এবার চতুর্থবারের জন্য সিডনি এলাম। বিচিত্র নানা সম্পদ বিশেষ করে খনিজ সম্পদে বিপুলভাবে সমৃদ্ধ এই দেশ। কিন্তু দেশটি হলো প্রধানত: আমদানি নির্ভর। রফতানিও করে থাকে তবে তা প্রধানত: গম,দুধ, দুধের পাউডার এবং ফল-মূলাদি যেমন আপেল, আঙ্গুর প্রভৃতি। এই পণ্যগুলি বাংলাদেশেও রফতানি হয়। ওষুধ সম্ভবত: এদেশেই উৎপন্ন হয়। তারপরও তারা অল্প পরিমাণের ওষুধ আমদানি করে থাকে।
খনিজ সম্পদ বলতে সোনা, রূপা, কয়লা, জ্বালানি তেল, গ্যাস প্রভৃতি যে বিপুল পরিমাণে মাটির নীচে স্থাপিত আছে তা তুলতে যে ব্যয় হবে, তার চাইতে আমদানী করলে অনেক কম ব্যয়েই তা সম্ভব। তাই স্বভাবত:ই দ্বিতীয় পথটিই তারা অবলম্বন করে।
তা হলে সমস্যাটা কোথায়? মূল সমস্যাটা হলো ট্রেড ইউনিয়ন। দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দল ‘অষ্ট্রেলিয়ান লেবার পার্টি’ (ALP) নিয়ন্ত্রণ করে দেশের সমস্ত ট্রেড ইউনিয়ন। তারা অতীতে এই ট্রেড ইউনিয়নগুলি নিয়ন্ত্রণ করতো। অষ্ট্রেলিয়ার কমিউনিষ্ট পার্টি – যারা প্রচণ্ড আন্দোলন গড়ে তুলেছিল শ্রমিক এবং শ্রমজীবী নারী-পুরুষ-সবার সর্বনিম্ন বেতন নিয়ে। সে দাবী মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলো তৎকালীন অষ্ট্রেলিয়ান সরকার। আর সেই সর্বনিম্ন বেতন ঘন্টাপ্রতি ২০ অষ্ট্রেলিয়ান ডলার-যার প্রতি ডলারের বিনিময়ে পাওয়া যায় বাংলাদেশী ৬৫ টাকা।
আমরা কি ভাবতে পারি, আমাদের গার্মেন্টস শ্রমিক, অপরাপর কারখানা শ্রমিক, অফিস- আদালতে, ব্যাংকে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, মাঠে ময়দানে সর্বত্র কোন শ্রমিক শ্রমজীবী বা কর্মচারী এমন পরিমাণে বেতন পান? ঘন্টায় ৬৫ টাকা হলে আট ঘন্টায় অর্থাৎ প্রতিদিন ৫২০ টাকা বেতনের কথা? অষ্ট্রেলিয়াতে এর পরে আছে ওভার টাইম সুবিধা। রিটায়ারমেন্টের ক্ষেত্রে নিয়ম হলো সরকার বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (কেউ কোনো অপরাধ না করলে এবং তা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত না হলে) কোনো বয়সেই কাউকে অবসরে বা রিটায়ারমেন্টে পাঠাতে পারবেন না। যদি কেউ স্বেচ্ছায় অবসর নেন বা-গুরুতর স্বাস্থ্যগত কারণে কেউ অবসর নিতে বাধ্য না হন। ফলে দেখা যায়, অতি বৃদ্ধ অনেকেই চাকরি করছেন।
তাহলে প্রশ্ন তো উঠতেই পারে কি করে ন্যূনতম ঐ বেতন কাঠামোর ভিত্তিতে সরকারি- বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান এত বেতন দিয়ে কর্মচারী ও শ্রমজীবী মানুষদের চাকরিতে নিয়োগ করেন? প্রধানত: তার জবাবে বলা যায় যে সমগ্র অষ্ট্রেলিয়ার ( যার আয়তন অন্তত: ছয়টি ভারতের আয়তনের সমান) এমন বৃহৎ একটি দেশের মোট জনসংখ্যা মাত্র ২,২৫,০০,০০০ অর্থাৎ দুই কোটি ২৫ লক্ষ যাকে আমরা সংক্ষেপে বলি সোয়া দুই কোটি। দেশটি আবার অনেকগুলি প্রদেশ বা রাজ্য আছে- যার যার পৃথক পৃথক star government আছে। তার উপরে আছে ফেডারেশন গভর্নমেন্ট বা কেন্দ্রীয় সরকার। ফলে এই সব সরকারের বহু সংখ্যক কর্মচারী দরকার।
সেখানে বহু লোককেই কাজে নিয়োগ করতে হয়। রয়েছে অসংখ্য দোকান-পাট, সুসজ্জিত আধুনিক বিপনী বিতান, যাতে রয়েছে বহু সংখ্যক কর্মচারী, রয়েছে বিপুল সংখ্যক ট্যাক্সি চালক – আমরা সেগুলিকে ট্যাক্সিক্যাব বলে অভিহিত করি; রয়েছে অসংখ্য নির্মাণ কমী যারা বিশাল বিশাল বহুতল বিশিষ্ট অত্যাধুনিক দালান-কোঠা নির্মাণ করে মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছেন; প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন রাস্তা-ঘাট নির্মাণ করে চলেছেন, রয়েছেন অগণিত হাসপাতাল-ক্লিনিক যেগুলিতে বিপুল সংখ্যক ডাক্তার নার্স দিবারাত্র কাজ করে চলেছেন, রয়েছে হাজার হাজার সেলুন- সেখানে অগনিত নারী পুরুষ কর্মীরা নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোরদের চুল ছেঁটে চলেছেন, রয়েছে বিশাল বিশাল হাজার হাজার পার্ক যার পরিচর্যার জন্য নিয়োজিত আছেন অগনিত কর্মী, দেখা পাওয়া যায় বিপুল সংখ্যক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র যেগুলিতে দিবারাত্র অগনিত নারী-পুরুষ কর্মী কাজ করে চলেছেন-ইত্যাদি।
কাজের আরও যে কত ক্ষেত্র আছে-তার সবটা আমার আজও জানার সুযোগ হয়নি। আশা করি যখনই যা জানতে পারব – নিবন্ধ বা ফিচারাদি লেখে ইন্টারনেট থেকে আমার দেশের পত্র পত্রিকায় সুযোগ পেলেই পাঠিয়ে দেব। হাঁ, বেশ কিছু তথ্য আজ দিন কয়েক হলো প্রবীর আমার হাতে এনে দিয়েছে। প্রবীর আমাদের প্রথম সন্তান। এনেছে তার অফিসের ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করে। তা হলো সিডনির ইতিহাস যেগুলিতে সংক্ষিপ্তভাবে সিডনী সংক্রান্ত তথ্য জানতে পেরেছি। এই নিবন্ধের শেষ কয়েক পৃষ্ঠায় তার সামান্য সামান্য তথ্য পরিবেশন করবো। নিজেই লজ্জা বোধ করি এবারের আগে তিন তিনবার এখানে এলেও সিডনি নিয়ে কোনো ধারাবহিক বা অন্য কিছু লিখিনি। তাই এবার সেই মনের দুঃখটা সাধ্যমত দূর করার চেষ্টায় ব্রতী হয়েছি।
এবারে বলি, প্রবীরের নব-নির্মিত দ্বিতল বাড়িটির কথা। এ বাড়িটা তার আগেই ছিল কিন্তু সেটা অত্যন্ত পুরোনো-ওরা কিনেছিল কোনো এক কোরিয়ানের কাছ থেকে। কিন্তু অল্প সংখ্যক রুম বিশিষ্ট পুরাতন ঐ বাড়িটিতে যথেষ্ট জমি থাকা সত্ত্বেও তাদের কুলাচ্ছিলো না। তাই বিশাল অংকের লোন ব্যাংক থেকে অতি সহজ শর্তে নিয়ে সে ও বৌমা ডা: অর্পনা গোস্বামী (টাঙ্গাইলের মেয়ে) বড় শখ করে ঐ বাড়িটি নির্মাণ করেছে। ব্যাংক নিয়মিত ভাগের উপার্জনের একটি অংশ প্রতি মাসেই কেটে নিচ্ছে তবু ওরা ওদের জীবদ্দশায় ঐ ঋণ পরিশোধ করতে পারবে কি না সে ব্যাপারে সন্দিহান যদিও তার জন্য চেষ্টার কমতি নেই।
বাড়ির পরিকল্পনাটা হলো- নীচ তলায় কোনো বেড রুম নেই। কিন্তু প্রচুর রুম। যার বড় একটি হলো টিভি রুম। যেখানে বিশাল একটি টেলিভিশন যেখানে-যার যে চ্যানেল খুশি দেখার সুযোগ আছে। অনেকগুলি অত্যাধুনিক সোফা সেট। সবাই, এমন কি আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, বাইরের অতিথি সবাই বসে টিভি দেখতে গল্প করতে, গান-বাজনা করতে বা রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা করতে পারবেন। প্রচুর চেয়ার আছে বসবার।
অন্তত: ৫টি স্মার্ট টেলিভিশন রয়েছে পাঁচটি কক্ষে। তার মধ্যে একটি বিশাল। ওটাতে অষ্ট্রেলিয়ার বিডিবি নানা চ্যানেল, ভারতের ও বাংলাদেশের প্রায় সবগুলি চ্যানেল দেখার সুযোগ রয়েছে। দিবারাত্র কোল্ড ওয়াটারের ব্যবস্থা তো আছেই। নীচ তলায় বহু সংখ্যক ঘর, ওপর তলায় শুধুই শোবার ঘর ও বাথরুম।
সুসজ্জিত মন্দির, পূজা অবশ্য লক্ষ্মী পূজো ছাড়া অন্য কোনো পূজা হয় না। তবে অনেক দেব-দেবীর মূর্তি, ভক্তিমূলক বাদ্যযন্ত্র, প্রদীপ, পূজার বাসন-উপকরণ ও ভোগ রাঁধবার বাসন-কোসন যথেষ্ট। একটি ডেস্ক-কম্পিউটার এবং জনে জনে ল্যাপটপ-যার যার শয়ন কক্ষে। ইন্টারনেটের ওয়াই-ফাই সুবিধা সর্বত্র সারা বাড়িটি জুড়ে। আমাদের দেশের মতো কোনো মডেম কিনতে হয় না। ওয়াই-ফাই গোটা বাড়ীর সব কটি রুমেই শুধু নয়, দিনরাত ২৪ ঘন্টা ৩৬৫ দিন ব্যাপী। ইন্টারনেট চলতে পারে দ্রুততম গতিতে এবং সর্বত্র।
বাড়িতে তিনটি গাড়ী আছে। প্রতিটিই ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে কেনা। একটা ব্যবহার করে প্রবীর, অপরটি বৌমা ড: অর্পনা গোস্বামী এবং অপরটি নাতনী ইসিতা-(বাঁধন) মৈত্র। মজার ব্যাপার হলো, একটি নাতনী নিজের টাকায় কিনেছে-তাও লোনে। যার এ যাবত অর্ধাংশ শোধ হয়েছে মাত্র। অষ্ট্রেলিয়ায় সম্ভবত: প্রতি পরিবারেই জনপ্রতি গড়ে দেড় থেকে দুটি করে গাড়ি রয়েছে। রাস্তায় বেরুলে শুধু মাত্র গাড়ি আর গাড়ি। আর তাতে যাত্রী বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাত্র একজন অর্থাৎ মালিক স্বয়ং যিনি নিজেই চালক বা চালিকা।
এবারে আমরা অতীতের তিনবারের মতো একাকীত্ব বোধ করছি না। আগে নাতি-নাতনী স্কুলে বা কলেজে চলে যেতো, প্রবীর আর অর্পনা চাকরিতে। এবার নাতনী নিজের গাড়িতে করে আমাদের দুজনকে নিয়ে বেড়ায় নানা দর্শনীয় স্থানে। আর মজার ব্যাপার, বাঁধন ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছে ঠিক আমরা সিডনি আসার দু‘দিন পরেই। তাই সে বলে, ‘অনেক দিন ধরে বহু পরীক্ষা দিয়েও পাইনি। এবারে, দাদু , তুমি এসেছ- তোমাদেরকে নিয়ে বেড়াব- তাই তুমি আসার সাথে সাথেই লাইসেন্সটি পেয়ে গেলাম। তাই তোমাদেরকে নিয়ে বেড়ানোটাই পাবে সর্বাধিক অগ্রাধিকার।’
বাঙালীর সংখ্যা সিডনি শহরে ২০ থেকে ২৫ হাজার। অনেক বাঙালি অনুষ্ঠানে তারা থাকেন- যেমন দুর্গোৎসব, সরস্বতী পূজা, দুটি ঈদ, একাধিক স্থানে আকর্ষণীয় বৈশাখী মেলা এবং বিশেষ বিশেষ স্থানে ও দিনে অগনিত সাংস্কৃতি প্রতিষ্ঠান। আমাদের সর্বাধিক প্রিয় সাংস্কৃতিক সংগঠনটি হলো-প্রবীত্র। (চলবে…)
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)