০ ভাগেরও বেশী অংশের আস্থা হারিয়েছেন নিজ দলে অভ্যন্তরেও সমস্যা জটিল আকার ধারণ করেছে।
অনেক বিশ্লেষক অনুমান করছেন শেষ মুহূর্তে কোয়ালিশনেরই সংখ্যাধিক্য অর্থাৎ ৭৬টি আসন পেলেও আইন পাশের ক্ষেত্রও জটিলতা বাড়বে অনেক বেশী কারণ নিম্ন ও উচ্চকক্ষের মিলিত শক্তিতে এখন পর্য্ন্ত দেখা যায়-লিবারেল কোয়লিশ ৯৮; লেবর পার্টি ৯৪ এবং তাদের সঙ্গে গ্রীনস ও অন্যান্য লেবর ও গ্রীনস এর সম্পর্ক বন্ধুসুলভ। সেই গ্রীনস এবং পার্লামেন্টে ৫ ও সিনেট ৫ (অনির্ধারিত) এই ১০ জন তো বেশী শক্তির দিকেই ঝোঁকার সম্ভাবনা। যদি তা ঘটে তবে লেবর পার্টি ও তিন বছর ক্ষমতায় থাকার মত শক্তি অর্জন করতে পারবে না। ফলে রাজনৈতিক অস্থায়ীত্ব ঘটার আশংকাই প্রবল।
কিছুকাল আগে সেখানে নতুন একটি দলের জন্ম হয়েছে ‘ওয়ান নেশন” নামে। এঁদের পুরোপুরি লক্ষ্য-আদর্শ এখনও জানতে পারি নি। তবে যতটুকু জেনেছি-তারা অন্য দেশ থেকে এদেশে এসে নাগরিক হওয়ার প্রক্রিয়া প্রতিরোধ করতে চান। এঁরা প্রশ্ন তুলেছেন “অস্ট্রেলিয়ান কে?” যাঁরাই অস্ট্রেলিয়ান বলে দাবী করেন তাঁরা বিদ্যমান আইনে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব প্রাপ্ত হলেও তাঁরা তো হয় এশিয়ান, নয় আফ্রিকান, নয় ইউরোপিয়ান ইত্যাদি।
এঁরা ভিন দেশ থেকে এসে পূর্বের বাসিন্দাদের চাকুরীতে ভাগ বসাচ্ছে, ব্যবসায়ে-শিল্পে-কলে-কারখানায় ভাগ বসাচ্ছে এবং ফলে পূর্বের বাসিন্দাদের অনেককে বেকারত্বের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তাঁরা বলেন, সমস্যা আরও জটিল হচ্ছেকারণকল-কারখানা নতুন করে স্থাপিত তো হচ্ছেই না বরং পুরাতন কল-কারখানা এক এক করে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তদুপরি বিদেশ থেকে মুসলমান বেশী আসায় জঙ্গিপনা সৃষ্টির এবং ধ্বংসযজ্ঞ ঘটার আশঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই তাঁরা ইমিগ্রেশন নীতিমালা ও আইন কঠোর করার পক্ষপাতী।
তবে বিদেশাগত ইমিগ্র্যান্টের সংখ্যা এতই বেশী যে মূলধারার দলগুলি এ জাতীয় সিদ্ধান্তের বিরোধী। ‘ওয়ান নেশন’ পার্টিটিও সম্ভবত: সে কারণেই এখন পর্যন্ত উচ্চ বা নিম্নকক্ষ কোথাও কোন আসনে বিজয়ী হতে সক্ষম হয় নি।
ওদিকে অস্ট্রেলিয়ান লেবর পার্টি গত ৫ জুলাই এর সিডনী মর্নিং হেবাল্ড এর এক পর্যালোচনায় দেখা যায় তারা “ALP offers stability the coalition can no longer guarantee” শিরোনামে বলেছেন, নির্বাচনী প্রচারাভিযান চলাকালীন কথাবার্তার সম্পূর্ণ বিপরীত পরিস্থিতি অধিকাংশ আসনে বিজয়ী হয়ে একটি potential stability অর্থাৎ শক্তিশালী স্থায়ীত্ব বিধানের শক্তি অর্জন করতে চলেছে।কেন এমন হচ্ছে তা বুঝতে হলে সিনেটের ফলাফলের দিকে নজর দিতে হবে। নিয়ম হলো কোন আইন পাশ করতে হলে নিদেন পক্ষে ৮৯ টি ভোট পেতে হবে। পার্লামেন্টে এমন শক্তি কোন দলেরই হবে না। সিনেট সদস্যদের ভোটও লাগবে। সেই হিসেবে সিনেট সেই শক্তি অর্জন করাও কোয়ালিশনের পক্ষে সম্ভব হবে না বলে মনে হচ্ছে।
আরও ধারণা হচ্ছে গ্রীনস সামর্থিত লেবর সহজেই সম্ভবত: প্রয়োজনীয় ভোট সংগ্রহে সমর্থ হবে। তবে এগুলি সবই অনুমান নির্ভর কথা। ম্যালকম টার্নবুলের অস্ট্রেলিয়ান লিবারেল পার্টি ও অপরাপর অংশগ্রহণকারী দলের প্রাপ্ত এযাবত আসন সংখ্যা বড্ড বেশী গোলমেলে। গণনা শেষ না হওয়া পর্য্যন্ত এবং নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্বাচনের ফলাফল চূড়ান্তভাবে শুধুমাত্র অনুমান নির্ভর হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নাই। তবে সংখ্যা এই মুহূর্তে বলতে না পারলেও ভোটের দিক থেকে অস্ট্রেলিয়ার লেবর পার্টি ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টি বা তার নেতৃত্বাধীন লিবারেল ন্যাশনাল কোয়ালিশনেরপ্রাপ্ত এ যাবত মোট ভোটের চাইতে যথেষ্ট পরিমাণে বেশী।
কিন্তু এই ভোটসংখ্যার সাথে প্রাপ্ত আসন সংখ্যা আনুপাতিক ভিত্তিক নয় যেমন নয় বাংলাদেশেও। এবারকার নির্বাচনী প্রচারণায় ক্ষমতাসীন অস্ট্রেলিয়ান লিবারেল-ন্যাশনাল কোয়ালিশন তাদের আর্থিক নীতি প্রসঙ্গে ব্যাপকভাবে বলেছেন, তাঁরা ক্ষমতায় এলে ধনিকদের ট্যাক্স ছাড় দেবেন। ট্যাক্স রিলিফ ধনীকদের দিলে স্বভাবতঃই তার দ্বারা অপেক্ষাকৃত স্বল্প আয়ের মানুষদের, সংখ্যায় যাঁরা অনেক বেশী তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, এমন প্রতিক্রিয়া সরাসরি লিবারেল পার্টিও নির্বাচনী ফলাফলে উল্টো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে।
এছাড়াও তাঁদের প্রচারণা ব্যাপকভাবে জনগণকে যে ইস্যুতে বিরোধী অবস্থানে নিয়ে যায় সেটি হলো স্বাস্থ্য সেবা সার্ভিস প্রসঙ্গে। এ ক্ষেত্রে বহুকাল ধরে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিটি নাগরিক-নারী-পুরুষ বিনা পয়সায় আজীবন সকল ধরনের মানসম্পন্ন চিকিৎসার সুযোগ ও অধিকার ভোগ করে আসছিলেন। এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় লিবারেল-ন্যাশনাল কোয়ালিশন সেই সুযোগ প্রত্যাহার করে চিকিৎসা সেবা বেসরকারী করণের প্রতিশ্রুত দিয়েছে। এই প্রস্তাবনা যেমন সমগ্র অস্ট্রেলিয়াবাসীর মন থেকে কোয়ালিশনের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছে তেমনি অত্যন্ত জোরেসোরে লেবর পার্টি এবং তাদের নেতা বিল শর্টেন তার বিরোধী প্রচারণায় সারাটি দেশ চষে বেড়িয়েছেন।
ফলে লেবর পাটির্র প্রতি সমর্থন বহু এলাকায় হুহু করে বেড়েছে বেড়েছে তাদের আসন সংখ্যাও। মেডিকেয়ারের ক্ষেত্রে কোয়ালিশন ১.৮ বিলিয়ন ডলার সরকারী বাজেট থেকে কেটে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেক্ষমতায় এলে। ১.২৫বিলিয়ন ডলার কাটবে বয়স্ক সেবা এবং ডাক্তারের সাথে পরামর্শ্য ফি, এক্সরে, ব্লাড টেষ্ট, আল্ট্রাসাউন্ড প্রভৃতির মত সর্বাধিক প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলিতেও। শিক্ষাক্ষেত্রেও কোয়ালিশানের বিশেষ করে ম্যালকম টার্নবুলের নজর এড়ায়নি। সেক্ষেত্রেও বহু সুযোগ-সুবিধাও প্রত্যাহারের অঙ্গীকার করেছেন তাঁরা ।
বেকারত্ব? ব্যাপারটা প্রায় সে রকমই তাঁদের প্রতিশ্রুতিতে রয়েছে। তাঁরা বলছেন কম বয়সী শ্রমিকেরা ঘন্টায় ৪ ডলার ন্যূতম মজুরীর ব্যবস্থার কথা বলেছেন তাঁরা। কিন্তু এতদিন সকলেই, বয়স নির্বিশেষে ভোগ করছেন ঘন্টায় ন্যূনতম ২০ ডলার মজুরী।আরও বহুবিধ গণবিরোধী প্রস্তাব জরুরী গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলিতে তাঁরা করেছেন সুষ্পষ্টভাবে ধানীক শোষণের নীতি গ্রহণ করেছেন এবং তার উপযুক্ত চ্যালেঞ্জ দিয়েছে লেবর পার্টি সর্বাত্মকভাবে ফলও তাঁরাপেয়েছেন কম না। ১৫০ আসনের পার্লামেন্টে আগের বার যেখানে তাদের ছিল ৫৫ টি আসন সেখানে ইতোমধ্যেই তাঁরা ৬৬ টি আসন নিশ্চিত করেছেন। গ্রীনস এর একটি, অন্যান্য ৪ টি এবং অমীমাংশিত বাকীগুলির ফল বেরুনোর পর যদি কোয়ালিশন বেশী পায় (কারণ তারা ইতোমধ্যেই) ৭৩ টি আসন। তবু তাঁরা যে যে সরকার গঠন করবেন তা হবে বস্তুত: একটি সংখ্যালঘু সরকার। এর স্থায়ীত্বপূর্ণ মেয়াদের জন্য হওয়ায় সম্ভাবনাও বস্তুতই কম।
প্রায় সকল রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতেই এবারকার নির্বাচনী ফলাফল এবং অস্ট্রেলিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি তেমনই পথে অগ্রসর হচ্ছে। অপরদিকে ৪ জুলাই এর সম্পাদকীয়তে সিডনী মর্নিং হেরাল্ড জোরে সোরেই উল্লেখ করেছে যে , এই নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে ভোটাররা একটি উচ্চ কণ্ঠ এবং স্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন যে টার্নবুল বিশ্বাসের যোগ্যতা হারিয়েছেন। সিনেটের ফলাফলে তা অধিকতর স্পষ্ট। তদুপরি তিনি তাঁর বিশ্বস্ত বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও এম,পি-এবারের নির্বাচনে পরাজয় বরণ করায় এবং তার নেতৃত্বের প্রতি কম আনুগত্যশীল দলীয় নেতারা নির্বাচিত হওয়ায় দলীয় কোন্দল তুঙ্গে উঠবার সমূহ আশংকা দেখা দিয়েছে। ফলে ব্যবসায়ীমহল স্থায়ী সরকার হতে পারবে না এমন আশংকায় ভুগছেন।
এহেন পরিস্থিতিতে অস্ট্রেলিয়ায় অগ্রগতির পথ দেখানোর দায়িত্ব পড়েছে পুনরায় লেবর পার্টির উপর বহু দিন পর। সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার ক্ষেত্রে বিল শর্টেন কতটা যোগ্য এবং প্রস্তুত তা দেখার বিষয়। অস্ট্রেলিয়াবাসী উভয়ের ব্যর্থতা দেখলে যে মাত্রায় হতাশ হবেন রাজনীতির প্রতি তা হয়তো পুনরুদ্ধার করাও কঠিন হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল
আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)